
কোথায় যেন শুনেছিলাম। এমনও হতে পারে, স্বপ্নের ভিতরে কেউ এসে এলান করে দিয়েছিলো। মানুষ বড় হলে গাছ হয়ে যায়!
অনেক দিন সেই বাণীর শীতনিদ্রা পেয়েছিলো। বিভীষণের মত। ঘুম পাতলা হলে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ বড় হলে গাছ হয়ে যায়।
কেউ কেউ হয়ে যায় অদ্ভুত সুন্দর ভূত গাছ, ড্রাগনস ব্লাড ট্রি, উইস্টেরিয়া, বাওবাব, টি-পট, ম্যাপল কিংবা চেরি ফুলের গাছ।
আর যারা দেশী মাটি, গন্ধ, জল-পানি, বেহেয়ার ডাল, কচুরিপানা, মরা পুস্কুনির কাঁদা, লাশ কাটা ঘরের চা টং এ বসে গোগ্রাসে গিলে বড় হতে থাকে, ডাল পালা গজায়, তাদের কথা ভিন্ন। ওরা শেষে তীব্র চুলকানি ও জ্বালা সৃষ্টি করতে পারঙ্গম চুতরা গাছ, না হয় ছাইতন, তালিপাম, চালতা, ডুমুর, বৈঁচি গাছ হয়ে কোনায় চিপায় পড়ে থাকে। এর মাঝে কিছু মানুষ অবশ্য পলাশ, বকুল, চন্দ্রমল্লিকা, শিমুল, কামিনী, কৃষ্ণকলি, কৃষ্ণচূড়া কিংবা গন্ধরাজের সুবাস ছড়িয়ে বেঁচে থাকে অনেক দিন।
অথচ সবচেয়ে জরুরী যে বৃক্ষ ছায়া দিয়ে পথিকের ক্লান্তি দূর করে, পাখির আশ্রয় হয়ে, খাবার জুগিয়ে যায়, যে বটঝুরি শিশুকে দোল দোল দুলুনি দেয়, সেই বটবৃক্ষ আজ বিলীন প্রায়। সন্তানের জন্য পিতা, সহোদরের জন্য বড় ভাই, নাতির জন্য দাদা নামক বটবৃক্ষের জরুরত থাকে সবচেয়ে বেশি। সেই বটবৃক্ষের আজ মহা আকাল।
বটবৃক্ষ নেই বলে সিডর আইলা যখন তখন ছোবল মারে, খরা জরা কালসাপের মত ফণা উঁচিয়ে ভয় দেখায়, ইন্ডিয়ান টেক্টনিক প্লেট ইচ্ছেমত ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের মাঝে থরহরি কম্প জাগায়।
ওসব ভুলিয়ে রাখতে কে বা কারা জাপানিজ ব্লাক পাইন, জুনিপার, চাইনিজ এলম, ফিকাস কিংবা গার্ডেনিয়ার বনসাই আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়। ওদের আমরা দেখি না, কিন্তু ওরা সব কিছুই ঠিক করে দেয়। ওদের অবস্থান আমাদের মস্তিষ্কে, পিটুটারি গ্রন্থিতে, এমনকি শিরা উপশিরায়। আমাদের চোখ দিয়ে ওদের ঠিক করা পাতলুনকে সুন্দর বলি, আমাদের মুখ নিসৃত প্রতিটি কথা হয় ওদের পছন্দ মাফিক।
এখন কিছুটা বুঝি কেন কেউ একজন স্বপ্নের ভিতরে এসে বলেছিল, মানুষ বড় হলে গাছ হয়ে যায়! প্রতিনিয়ত সংসার-নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড শোধন করতে করতে, অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে দিতে, পায়ের নিচ দিয়ে কখন যে শিকড় গজিয়ে যায়, কেউ খেয়াল করে না। এবাদেও আছে দারা-পুত্র পরিবারের স্নেহ ভালোবাসার অমোঘ জাল। সে জাল ছিন্ন করতে পারে এমন মহাজনের দেখা কদাচিৎ মিলে।
আর সেই কি না, শেষ অবধি, আমি আপনি আমরা যারা আম আদমি, বড় হতে হতে গাছ হয়ে যাই। তবে সেই অর্থে গাছও নয়, গাছের বনসাই।