তুচ্ছ লুডু খেলাও সে অর্থে তুচ্ছ নয়। গুরুজনরা বলে থাকেন, মানুষ তার নিজের চিন্তা-চেতনা কিংবা ইচ্ছে-খায়েশ খুব বেশী সময় চাপা দিয়ে রাখতে পারেনা। একসময় ছাই চাপা আগুনের মত সেটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। সে অনলে অনেকে পুড়ে ছারখার হয়, অনেকে আবার সে আগুনে আলুপোড়াও খায়।
ছাত্রজীবনে পরীক্ষার আগে আগে সিনেমার ভূত অদ্ভূত ভাবে চাগিয়ে উঠত। এর সাথে টুয়েন্টি নাইন খেলার উপর মহব্বতের নহর বইত। শুরুটা হত অনেকটা এভাবে। দুপুরে ডাইনিং এ লান্চ সেরে একলগে রুমে ফেরার সময় একজন খানিকটা খুজলায়ে দিত। উত্তরে আরেক জন হয়ত পরীক্ষার কথা বলে বসত। তার সে কথা শোনার পর তৃতীয় আরেক জন ঠেস মেরে দিত।খুব পড়ুয়া হয়েছ,মামুর বেটা। এরপর আর কোন কথা থাকেনা। কিছুক্ষণ খেলার টার্গেট নিয়ে বসে পড়তাম। এরপর সেই আসর কখন রাতের খাবারের সময়ে পৌছে যেত কারও খেয়াল থাকতো না। ডাইনিং বন্ধ হওয়ার শেষ কলে রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং এ গিয়ে হাজির হতাম।খাওয়ার পরে সম্বিৎ কিছুটা ফিরলেও টানা টুয়েন্টি নাইন খেলার ধকলে ম্যাড়ম্যাড়ে শরীরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসতো, ‘পড়াশোনা করতে করতে জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো’।
পরক্ষনেই পরীক্ষায় ফেলের ভয় মনকে প্রায় গ্রাস করতো। মনে মনে টুয়েন্টি নাইন এর কাছে মাফ ও দোয়া চেয়ে নিতাম। পরের দিন সকাল থেকে সিরিয়াস হওয়ার পণ করে পরীক্ষার আগে শেষ মুভিটা দেখতে বসে পড়তাম। আমির-শাহরুখ-সালমান কিংবা হলিউডের ব্লকবাস্টার নতুন সিনেমা থাকলে সেটা দেখার পর শুরু হতো উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা। আমাদের সেই টুয়েন্টি নাইন বা সিনেমা না দেখার ওয়াদা ইজরাইল-ফিলিস্তিনের শান্তি চুক্তির মত টেকসই ও মজবুত হত। এত মজবুত হত যে, দিন কয়েক পর ইজরাইল যেমন নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর, তেমনি টুয়েন্টি নাইন ও সিনেমাও আমাদের দুর্বল হ্রদয়ে হানা দিতে থাকে। আপনারা জানেন, সেই আক্রমণের ফলাফল। ফিলিস্তিনি শিশুর মত আমাদের হৃদয়ের ফুলের মত নরম বাধার বিপরীতে টুয়েন্টি নাইন ও সিনেমার ইজ্রাইলী হুঙ্কারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় ছিল না। কুকুরের বাঁকা লেজ সোজা করার চেষ্টার মত আমাদের ওয়াদার মিশন ব্যর্থ হয়ে পড়ত। কম-বেশি আমরা সকলে সেই দিনগুলো ফেলে এসেছি। তখন ওভাবে সময় নষ্ট করে আফসোস হতো, এখন সেই সময় নেই বলে পরিতাপ হয়। ইদানিং কালে হঠাৎ হঠাৎ বন্ধুরা মিলিত হলে এক চিলতে অতীত হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের মনের দুয়ারে হাজির হয়।
