Posts

উপন্যাস

ত্রি-রমনী (পরিচ্ছেদ ১৬)

December 11, 2025

M. Khanam

10
View

শিরিন রাগান্বিতভাবে বলে ওঠে, আপনি ওকে এত সহজে যেতে দিচ্ছেন কেন! আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না! আপনার কি মনে হয় আমি একজন নারী হয়ে এমন সেনসিটিভ বিষয়ে মিথ্যা কথা বলব! 

ডক্টর শিরিন আপনি শান্ত হন। এখানে বসুন। 

এই জানোয়ারটা যদি পালিয়ে যায়! স্যার, আপনি সার্জন হোসাইনকে এখনই ডাকুন। তার জবানবন্দি আসার সাথে সাথে এই জানোয়ারটাকে পুলিশের হাতে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন! ওয়াসিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিরিনের দিকে তাকায়। 

ডীন অফিসের বাহিরেই জারিন আর তকী দাঁড়িয়ে  আছে। উসমান বের হওয়ার সাথে সাথে জারিন ওকে টেনে এক কর্নারে নিয়ে যায়। কি হয়েছে কি! 

উসমান নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে কিছু বলে না। 

আরে কিছু বলছো না কেন! এমন মারজিয়ার মত তাকিয়ে আছো এখন! 

মারজিয়ার নামটা শুনতেই উসমানের চোখটা নড়ে ওঠে। মনটা হু হু করে ওঠে তার। মৃদুস্বরে বলে, ওরা আমাকে জেলে দিয়ে দিবে। 

কিহ? 

ওই মারজিয়া হোসাইন আমাকে জেলে পাঠিয়ে দিবে। ও এমনিতেই আমাকে দেখতে পারে না। এমন একখানা অভিযোগের পর ও আমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে—

জারিন বুঝতে না পেরে তকীর দিকে তাকায়। তকী উসমানের কাধে হাত দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, যা শুনলাম—এসব কি সত্যি? 

উসমান বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তকীর দিকে তাকায়৷ তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে তকীর উদ্ভুত বোধ হয়। 

তকী আশ্বাসের সুরে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। 

উসমান করুন কণ্ঠে বলে, এরচেয়ে তো আমি আফ্রিকাতেই ভাল ছিলাম। বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলতাম, আধপেট খেতাম, ময়লা পানিতে গোসল করতাম—অন্তত সেখানে সবাই আমাকে ভাল বাসত। কোন দুঃখে দেশে ফিরতে গেলাম! 

জারিন ওয়াসিমের রুমের দিকে তাকিয়ে বলে, ওই মহিলাটা কি করছে! 

উসমান মাথা নাড়ে যে সে জানে না। 

খানিক বাদে মারজিয়া ব্যাগ গুছিয়ে তার কেবিন থেকে বের হয়ে আসে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। করিডোরে আসতেই উসমানের সাথে চোখাচোখি হয় তার। চোখে চোখ পড়তেই উসমানের বুকটা ধুক করে ওঠে। মারজিয়া ধীর পায়ে তাদের দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। 

এরই মাঝে ডীন অফিস থেকে স্বশব্দে দরজা খুলে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বের হয় শিরিন। করিডোরে মারজিয়াকে আসতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। 

চিৎকার করে বলে, মারজিয়া, ইউ বিচ! 

করিডোরের সকলে থেমে তার দিকে তাকায়। মারজিয়ার চেহারাটা সবসময়ের মতই নির্বিকার। তাকে মারার উদ্দেশ্যে শিরিন হাত উঠালেই জারিন এসে দ্রুত তার হাত চেপে ধরে তাকে থামায়। 

রাগী সুরে বলে, এগুলো কি ধরনের অসভ্যতা, ডাক্তার শিরিন! আপনি একজন ডাক্তার—ভুলে যাবেন না! 

শিরিন চিৎকার করে বলে, তোকে আমি দেখে নেব! তুই একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকটা মেয়ের এতবড় ক্ষতি করতে পারলি! 

করিডোরে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায়। একে অন্যকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে থাকে। শিরিনের চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে আছে। হিংস্র জন্তুর মত করছে সে। 

জারিন চিৎকার করে বলে, ডাক্তার শিরিন নিজের কেবিনে যান আপনি! 

শিরিন জারিনের দিকে তাকায়। জারিন যে কোনো সাধারন মানুষ না এবং তার সাথে ঝামেলায় না যাওয়াই মঙ্গল এটা শিরিন ভালই বোঝে। করিডোরের সকলের দিকে তাকিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে তাই সেখানে থেকে চলে যায়। ভাবে মারজিয়াকে পরে দেখে নিবে। 

জারিন উদ্বিগ্নকণ্ঠে মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, কি করেছো তুমি?

মারজিয়া নির্বিকার চোখে তাকায়। বলে, মানুষ হওয়ার কর্তব্য পালন করেছি। 

জারিন আর তকী বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে একজন আরেকজনকে দেখে। মারজিয়া মৃদু হেসে ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। 

সে চলে গেলে দূরে দাঁড়িয়ে  থাকা উসমান এগিয়ে আসে। বলে, কি বলল?

