‘One Hundred Years of Solitude’ বা ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের এক অমর সৃষ্টি। প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৭ সালে। কলম্বিয়ান লেখক মার্কেজ এই উপন্যাসের জন্য ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বাস্তব ও জাদুবাস্তবতার মিশেলে লেখা সেই গল্পে রয়েছে একটি পরিবারের ৭ প্রজন্মের গল্প। যে গল্প ম্যাকেন্ডো নামক একটি কাল্পনিক শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। যে গল্পের ভিতর দিয়ে বর্নিত হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার ১০০ বছরের ইতিহাসও। এতে আছে যুদ্ধ, বিপ্লব ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পুর্বাপর। সাথে আছে ভুত-প্রেত, অদৃশ্য ঘটনা, বিভিন্ন রকমের কল্প-কেচ্ছা। আমাদের প্রাণের জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়লো মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ এর কথা। কোন কারণ ছাড়াই। মার্কেজের উপন্যাসের কাহিনীর মত করে জ্ঞানাঙ্কুরের রয়েছে ১০০ বছরের গল্প। গত ১০০ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই স্কুলে জ্ঞানের পাঠ নিচ্ছে। জ্ঞানাঙ্কুরের কাল পরিক্রমার সাথে জড়িয়ে আছে পার্বতীপুরের ইতিহাস। একই সাথে জ্ঞানাঙ্কুর পার্বতীপুরের ঐতিহ্যের অংশও বটে। এরপরেও অনেকের মনে এই প্রশ্নের উদ্ভব হয়, জ্ঞানাঙ্কুরের এই ১০০ বছরের যাত্রার কতখানি গৌরবের? এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিঃসঙ্গতা কী কখনও তার সঙ্গী হয়নি? সেই আলাপ আপাতত নিকট ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছি।
তারচেয়ে আমরা বরং ভিন্ন আলাপে যাই। ইতিহাসের ১০০ বছর কী বৈচিত্র্যের বাইরে থাকতে পারে? পুর্ব বাংলার মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই অর্থে এটি বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও তখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি, ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অংশ। এর বছর চারেক পরেই পার্বতীপুরে জ্ঞানাঙ্কুরের জন্ম হয়। এরপর যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জ্ঞানাঙ্কুর। ১৯২৫ সালের দুনিয়ার কথা একটু ভাবুন। জ্ঞানাঙ্কুর যখন নবজাতক, দুনিয়া জুড়ে ব্রিটিশদের জয়জয়কার। সেই সময়ের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সুর্যাস্ত যেত না। ১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়, ব্রিটিশদের টপকে দুটি পরাশক্তির মহড়া দেখে সারা পৃথিবী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আসে ১৯৪৭, এই ভূখণ্ড থেকে এক সময় ব্রিটিশরা বিদায় নেয়, জন্ম হয় পাকিস্তানের। ২৩ বছর বয়সী পাকিস্তানও একদিন ইতিহাস থেকে মুছে যায়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। একটি নবীন রাষ্ট্র,বাংলাদেশের জন্ম হয়। ব্রিটিশ আমলেই ১৮৭৮ সালে রেলপথের মাধ্যমে পার্বতীপুর সংযুক্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাথে। পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনের হাতছোয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানাঙ্কুর এই সকল ইতিহাসের সাক্ষী হয়। এরপর বিংশ শতাব্দী পার হয়ে ২০২৫ এর এই প্রান্তে এসেও জ্ঞানের অঙ্কুর তথা শিক্ষার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে অকাতরে। জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে উত্তরের এই অন্যতম প্রাচীন জনপদ পার্বতীপুরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জ্ঞানাঙ্কুর। মার্কেজের নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর এর সাথে আমাদের জ্ঞানাঙ্কুরের খানিকটা মিল এভাবেও খুঁজে পাওয়া যায়।

২)