সেরকম একদিনের ঘটনা। অতীতের মতই প্রথমে এক বন্ধুর খুঁজলি উঠে। বাকীরাও অনুঘটক হয়ে উঠলে তান্জামের আন্জাম হয়ে যায়। তবে এবার টুয়েন্টি নাইন নয়, আসর বসে মোবাইলে লুডু খেলার। লুডু খেলাও ডিজিটাল রূপে আবির্ভূত হয়েছে। লুডুর বোর্ড না থাকলে সে খেলা হবে না, সেটা এখন সুদূর অতীত। যারা আমাদের নিয়ে খেলিয়ে নিতে চায়, তারা সকল আয়োজন করে রেখেছে। শুধু লুডুর জন্য নয়, সমাজ সংসারের সকল কিছু নিয়ে কেউ কেউ হয়ত আমাদের খেলাছে। আমরাও ইচ্ছেমত খেলে যাচ্ছি। উদ্যোগী সেই বন্ধুর উৎসাহ ও উত্তেজনায় বোঝা যায়, বেশ কিছুদিন ধরে সে খেলাটা উপভোগ করছে। আমরাও মনে মনে মালকোঁচা মেরে নেমে পড়ি।
লুডু খেলায় প্রথম কাজ ছক্কা উঠানো। ছক্কা উঠানোকে স্নাতক পাশের সার্টিফিকেট অর্জনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানে আপনি কিছু অর্জনের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলেন। কিংবা বলা যায় বয়স ১৮ হলে যেমন ভোটের অধিকার জন্মায়, সেরকম কিছু। তখন চাইলে ভোট দিতে পারবেন, মন না চাইলে না।
তবে ছক্কা ওঠা মানে খেলা শুরু হলো মাত্র। গন্তব্য বহু দুরে, ফার ওয়ে টু গো। দানে দানে পয়েন্ট নিয়ে ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ওদিকে মাঠে আছে আরও ৩ জন মারকুটে প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনি এগিয়ে গেলে নির্ঘাত তারা পিছনে পড়ে থাকেন। আর ওদিকে গুটি দিয়ে আপনাকে ল্যাং মেরে ঘরে পাঠানোর নিয়ম আছে এ খেলায়। জীবনের খেলায়ও মানুষ একজন আরেকজনকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যেতে চায়। অনেকেই বৈধতার ধার ধারেন না। নেইমার যেমন পিএসজিতে এসেই ইন্জুরিতে পড়লেন, তখন অন্যদের খেলা দেখা ছাড়া তার কিছুই করার ছিলো না। ঠিক একইভাবে, অন্যরা আপনার গুটি কেটে দিলে আপনার অবস্থাও হবে ইনজুরিতে পড়া নেইমারের মত নৈব নৈব চ । লুডু খেলায় ইন্জুরি থেকে দ্রুত ফিরতে হলে দ্রুত ছক্কা পিটাতে হবে। খেলা থেকে যাতে বাদ পড়তে না হয়, সেজন্য শুধু একটি গুটি পাকানোর চেয়ে ছক্কা মেরে আরও গুটি উঠাতে হবে। বেশি গুটি উঠানো মানে আপনার একটা গুটি কাটা গেলেও খেলা চালিয়ে যেতে পারলেন। একজন সফল ব্যবসায়ী হতে হলে একটা ব্যবসায় সব পুজি না ঢেলে অন্য ব্যবসা চালু করতে হবে। একটাতে ধরা খেলে যাতে পা হড়কে একেবারে না পড়ে যান, তখন অন্য ব্যবসা আপনাকে দেউলিয়া হতে বাঁচাতে পারে। টিকে থাকার একই নিয়ম, হোক সেটা নিজের জীবন, ব্যবসা কিংবা লুডু খেলা।