জারিন বলে, আমি ডীনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। দ্রুত পায়ে ডীনের কেবিনে যায়। 

ওয়াসিম চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায় শুয়ে শুয়ে একখানা সিগারেট হাতে ধোঁয়া ছাড়ছেন। দেখে কোনো বি-গ্রেড সিনেমার খলনায়কের মত লাগছে তাকে। 

জারিন বলে, ডাক্তার শিরিনের কি হল হঠাৎ! মারজিয়াকে যা তা বলে মারতে যাচ্ছিলো! হচ্ছেটা কি চার তলায়! 

ওয়াসিম খুবই বিরক্তির ভাব করে মুখ থেকে একখানা আওয়াজ করে। সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে জারিনকে বসতে ইশারা করে। 

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, এই মহিলাটা বোকা নাকি! একটু থেমে পাশ থেকে একখানা কাগজ জারিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, বুঝলে জারিন, নারীরা সুন্দর হলে যতটা না সমস্যা, তার চেয়েও বেশি সমস্যা পুরুষ মানুষ সুন্দর হলে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার আগের মত চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে থাকে ওয়াসিম। 

জারিন কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই তার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়। হোয়াট দ্যা–

ধীরে অফিসের দরজাটা লাগিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসে জারিন। বাহিরেই উৎসুকভাবে দাঁড়িয়ে  আছে উসমান। জারিন বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকায়। 

জারিন, তকী ও উসমান জারিনের কেবিনে বসে আছে। উসমানের চোখে-মুখে বিস্ময়, যেন দুই যোগ দুই এর উত্তর কি তাও সে মিলাতে পারছে না। কি একটা ভেবে বলে, তুমি বলতে চাচ্ছো, সার্জন হোসাইন, যে জয়েনিংয়ের তারিখ থেকে আমার পেছনে পরে আছে, সেই মারজিয়া হোসাইন—আমার পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে? 

জারিন মাথা নাড়ে, হুম। সকালে ডীন আসার সাথে সাথে ও দেখা করতে গিয়েছিলো। লিখিত অভিযোগের সাথে নিজের জবানবন্দি দিয়ে এসেছে। ডীন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছিলো না বলে তার উপরও রেগে ছিল। 

তকী বিস্মিত কণ্ঠে বলে, এই জন্যই আজ ডীনের সাথে ওমন করছিলো ও? 

জারিন মাথা নাড়ে। আমি অভিযোগটার একটা ছবি তুলে এনেছি। দেখো। জারিন মোবাইলে ছবিটা দেখায়। 

উসমান বিস্মিত চোখে অভিযোগপত্রটা দেখতে থাকে। বলে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। 

জারিন উসমানের কাধে হাত দিয়ে আশ্বাস দেয়। বলে, হয়ত তুমি বললে আমরা কেউই বিশ্বাস করতাম না আর শিরিনকেই সত্যি ভেবে নিতাম। তোমাকে এমন একখানা অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে হয়েছে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। উসমান এক দৃষ্টিতে অভিযোগপত্রটা দেখতে থাকে। 

দরজায় টোকা দিয়ে একজন নারী স্টাফ ভেতরে আসে। বলে, উসমান, ডীন স্যার তোমাকে ডাকছে। 

নিঃশব্দে দরজা খুলে ডীনের রুমে ঢোকে উসমান। ওয়াসিম খানিকটা বিরক্তির সাথে উসমানের দিকে তাকায়। ইশারায় বসতে বলে। উসমান একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসে। 

ওয়াসিম বলে, আজ সকাল ঠিক সাতটা চারে সার্জন হোসাইন আমার সাথে দেখা করতে আসেন, এই অভিযোগ পত্রখানা নিয়ে। তার ভাষ্যমতে, তুমি ডাক্তার শিরিনের দ্বারা যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছো। 

উসমানের চোখদুটো নড়ে ওঠে। 

কমিটি ডেকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমাকে বেশ করে বলে। কিন্তু আমি তাকে মানা করে দেই যে ভুক্তভুগী নিজে অভিযোগ না করলে এইরকম সেনসিটিভ বিষয়ে আমি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তাই তোমাকে আমি ডাকলাম যে এই বিষয়ে তুমি কি করতে চাও? তুমি কি ডাক্তার শিরিনের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাও? 

কথা শেষ করে ওয়াসিম মৃদু শব্দ করে হাসে। উসমান নির্বিকার চোখে তার দিকে তাকায়। 

ওয়াসিম বলে, এমন একটা বিষয় কে বিশ্বাস করবে বল তো? তাই যা করবে ভেবে-চিন্তে। ভবিষ্যতে এসব বিষয়ের ফলাফল কি হবে সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে। 

উসমানের চোখে-মুখে কোনো অনুভূতি নেয়। সে মৃদুস্বরে বলে, আমি কোনো পদক্ষেপ নিতে চাই না। 

গুড। এখন তোমার কাজ হল মারজিয়াকে জানানো যে আমি তোমাকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলেছি কিন্তু তুমি নিতে চাচ্ছো না। এটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত। ঠিক আছে? 

উসমান মাথা নীচু করে মাথা নাড়ে। নিঃশব্দে চেয়ারটা সড়িয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।

Comments

    Please login to post comment. Login