আমরা তখন অনেক ছোট। সেই সময় বোনের শ্বশুর বাড়িতে অনেক ভেড়া ছিল। তখন অনেক চারণভূমি ছিল। এক পাল ভেড়া সারা দিন বাইরে চরে বেড়াত। সন্ধেবেলায় কখনও কখনও ভেড়া আনতে বড়দের সাথে গিয়েছি। খুব ছোট হওয়ায় ফেরার সময় ভেড়ার পিঠে চড়িয়ে দিয়েছে। একটু পর নেমে পড়েছি। ভেড়ার শরীরে অনেক লোম। সেসবে ইলিবিলি কিলিকিলি করতাম।
অনেক আগে ভেড়া নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। হঠাৎ সেই সিনেমার কথা মনে আসলো। অনেক চেষ্টা করে সেটার নিশানা খুঁজে পেলাম। ১৯৬৭ সালে নির্মিত সেই সিনেমার নাম 'Far From the Madding Crowd', লেখক Thomas Hardy এর লেখা একই নামের গল্প থেকে নির্মিত। নায়ক Gabriel Oak কে সর্বস্বান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষ (ভিলেন) ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেয়। নায়কের ভেড়ার পাল ভয় পেয়ে উঁচু পাহাড়ের চুড়া থেকে লাফ দেয়। নায়ক অনেক কষ্ট করে ভেড়াগুলোকে সুস্থ করে তোলে। খুব ছোটবেলায় দেখা। ভেড়ার দলের ঐ অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোহেলহোর বিখ্যাত উপন্যাস The Alchemist এ এক স্বপ্নবাজ বালক সান্টিয়াগোর আখ্যান লিখেছেন। সান্টিয়াগো মূলত ভেড়ার রাখাল, খুব সাধারণ এক বালক, কিন্তু সে স্বাধীন স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। সান্টিয়াগোর বাবা তাকে পুরোহিত বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণের জন্য মিশরের পিরামিডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং পথেপথে আত্ম-আবিষ্কার ও জীবনের মূলমন্ত্র খুঁজে পেতে চায়।
২।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে স্রষ্টার প্রতিনিধির প্রথম পেশা ছিল ভেড়া চরানো। ই*হুদি ধর্ম (Judaism) অনুসারে মোজেস [মূলত মুসা (আঃ)] রাখাল ছিলেন। ই*হুদি ধর্মে রাখাল জীবনকে নবুয়তের প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
খ্রিস্ট ধর্ম মোতাবেক David [মূলত দাউদ (আঃ)] তাঁর ভেড়ার পালকে রক্ষা করতে সিংহ ভালুকের সাথে যুদ্ধ করেছেন। যিশু [মূলত ঈসা (আঃ)] I am the Good Shepherd নামে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। আর তাঁর অনুসারীরা মূলত sheep (ভেড়া), তিনি তাঁদের পথ প্রদর্শক।
গৌতম বুদ্ধ নিজে রাখাল ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বহু উপদেশে পশুপালনের উপমা আছে-যেখানে বলা হয়, রাখাল যেমন গরুকে পথ দেখায়, তেমনি মানুষকে চিত্ত নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
হিন্দু ধর্মে কৃষ্ণ গোপাল ও গোবিন্দ রূপে গরুর রাখাল ছিলেন। হিন্দু ধর্মে গরুর বিশেষ গুরুত্ব এসেছে কৃষ্ণের এই রূপ থেকে।
ইসলাম ধর্মে প্রায় সকল নবী ও রাসুল ব্যক্তিগত জীবনে রাখাল ছিলেন। আমাদের প্রিয় রসুল (সাঃ) নিজেও মেষ চরাতেন।নিজেদের চরাতেন, এমনকি অন্যের ভেড়া চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
একজন রাখালকে হতে হয় ধৈর্যশীল, বিনয়ী ও দায়িত্বশীল। ভেড়া এক দিক থেকে অন্যদিকে ছুটতে চায়, সহজে পথ হারিয়ে ফেলে অথচ নিজেরা অত্যন্ত দুর্বল। এরকম একটি পশুশ্রেণীকে দেখভাল করতে প্রকৃত নেতৃত্ব দেয়ার গুণ থাকতে হয়। ভেড়াকে শাসন নয়, করতে হয় পরিচর্যা।
৩।
মানুষ ভেড়ার চেয়ে বুদ্ধিমান। সে জন্মগতভাবে স্বাধীন চেতনায় বিশ্বাসী। কেউ তাঁকে শাসন/শোষণ করতে চাইলে সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সর্ব শক্তি দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। অথচ সেই মানুষকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে দাস করে রাখা যায়। ভালোবাসার এমনই শক্তি।
সহী বুখারি ও মুসলিম শরীফে একটি হাদিসে বলা হয়েছে।
"তোমাদের প্রত্যেকেই রাখাল, এবং প্রত্যেকেই তার পালের জন্য দায়িত্বশীল।”
৪।
আমরা সবাই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প জানি । মজা করার জন্য রাখাল প্রায়শই বলতো, বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে। গ্রামবাসী তাঁকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে আসলে সে হাসিতে ফেটে পড়ত। এরপর সত্যি যেদিন বাঘ আসে, সেদিন কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। এর একটি বিপরীত বয়ানও আছে, যা খুব একটা প্রচলিত নয়। রাখাল জানতো, একদিন না একদিন বাঘ আসবেই। তাই ভয় পেয়ে মাঝে মাঝেই বলত, বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে।
কবি আল মাহমুদ 'মিথ্যাবাদী রাখাল' নামে কবিতা লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন -
"আমরা তো সেই
মিথ্যাবাদীর খুলির ওপর রোদ চমকাতে দেখে এসেছি। আর
দেখেছি সকল সত্যবাদীদের পঙ্গপালের মতো পালাতে"
আমরা এসে পড়েছি সত্যিকার এক মিথ্যাবাদী রাখালের যুগে। আমাদের বদনে-মননে, সোশাল মিডিয়ায়, সর্বত্র মিথ্যার ছড়াছড়ি। এখন মিথ্যাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে সে অন্যকে ঘায়েল করে। একই অস্ত্র তাকেও ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে।
6
View