আমরা ক্লাশ থ্রিতে উঠেছি। প্রাইমারি স্কুলের (স্টার মডেল) পুরাতন ভবন ভেঙ্গে নতুন স্কুলের নির্মান কাজ শুরু হবে। আমাদেরকে শিফট করা হলো জ্ঞানাঙ্কুরের একটা অংশে (দক্ষিণ পূর্ব কোণের একতলা ভবনে, বর্তমানে সেটি সম্ভবত আর নেই)। প্রাইমারির ছাত্র হয়েও হাইস্কুলে পড়াশুনা শুরু হয়। এরপর ভবনের নির্মান কাজ শেষ হলে স্টার মডেলে ফিরে যাই। ক্লাশ ফাইভে উঠার পর আবারও জ্ঞানাঙ্কুরে ফিরতে হয়। হোসেন স্যারের প্রাথমিক বৃত্তি কোচিং এ। মহাকালের হিসেবে তামাম দুনিয়ায় তখন ১৯৯১ সাল। দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে জাঁকিয়ে শীত নেমেছে। পৃথিবী জুড়ে কত ঘটনা ঘটছে। ‘হামার ছইল’ এরশাদের পতন হয়েছে। গুটি গুটি পায়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের পথে। ইরাকের সাদ্দাম কুয়েত আক্রমণ করে বসেছে। পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে। দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজছে।
দুনিয়ার সেই উত্তাপ তখনও তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম গরীব বাংলাদেশে এসে পৌঁছেনি। বরং দেশের উত্তরের জনপদ পার্বতীপুরে শীত জেঁকে বসেছে। ঐ সময়ের এক শীতের সকালে স্কুলের চৌহদ্দিতে গিয়ে হাজির হই। আমার গাঁয়ে প্রায় শীর্ণ নীল রঙের একটা চাদর জড়ানো। খুঁজে খুঁজে গ্যালারি ক্লাশরুমের সামনে চলে যাই। ক্লাশের ভিতরে আগে থেকে মজুদ ছিল আমার সমবয়সী অনেকেই। তাদের অধিকাংশের শরীরে শোভা পাচ্ছিলো দামি জ্যাকেট ও সুয়েটার। বেশ কান্তিময় একটা পরিবেশ। প্রায় শীর্ন নীল রঙের চাঁদর জড়িয়ে হাজির হই সেখানে। সেই আমি যে শ্রীহীন, শুকনা, পটকা গোছের। দুচোখে স্বপ্ন ও বিস্ময়ের মিশেল। অন্যদের সাথে হোসেন স্যারের কোচিং শুরু করি। কোচিং এর সুবাদে ১ বছর জ্ঞানাঙ্কুরে যাতায়াত চলতে থাকে। প্রাইমারি শেষ করেই বছরই ভর্তি হয়ে যাই জ্ঞানাঙ্কুরে। এরপরের ৬ বছর জ্ঞানাঙ্কুর ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এসএসসি পাশ করে জ্ঞানাঙ্কুর ছেড়ে দিই, বের হয়ে যাই পথিকের মত। পৃথিবীর পথে পথে চলতে থাকি। দেখতে দেখতে প্রায় ৩৫ বছর কেটে গেছে। দীর্ঘ সময় পরে সেই সব স্বপ্নিল স্মৃতিময় দিনে ফিরে আসা সত্যিকার অর্থে মনোমুগ্ধকর ব্যাপার। স্মৃতির সাথে যখন শতবর্ষ জড়িয়ে থাকে, সেটা হয় বিশেষ আনন্দের। যে স্কুলের শিক্ষা জীবনের ভীত গড়ে দিয়েছে, যে স্কুল দিনের পর দিনে স্বপ্ন দেখিয়েছে, সেই স্কুলের শতবর্ষ উদযাপনের অংশ হতে পারা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আজ আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে।
৩)
একটা স্কুলের ক্যাম্পাস, ভবনের বাইরে প্রধান প্রাণভোমরা সেই স্কুলের শিক্ষকেরা। জহুরুল হক, জ্ঞানাঙ্কুরের শিক্ষকের আলাপ করতে গেলে প্রথমে যার নাম আসে। আমরা সরাসরি জহুরুল স্যারকে পাইনি। আমাদের ভর্তির আগেই তিনি অবসরে চলে যান। কিন্তু স্কুলের পূরা সময়টায় বিভিন্ন কারণে উনার নাম চলে আসতো। ৩ দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষক। জ্ঞানাঙ্কুর কে আজকের এই জ্ঞানাঙ্কুরে রূপান্তরের মূল কারিগর ছিলেন তিনি। আজ এই বিশেষ সময়ে স্যারকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি।
আমার ব্যক্তিগত প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় প্রথম যে নাম মনে আসে তিনি হোসেন স্যার। তিনি আমার ভিতরের আমাকে উদ্ভাসিত হতে সাহায্য করেন। বেশ মনে আছে, বৃত্তি কোচিং এ প্রায়শই পরীক্ষা নিতেন। যারা ভালো করতেন, পুরস্কার হিসেবে ছোট ছোট উপহার তুলে দিতেন। অপর দিকে যারা অমনোযোগী, ফাঁকিবাজ ওদের ভাগ্যে জুটত শাস্তি। দুই আঙ্গুলের মাঝে কলম রেখে চাপ দেয়া মাত্রই ককিয়ে উঠত। কিছু সময়ের জন্য ব্যথায় লম্বা হয়ে যেত, শাস্তি পেয়ে। একটা সুন্দর সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়ে