বিশাল রুমটাতে বসে মারজিয়া আর তকী কিছু ফাইলপত্র নিয়ে আলোচনা করছে। তকীর পাশের চেয়ারেই জারিন মাথা নীচু করে টেবিলের উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একখানা সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট দেখিয়ে মারজিয়া কিছু একটা বর্ননা করছে, তকীও বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনছে এবং এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করছে।
জারিন একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তকী—
তকী ঘুরে জারিনের দিকে তাকায়।
ঘুম চোখগুলো হালকা খুলে জারিন বলে, ওয়ান কফি ফর মি প্লিজ।
তকী ঘুরে আবার মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসে। মারজিয়া বিরক্তির সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তকী চেয়ারটা পেছনে সড়িয়ে নিঃশব্দে উঠে দাড়ায়। দরজার পাশে রাখা কফি মেকারের নীচে একখানা মগ রাখে, তাতে অল্প অল্প করে কফি জমা হতে থাকে। জারিন ঘুম চোখে তকীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
মারজিয়া বলে, নিজের কাজগুলো নিজের করতে কি সমস্যা হয় তোমার? তকীর দিকে তাকিয়ে রাগী সুরে বলে, আর তুমি করছোও বা কেন? ওর পিএ হতে আসছো এখানে?
জারিন ঘুরে মারজিয়ার দিকে তাকায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে। একখানা হাসি দিয়ে তকীর দিকে তাকায়। তকীও কথাটা শুনে হেসে পেছনে তাকায়। কফির মগটা নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, বাহ রে পিএ কেন হব আমি! কফির মগটা জারিনের সামনে সাবধানতার সাথে রাখে। হেসে বলে, আই আম হার ম্যান।
জারিন তকীর হাতটা ধরে হালকা টেনে তার হাতে একখানা চুমু খায়।
মারজিয়া বিরক্তি চোখে ঘুরে রিপোর্টের দিকে মনোযোগ দেয়। তকীর গালগুলোতে লাল আভা দেখা যায়। নিঃশব্দে আবার চেয়ারে বসে রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা শুরু করে।
ওয়াসিম হাসিমুখে রুমে ঢুকে। বলে, কি অবস্থা সবার?
সকলে ঘুরে তাকে দেখে। ওয়াসিমকে দেখে মারজিয়ার চেহারায় খানিকটা বিরক্তি দেখা যায়। সে চাঁপা গলায় বলে, তকী, এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলছি। রিপোর্টগুলো ফাইলে গুছিয়ে ওয়াসিমকে কোনো প্রকার পাত্তা না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় মারজিয়া।
জারিন ও তকী বিষয়টা খেয়াল করে। জারিন বিস্মিত কণ্ঠে বলে, সার্জন হোসাইন কি মাত্র আপনাকে উপেক্ষা করে চলে গেল? ওয়াসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তকী রাগী সুরে বলে, কি করেছেন আপনি?
ওয়াসিম বিরক্তি চোখে তকীর দিকে তাকায়। কিছু নাহ। কি একটা ভেবে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় সে।
মারজিয়া নিজের কেবিনে বসে আছে। চোখে-মুখে তার বিরক্তি। টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে এক মগ কফি দিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। কিছুক্ষণ বাদে উসমান কফি নিয়ে তার রুমে আসে। মারজিয়া তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করে না।
অন্যান্য দিনের চাইতে আজ উসমানের বেশি অস্থিরতা কাজ করে। তার মনে হয়— মারজিয়া যেন তাকে অন্তত কিছু বলে, আর কিছু হোক একটু বকাঝকা করলেও চলবে। কিন্তু মারজিয়া মুখ তুলেও চায় না। উসমান সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
খানিক বাদে মারজিয়া তার দিকে তাকায়। কিছু বলবেন?
উসমানের মনে হয় মারজিয়ার কণ্ঠটা যেন অন্যান্য দিনের চাইতে শান্ত। অন্যসময় তার কণ্ঠে রাগ-বিরক্তি-ঘৃণা এসব বেশি বোধ হয়। আজ যেন কেমন শান্ত-প্রশান্তিময় শোনাচ্ছে তাকে। উসমান এক দৃষ্টিতে মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মারজিয়া ফাইলের দিকে তাকাতে তাকাতে বলে, বসুন।
উসমান চমকে যায়। আস্তেধীরে কোনো প্রকার শব্দ ছাড়া চেয়ারটা টেনে মারজিয়ার সামনে বসে। ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
মারজিয়া ফাইলটা বন্ধ করে উসমানের দিকে তাকায়। বলে, আপনি এর পূর্বে কোথাও কাজ করেছেন?
উসমান বিস্ময়ের সাথে বলে, মেডিকেল ফিল্ডে করা হয় নি। কিছু এনজিওর সাথে কাজ করেছিলাম।
আপনি কি এখানে ডাক্তার শিরিনের রেফারেন্সে এসেছেন?
