সাদিক বসার ঘরে টিভিতে সংবাদ দেখছে। টিভির স্ক্রিন দুই ভাগ হয়ে আছে, এক ভাগে সংবাদ পাঠিকা ও অন্যভাগে একজন পুরুষ সাংবাদিককে দেখা যায়।
পুরুষ সাংবাদিকটি বলেন, ঐশী, বাসাবো এলাকার এই কনস্ট্রাকশন সাইটের পাশে আজ দুপুরেই এই ঘটনাটি ঘটে। হাসি আক্তার তার আট বছরের মেয়েকে নিয়ে এখান থেকে দুই-তিন গলি ছেড়ে একটা বাসায় নতুন উঠেছিলেন—
ঝাপসা করে দেওয়া ঘটনাটির সিসিটিভি ফুটেজ দেখা যায়।
আজ দুপুরে যখন তিনি এখান থেকে যাচ্ছিলেন, তখন সেই পুরুষটি এখানে আসে এবং তাদের ভেতর বাকবিতণ্ডা হয়। যার জের ধরে তাদের ভেতর কিছুটা হাতাহাতিও হয়। দুপুরের সময় থাকায়, রাস্তায় মানুষ ছিল না বললেই চলে। হাতাহাতির এক পর্যায়ে হাসি আক্তারকে জোরে ধাক্কা দিলে তিনি এখানকার ইটের উপর পরে যায়। যার কারনে তার মাথা ফেটে তখনই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে পুরুষটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এখানে এখনও রক্তের চিহ্ন বর্তমান আছে। হাসি আক্তারের মেয়ে আট বছরের সায়মা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে লোকটিকে চিহ্নিত করেছে যে এই লোকটি, মজনু সর্দার তার বাবা।
সংবাদ পাঠিকা বলে, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মওদুদ। দুই ভাগ থাকা স্ক্রিনটা এক হয়ে শুধুমাত্র সংবাদ পাঠিকাকে দেখা যায়। দর্শক, এ পর্যায়ে আমরা চলে যাব আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ অমির কাছে। যিনি বর্তমানে অল ফ্যামিলি হাসপাতালে আছেন যেখানে হাসি আক্তারের অপারেশনটি হচ্ছে। স্ক্রিন আবার ভাগ হয়ে এক পাশে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক হাতে একজন সাংবাদিককে দেখা যায়। অমি, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?
কিছুটা নিরবতার পর অমি বলে, জী, ঐশী। বর্তমানে আমি অল ফ্যামিলি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে আছি। ভেতরে হাসি আক্তারের অপারেশন চলছে। তার অপারেশনটি করছে দেশের নামকরা নিউরোসার্জন মারজিয়া হোসাইন। এখন পর্যন্ত সার্জন হোসাইনের সাথে কথা বলার সুযোগ আমাদের হয় নি। তবে এখানকার ডীন নিউরোসার্জন ওয়াসিম জামানের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে হাসি আক্তারের অবস্থা বেশ সোচনীয়। তারা সম্পূর্ণ চেষ্টা করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
সাদিক টিভির দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তার সাথে ডাকে, মিলি, এই মিলি, কোথায় তুমি? এদিকে আসো।
মিলি রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে। হ্যাঁ, বল?
টিভিতে মারজুর ব্যাপারে বলছে।
কি বলছে? মিলি এগিয়ে এসে সাদিকের পাশে বসে টিভির দিকে তাকায়। তখনও সংবাদ চলছে।
সাদিক হাত দিয়ে টিভির দিকে ইশারা করে বলে, ওই যে বাসাবোতে যে মেয়েটাকে মেরেছে, ওই মেয়ের অপারেশনটা মারজু করছে। ওদের ডীন বলল মেয়েটার অবস্থা ভাল না। বাঁচবে না মনে হচ্ছে।
এভাবে বল না। মিলি দুশ্চিন্তামাখা চোখে টিভির দিকে তাকায়।
জারিন নিজের কেবিনে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। দরজায় টোকা পড়লে উঠে ঘুম চোখে বলে, কাম ইন। ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে। জারিন তাকিয়ে তাকে দেখে সাংবাদিক শেখ অমি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। অমি? আসো।
অমি রুমে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে। কি অবস্থা?
চলছে— কফি খাবে?
খাওয়া যায়।
জারিন টেলিফোনটা কানের সাথে লাগিয়ে কফির জন্য বলে। কিছুক্ষণের ভেতরই একজন স্টাফ জারিনের কেবিনে দুই কাপ কফি ও সামান্য নাস্তা দিয়ে যায়। জারিন কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলে, বাচ্চাটা কোথায় আছে এখন?