উঠে, যদি সেখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন চর্চা চালু থাকে। এখন চিন্তা করলে মনে হয় হোসেন স্যার ছিলেন সেই দর্শনের একজন বাস্তব কারিগর। ক্লাসে রেগে গেলে কখনই মেজাজ হারাতেন না। বরং স্লেশামিশ্রিত দুষ্টমি করতেন। খুব রেগে গেলে প্রায়শই বলতেন, তুই একটা বরখুদ্দা। এই বরখুদ্দা শব্দটা হোসেন স্যারের আবিষ্কার, শব্দটা একান্ত স্যারের। স্যার জীবনের শেষ দিকে এসে পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। খবর পেয়ে দেখা করতে গেছিলাম। যে আমি স্যারের এত প্রিয় ছাত্র ছিলাম, তাকেও চিনতে পারলেন না। একটা ঘরের মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিইয়েছেন। কুরআন শরীফ ও অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ে সময় কাটিয়েছেন। পূরা একটা জীবন সাধারণ ও অনাড়ম্বরভাবে কাটিয়ে দিলেন। দিলেন এই জন্য বলছি, তিনি আজ প্রয়াত। পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে অনন্ত মহাকালের পথে রওয়ানা হয়েছেন।
আমরা ১৯৯৭ সালে এসএসসি পাশ করেছি। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ২৫ বছর পুর্তি অনুষ্ঠানের একটা প্রধান আকর্ষণ ছিল শিক্ষকদের সম্মাননা দেয়া। আমাদের সময়ে ছিলেন এবং অবসর জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁদের কয়েকজনকে আমরা সম্মানিত করতে পেরেছি। হোসেন স্যার ছাড়াও সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন চৌধুরী রাজ্জাক স্যার, সতীশ স্যার, ইয়াকুব স্যার সহ অনেকে।

আমরা হেড মাস্টার হিসেবে পেয়েছি চৌধুরী রাজ্জাক স্যারকে। আরেকজন ছিলেন শাহ রাজ্জাক স্যার। শাহ রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে দুটি তথ্য দিয়ে চৌধুরী স্যারের আলাপে যাই। শাহ রাজ্জাক স্যার ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী, গাঁয়ে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। যে একবার চড় খেয়েছে, আজীবন সেই চড়ের কথা ভুলবে না। অথচ এমনিতে কত শান্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। চৌধুরী রাজ্জাক স্যারের কথা বলছিলাম। সেই সময়ে স্কুলের শিক্ষক সমাজ ছিলেন সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। চৌধুরী রাজ্জাক স্যার ছিলেন প্রায় সকলের শিক্ষক। সুতরাং তিনি যেখানে যান অন্যরা সতর্ক হয়ে উঠে। যথারীতি আমরাও খুব ভয় পেতাম স্যারকে। প্রয়োজন হলে তিনি একটা বেত নিয়ে পূরা স্কুলে ঘুরে বেড়াতেন। আর বেত নিয়ে বের হলে পূরা স্কুলে থরহরিকম্প শুরু হয়ে যেত। সাথে সাথে পূরা স্কুলে সুনসান নীরবতা নেমে আসতো।
চৌধুরী স্যার কি নিয়ে এখনও একটা ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমি আজীবন মুখচোরা। কথায় আছে না, চোরের ১০ দিন, গৃহস্থের ১ দিন। হঠাৎ একদিন স্যারের মাথায় খেলে, এসেম্বিলিতে আমি কখনও মঞ্চে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাই না। ঐদিন তিনি জোর করে মাইকের সামনে তুলে দেন। স্টেজে উঠলে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তখন আর কথা বের হয় না, সাপ কায়দা মত ব্যাঙের অর্ধেক নিজের ভিতরে নিতে পারলে ব্যাঙ যেভাবে ফ্যাস ফ্যাস করে শব্দ করে, আমার গলা থেকে সেটার চেয়ে উত্তম কোন শব্দ বের হয় না। যাহোক, পড়েছি যখন মোঘলের হাতে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য স্টেজে থেকে যাই। থরহরিকম্প দিয়ে পা নাচতে থাকলেও কোনমতে গেয়ে চলে আসি। ফিরে এসে লাইনে দাড়াতেই চৌধুরী স্যার সামনে আসেন। ভাবলাম, বেশ তো গেয়েছি, ধন্যবাদ দেয়ার জন্য স্যার এসেছেন। স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি বললেন, ‘মাত্র ১০ লাইন গাইতে হবে। তার মধ্যে ৪ লাইন নাই! এসব গাধা যে কোথা থেকে যে আসে’!