উসমানের বুকটা ধুক করে ওঠে। সে মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছিলো যাতে রাতের ঘটনাটা মারজিয়ার মনে না থাকে বা অন্ধকারের কারনে তাকে মারজিয়া দেখতে না পায়। কিন্তু নাহ। সে দেখেছে, ভাল করেই উসমানকে ডাক্তার শিরিনের সাথে বিব্রতকর অবস্থায় দেখেছে। এবং বিষয়টার একখানা উপসংহারও নিজে থেকে ভেবে ফেলেছে। উসমান কিছু না বলে বীভৎসকর মুখভঙ্গি করে মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মারজিয়া তাকিয়ে তার চেহারাটা দেখে। উসমানকে দেখে মনে হয় তার সামনে মারজিয়া নয় বরং আজরাইল বসে আছে এবং জান কবজের উদ্দেশ্যে এখনই তাকে সাথে চলার জন্য বলেছে। মারজিয়া তাকিয়ে টেবিলের উপর রাখা ট্যাবের বন্ধ কালো স্ক্রিনে নিজের চেহারাটা দেখে। এরপর কি একটা ভেবে মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনি আসতে পারেন।
উসমানের যেন জানে পানি ফেরত আসে। সে তড়িগড়ি করে রুম থেকে খানিকটা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মারজিয়া আবার ট্যাবের কালো স্ক্রিনের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে দেখে। এরপর একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাবটা উলটে দেয়।
বিকালের শেষ আলো টুকু নিভে যাওয়ার পথে। মারজিয়া এক মনে দিনের শেষ কাজ হিসেবে নিজের কেবিনে বসে রুগীদের রিপোর্টগুলো গুছাচ্ছে।
হঠাৎ করিডোরে বেশ চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। ডাক্তার শিরিন দ্রুত পায়ে উসমানকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। করিডোরে দাঁড়ানো অন্যান্য নার্স, স্টাফ ও ডাক্তাররা অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়। উসমান মাথা নীচু করে রেখেছে।
আওয়াজ পেয়ে ওয়াসিম নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। কি হয়েছে কি এখানে! ওয়াসিম উসমানের দিকে তাকায়। উসমান ওয়াসিমের সাথে চোখ মেলাতে পারে না। মাথা নীচু করে রাখে। ওয়াসিম শিরিনের দিকে তাকিয়ে বলে, কি হয়েছে, ডক্টর? অল ওকে?
শিরিন চিৎকার করে বলে, কিচ্ছু ঠিক নেই, স্যার! এই বাস্টার্ডটা—
কথাটা শেষ করতে দেয় না ওয়াসিম। বলে, আপনারা দুইজন আমার রুমে আসুন।
ওয়াসিমের রুমে ঢুকেই চিৎকার করে ডাক্তার শিরিন বলে, এই বাস্টার্ডটা আমাকে বেশ অনেকদিন যাবত বিরক্ত করছে। বয়স কম ভেবে আমিও খুব বেশি পাত্তা দেই নি। ভেবেছি হয়ত মজা করছে বা কিছু। কিন্তু আজকাল তো আমার সাথে জোরজবরদস্তি করা শুরু করেছে সে! কাল রাতে ও— কথাটা আর শেষ করতে পারে না শিরিন। কান্নায় ভেঙ্গে পরে।
ওয়াসিম বিস্ময়ের সাথে উসমানের দিকে তাকায়। বলে, এসব কি শুনছি!
উসমান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিরিন চিৎকার করে ওঠে, ওর কি বা বলার থাকবে! স্যার, আপনি সময় নষ্ট করবেন না। এখনই পুলিশ ডাকুন। ওর মত জানোয়ার মুক্ত থাকলে এই হাসপাতালের কোনো মেয়ে নিরাপদ থাকবে না!
উসমান মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনার কাছে কি প্রমান আছে এসবের?
শিরিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্বশব্দে উসমানের গালে একটা চড় মারে।
ওয়াসিম বিস্মিত কণ্ঠে বলে, ডক্টর শিরিন—
শিরিন বলে, স্যার, আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি সার্জন হোসাইনকে ডাকুন। কাল রাতে আমার নাইট শিফটের সময় এই জানোয়ারটা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে স্টোররুমে ডাকে। সেখানে ও আমার সাথে— একটু থেমে নাক টেনে জোরে শ্বাস নিয়ে কান্নারত কণ্ঠে বলে, সার্জন হোসাইন তখন ওখানে ছিল! সে সব দেখেছে। আপনি ওকে ডাকুন।
মারজিয়ার নাম শুনেই উসমানের চোখ দুটো বিস্মিয়ে বড় হয়ে যায়।
ওয়াসিম গম্ভীর মুখে উসমানের দিকে তাকায়। আরেকবার জিজ্ঞেস করে, তোমার কিছু বলার আছে?
উসমান কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
ওয়াসিম শান্ত গলায় বলে, আমি ডাক্তার শিরিনের সাথে একান্তে কথা বলতে চাই। তুমি আসতে পারো।
উসমান মাথা হেলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।