নিজে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অন্যদের অবস্থানও খেয়াল করতে হবে। কারও গুটি বেশি এগিয়ে গেলে যেভাবে হোক আপনার গুটি রেডি রাখতে হবে। আমাজন স্টাইলে প্যাঁচ মেরে ঘ্যাচ করে আপনাকেও অন্যের গুটি খেয়ে দিতে হবে। এরপর ‘খেলা হবে’ বলে আওয়াজ দিতেই পারেন। ‘মহাকাশে ঘুরতে যাওয়া বেজোস যাতে পৃথিবীতে ফিরতে না পারেন’ বলে হাজারও মানুষ দরখাস্তে দস্তখত করেছেন। দুনিয়ার অন্যতম ধনী, একজন সফল ব্যক্তির উপর মানুষ এত ক্ষ্যাপা কেন? কারণ বেজোসেরা তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দিতার খবর পেলেই সেটার বারোটা বাজিয়ে দেন। হয় সেটারে কিনে নেন, অথবা নিজেরা ঐ ধরণের প্রডাক্ট কম দামে বাজারে ছেড়ে দিয়ে তাদের সর্বনাশ ডেকে আনেন। আপনি সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে আপনার কপালেও বেজোসদ্যের হাতে সর্বশান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। দরখাস্তকারীর হুমকিতে বেজোস পিছু হটেনি, আপনারও পিছু হটার কোন কারন নাই। আপন লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অন্ততপক্ষে যদি দুইটা গুটি পাকিয়ে ফেলতে পারেন তাহলে আর পায় কে!
এসময় নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগবে। যদি সত্যিকারের জীবনে এগিয়ে যেতে পারেন, তাহলে তো কথাই নাই। যে আগে আপনাকে অচল পয়সা মনে করত, সেই আপনার প্রশংসায় মশগুল থাকবে। আগে যে দেখেও না দেখার ভান করে কেটে পড়ত, সেই এখন দুর থেকে সালাম দিয়ে, কাছে এসে কুশালদির খবর নিবে। মানুষের চোখে তখন আপনি কি যে ভাল মানুষ, চিন্তাই করতে পারবেন না। তবে এ সময়টা বেশ ক্রিটিক্যালও। অন্য কেউ নিজের একটা গুটি খেয়ে দিলে খাদে পড়ে যেতে পারেন। ভালো খেলতে না পেরে এবারের ইউরো থেকে বাদ পড়ে এমবাপ্পেরা। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ জেতার স্মৃতিরোমন্থন করেও মনে সান্তনা মিলছেনা। শেষ সময়ে নিজের গুটি কাটা পড়লে ঐরকম লাগতেই পারে।
ছক্কা-ডিফেন্স-এ্যাটাকিং কৌশলে লুডু খেলে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। জীবনের খেলারও একই নিয়ম। ওরকম সাবধানী মুডে থাকলে সফলতা আসবেই আসবে। তখন বেকার ও অথর্ব বলে যে পাড়া-পড়শি মুখ-ঝামটি দিতো, তাঁদের চওড়া হাসি ম্যাট্রিক না সনাতনি স্কেলে মাপলে জুতসই হবে, সেটাও ভুলে যেতে পারেন। তবে শুধু সফল হলেই হয় না, হতে হয় মানবিক। যে জয়ের মধ্যে সততা নেই, যে সফলতার মধ্যে ভালোবাসার ছোঁয়া নেই, সেটা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। ট্রয়ের যুদ্ধে জয়লাভ করেও মানুষের হৃদয়ে একিলিসের জায়গা হয়নি, মানুষের মণিকোঠায় বেঁচে আছেন হেক্টর। বাস্তব জীবনের হিসেব যদিও গ্রিক মিথলজির ক্যালকুলেটরে নির্ণয় করা যায় না।
মানুষের জীবন লুডু বা গ্রিক মিথলজি, কোনটার সাথে যায় না। অন্যদের পিছনে ফেলে নিজে এগিয়ে গেলে শুধু একজন মানুষ সফল হয়। মানুষ তার চেয়েও বেশি সফল হতে পারে সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে। এতে যেমন কেউ পিছন থেকে টেনে ধরতে পারেনা, তেমনি পারেনা সামনে থেকে চোখ-রাঙ্গাতেও।
নওগাঁ, জুন ২০২১