৪)
স্যারদের গল্প, নিজেদের স্মৃতির সীমা পরিসীমা নেই। লিখেও শেষ করা যাবে না। এর মাঝেও ২/৪ টি ঘটনা উল্লেখ না করলেও নয়। ক্লাশ এইটের বৃত্তির কোচিং করাতেন নুরুল স্যার ও মনীন্দ্র স্যার। ছোটখাট মানুষ নুরুল স্যার (সম্পর্কে নানা) ছিলেন ছাত্র নিবেদিত প্রাণ, পড়াতে শুরু করলে সময় জ্ঞান থাকতো না। কিন্তু একটা জিনিস বারবার বোঝানোর পরেও কেউ না বুঝলে, কিংবা ক্লাশের মাঝে খামখেয়ালি করলে চট করে ক্ষেপে যেতেন। আর ক্ষেপে গেলে স্যারের নিজের মুখের উপর কন্ট্রোল থাকতো না। স্যারের একটা কমন বকা ছিল, ‘তুই তো একটা শু*র’, আরে শয়তান চুপ করেক, বেশি চিল্লাইলে খচি ফেলাইম (পায়ের নিচে ফেলে) দুইতলা থেকে ফেলে দেইম’। স্যারের বলা এই সমস্ত ডায়ালগ ছিল সবার মুখে মুখে। স্যার দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার বিশ্বাস,হাজারও ছাত্রের দোয়ার বদৌলতে নিশ্চয় ভালো আছেন।
মনীন্দ্র স্যারের বাসায় পড়তে গেছি। একজন লোক দাওয়াত কার্ড নিয়ে এসেছে। স্যার দাওয়াত কার্ড নিলেন,আদাব জানিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছেন। স্যার তাকে ডেকে পাঠালেন। লোকটা ফেরত আসলে দাওয়াত কার্ডটা তার দিকে ধরে বলেন, এটা আমার চিঠি নয়, অন্য কারও হবে। সেই লোক আগে থেকে স্যারকে চিনতেন। কিন্তু স্যারের কথায় থতমত খেয়ে যান। কি করবে বুঝতে পারে না সেই লোক। কিন্তু স্যার তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। সেই লোককে চিঠি ফেরত নিতে বাধ্য করেন শেষ পর্যন্ত। স্যারের নাম ‘মনীন্দ্র’ এর জায়গায় ‘মহেন্দ্র’ লেখাতে সেই বিপত্তি ঘটে।
ইয়াকুব মওলানা স্যারের কথা লিখতে গিয়ে এখনও কেমন যেন ভয় ভয় অনুভূতি কাজ করছে। গাঁয়ের রং ময়লা,লম্বা দাঁড়ি, সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা ইয়াকুব স্যার খুবই ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন মূলত আরবির শিক্ষক। পড়াশোনায় বেশি ফাঁকি দিলে কিংবা বেয়াদবি করলে তাঁর আর রক্ষ্যা নেই। বেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পশ্চাৎ দেশের উপর সপাসপ বেতের বাড়ি পড়ত। স্যারকে রাগিয়ে দিলেই তিনি যেন জমের এজেন্সি পেয়ে যেতেন। অনেক দিন হয়েছে স্কুল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীকে প্রহার করা নিষিদ্ধ। এটা নিশ্চয় ভালো সিদ্ধান্ত। তবু কখনও মনে হয়, স্যারদের সেই শাসন পদ্ধতি ভালো ছিল। শোনা যায়, এখনকার দিনে স্যারেরা পড়াতে গিয়ে উল্টা ছাত্রদের ভয়ে থাকে। এই পদ্ধতি কি বিশেষ সুফল বয়ে আনছে? বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