বসের এনজিও ওর দায়িত্ব নিয়েছে।
তাহলে তো ওর একটা গতি হয়েই যাবে।
বস তো হাসি আক্তারের চিকিৎসার খরচ চালাবে বলেছিলো কিন্তু তোমাদের ডীন বলল চ্যারিটি প্রোসেসে গেলেও একই সময় লাগবে, কোনো তফাৎ হবে না। অ্যান্ড হি ওয়াজ ভেরি ইন্টারেস্টেড টু টেইক ইট অন হিম।
জারিন হাসে। বলে, লোকটা খুব চালু। সে জানে পারসা হাসান একবার যে কেইসে হাত দেয় সেটা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট হয়ে যায়, ফ্রী মিডিয়া কভারেজ পাবে। কোটি টাকার প্রোমোশন কিভাবে লাখ টাকায় করতে হয় তা আমাদের ডীনকে দেখে শেখা উচিৎ।
অমি জারিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বলে, বস খুব করে চাচ্ছিলো তুমি এই অপারেশনটা কর। করলে না কেন?
জারিন হাসে। আমার সিডিউল প্যাকড। আর সত্যি বলতে আমি ওতটা আগ্রহী ছিলাম না। মারজিয়া তো আছে— যেকোন অপারেশন করার জন্য সে সবসময় প্রস্তুত।
ডাক্তারদের উপর আমাদের জীবন নির্ভর করে। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি খুবই অনাগ্রহী এই পেশাটাকে নিয়ে।
জারিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, অমি, পৃথিবীতে তিন ধরনের ডাক্তার আছে। এক, যারা টাকার জন্য ডাক্তারি করে— যেমন, আমাদের ডীন। দুই, যারা মানুষের সেবা করতে চায়— যেমন, সার্জন মারজিয়া হোসাইন। আর তিন, যারা এই জন্য ডাক্তারি করে কারন অন্য কোনো কর্মক্ষেত্রে আইনতভাবে ছুড়ি-কাচি দিয়ে মানুষ কাটা যায় না। জারিন হাসতে থাকে। দিস কাইন্ড অব অপারেশনস আরেন্ট ফান ফর মি। আর যে কাজে মজা পাচ্ছি না সেটা করে লাভ কি, বল?
অমি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে জারিনকে দেখতে থাকে।
অমির গম্ভীর মুখোভঙ্গির দিকে তাকিয়ে জারিন বলে, মারজিয়া যদি আমার মত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল কোনো পরিবারের মেয়ে হত তাহলে হয়ত সে কোনো সরকারি হাসপাতালের সার্জন হত। যেখানে সে ছিন্নমূল মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করতে পারত। কিন্তু হাস্যকর বিষয় কি জানো? এরকম মানসিকতার মানুষরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেই জন্মায়। যেখানে পরিবারের ভাগ্য বদলানোর জন্য তাদের অল-ফ্যামিলি হাসপাতালের মত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়। কণ্ঠটা খানিকটা নাটকীয় করে বলে, এখানে শুধু টাকার পূজা করা হয়।
অমি কিছুক্ষণ জারিনের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, এই কথাগুলো বস আসলে তাকেও বলো। তার খুব ভাল লাগবে।
জারিনের মুখের হাসিটা খানিকটা দুশ্চিন্তায় রূপ নেয়। পারসা আসবে?
হুম—কফির জন্য ধন্যবাদ। আসি। বিদায় জানিয়ে জারিনের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে অমি।
করিডোরে আসতেই তাকে দেখে ছুটে আসে উসমান। হাসিমুখে বলে, আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। ডীন স্যার আপনাকে খুঁজছে।
অমি হাসি মুখে বলে, সার্জন জারিনের কেবিনে ছিলাম।
আপনি অপারেশনটা দেখতে চান?
সম্ভব সেটা?
অবশ্যই। পাশের বেঞ্চে বসা ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে বলে, তবে ফুটেজ নিতে পারবেন না।
অমি পেছনে ফিরে ক্যামেরাম্যানকে ওখানেই থাকার জন্য ইশারা করে। চলুন তাহলে।
দুইজন হেঁটে একখানা অন্ধকার রুমে ঢোকে সেখান থেকে একখানা সিঁড়ি বেয়ে অপারেশন থিয়েটারের উপরে গ্যালারী মতন জায়গাটাতে যায়। ওয়াসিম আগে থেকেই সেখানে বসে অপারেশনটা দেখছে। ওয়াসিম হাসি মুখে এগিয়ে এসে হাত মেলায় অমির সাথে। বলে, রক্তটক্ততে সমস্যা হবে না তো?
অমি হেসে বলে, আমি ক্রাইম রিপোর্টার। এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্থ। বরং আমাদের যা দেখতে হয় তার চেয়ে এটা সাজানো-গোছানোই থাকার কথা।
ওয়াসিম হাসে। দুইজন চেয়ারে বসে স্ক্রিনে এবং সরাসরি অপারেশনটা হতে দেখে। উসমান আগ্রহের চোখে দেখতে থাকে।
ওয়াসিম একবার উসমানের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখতে চাইলে চুপচাপ বসে পড় ওখানে। উসমান সাথে সাথে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে। ওয়াসিম অমির দিকে তাকিয়ে বলে, শেখ সাহেব আপনি কফি বা কিছু খাবেন?
না, মাত্রই সার্জন জারিনের রুমে কফি খেয়ে এলাম। কিছু খাব না। সকলে মনোযোগ দিয়ে অপারেশনটা দেখতে থাকে।