আমাদের মধ্যে অনেকে যেমন ছিল যেমন বুনো ওল, স্যারেরা ছিলেন তেমনি বাঘা তেঁতুল। এরপরেও দুষ্টের দলের সাথে পেরে ওঠা কঠিন ছিল। বেশি কড়া স্যারেরা এসে দেখতেন ব্লাকবোর্ডে তাঁদের নামে গুণকীর্তন-নামা। সেসব অবশ্য উচ্চারণ করে পড়া যেত না। আমদের এক সহপাঠী ছিল এক কাঠি বেশি সরেস। পথে ঘাটে স্যারদের দেখা পেলে দুর থেকে হাত তুলে সালাম দিত। কিন্তু আসলে মিনমিন করে বলত, স্যার সিনেমা দেখতে গেছিলাম, স্যার। বেশি তেড়িবেড়ি করলে অবশ্য স্যারেরা ছাত্রের বাপের কাছে নালিশ দিয়ে দিতেন। এরপর বাপের হাতে মাইর খেয়ে অনেকেই বক্সখাটের মত সাইজ হয়ে থাকতো। এরপরেও বলবো, স্কুলের স্যারেরা ছিলেন পিতৃতুল্য। আমাদের উপরে শাসন, বকাবকি সবই ছিল আমাদের কল্যাণের পথে মঙ্গল চিন্তায়।

৫)
শুরুতে মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ এর প্রসঙ্গ এসেছিলো। জ্ঞানাঙ্কুরও তার পথ পরিক্রমায় ঠিক একশত বছর পার করে দিলো। তাঁর উঠোনে ছুটাছুটি করে, পড়াশোনা করে অনেকে অনেক দূরে পৌঁছেছেন। নিজ শহর থেকে অন্য শহরে, বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পদাচারনা করছেন। জ্ঞানাঙ্কুরের পর কত কত স্কুলের জন্ম হল, অনেকে সরকারী স্কুলে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানাঙ্কুর আছে সেই তিমিরেই, গত ১০০ বছর আগে যেভাবে ছিল। এই বেদনা নিয়ে হয়ত আরও অনেকগুলো বছর পার করতে হবে। একজন এলামনাই হিসেবে এই বেদনা আমারও। আমাদের প্রাণের জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারি ঘোষণার দাবী তুলে ধরা হোক। ১০০ বছর পুর্তির প্রধান স্লোগান হোক, ‘জ্ঞানাঙ্কুরকে সরকারি স্কুল হিসেবে দেখতে চাই’। জ্ঞানাঙ্কুর সরকারি হলে সেই গৌরবের ভাগীদার আমরা সবাই হবো।
উন্নত বিশ্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে প্রাক্তন শিক্ষার্থী বা এলামনাই। শত বছরের এই মহামিলন মেলা থেকে জ্ঞানাঙ্কুরের এলামনাইরাও সে পথ অনুসরণ করতে পারে। শুরুতে খুব বেশি না হলেও একটু একটু করে জ্ঞানাঙ্কুরকে বদলাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারি আমরা যারা এলামনাই আছি। যেমন,জ্ঞানাঙ্কুরের মধ্যে উন্মুক্ত লাইব্রেরী কাম সোশাল সার্ভিস ও লার্নিং সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেখানে জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। বর্তমান সমাজ উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ে সভা সেমিনার আয়োজন হতে পারে। লার্নিং সেন্টারে সফটওয়ার, কারিগরী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। ছোট ছোট এ সমস্ত পদক্ষেপ দিন শেষে সমাজ পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সবশেষে কামনা করি, জ্ঞানাঙ্কুর পুর্বের ন্যায় শত শত বছর ধরে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখূক। একটি ন্যায়পরায়ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখুক। যুগোপযুগী জ্ঞান, সৎ ও মানবিক বোধ সম্পন্ন তরুণ সমাজ উপহার দিক। জ্ঞানাঙ্কুরের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক চারদিক।
সাজিদ রহমানঃ (প্রকৃত নাম- মোঃ সাজেদুর রহমান) প্রকৌশলী; গল্পকার ও উপন্যাসিক; জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র (এসএসসি ১৯৯৭ ব্যাচ)।