পোস্টস

গল্প

অথচ তোমার নামটাই জানা হলো না

১০ জুন ২০২৪

রফিকুল ইসলাম বাদল

(আমি জানতাম আকাশ নোয়া তোমার ঘাটেই)

 

সখ্যতা গড়ে ওঠা রাত আর বকুল- জবা’র পসরা আঙিনা ও তোমার পুরনো সময়- আমারও ছেলেবেলা। উঠোন ঘেষে বা’দিকের বেড়ে ওঠা আম গাছ আর ছোট্ট দিঘি বুড়োবুড়ির মতন এখনও নিরব বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলে। আমি জানি, কতবার কতসময় নির্বিঘ্নে কেটে যেত তেতুল তলায়। তেতুল চুরিতে ওস্তাদ তোমার চূড়ির শব্দে ধরা পড়ত 'গেও ভূত' আর আমি! কোথাও হাওয়া হয়ে যেতাম, নৌকোর পাল দুলিয়ে এপাড় থেকে ওপাড় অথবা ওপাড় থেকে এপাড়। সুবিধারা অসুবিধায় পড়েনি বলেই ইঁদুরগুলি দেদারসে বই কেটে যেত, তোমার বই পড়ার চেয়েও দ্রুত। বেড়াল তার পরিবারসহ দুধ খেয়ে যেত যা প্রতি রাতে তোমার জন্যই বরাদ্দ ছিল। তুমি এর সবই জানতে আর বেড়াল-ইঁদুরের সাপ নেউলে ভনিতাও তোমার কাছে ধরা পড়ত। বেড়ালের কাছে ইঁদুর, তোমার কাছে বেড়াল আর বড়দের কাছে  তুমি আদরের চূড়ান্ত অর্জনে বড় হতে লাগলে। তোমার হাত, তোমার পা-ও বড় হতে লাগল। আর ধার করা তেতুল চুরির হাত কিংবা পালিয়ে বেড়ানো পা যুগল আমার চেয়েও দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করল কিংবা ঘোড়ার চেয়েও....। তোমার কাজল চোখ খুঁজতে শুরু করল প্রতিটি সময়, যা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করতে উদ্ব্যত। তোমার নাক আরও সুউচ্চ ও প্রখর হয়ে আমার ঘামের কিংবা আমার শ্বাসের সাথে মিলে যেত। তুমি বড় হতে লাগলে  প্রতিটি মুহুর্তে সতর্কতার সাথে। তোমার চুল আমার নদীর মত বড় হতে লাগল, চুলের রঙ আমার মেঘের চেয়েও কালো;  আরও ভয়ংকর কালো হয়ে আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলতে শুরু করল গহীন রাতের বনে… যেখানে জোনাকি পোকা, তোমার চোখ, চোখের পিউপিল আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আবার আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। সেই বড় হওয়া চোখে তুমি জানতে চাওনি  আমার নদীর নাম 'তুমি', আমার মেঘের নাম 'তুমি' কিংবা তোমার চুল আমার ছোট নদী!!

 

তুমি তারপরও বড় হতে লাগলে। তোমার হাত- চোখ-নাক আজ পর্যন্ত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমার ঘর থেকে, আমার স্কুল থেকে, আমার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। তারপরও তোমার ভ্রু উল্টো চাঁদের চিকন ফালির মতন আরও সরু হতে শুরু করল, নাচতে শুরু করল জোয়ার-ভাটায় অথচ তোমার কান হরিণীর মতন চঞ্চল আর ঠোট (দুটি) শিশির ভেজা পাতার মতন দ্রুত আরো দ্রুত কোমল ও শীতের রোদের মতন উজ্জ্বল হতে শুরু করে আমাকে হরিনী তাড়াতে নিয়ে চলল- বিস্তৃত বন, বিস্তৃত মাঠ-নদী কিংবা অরণ্য আরাধ্য সাধনায়…। আমার ভয় হতে লাগল কিন্তু আমি আনন্দ পেলাম। তোমার একটু একটু বড় হওয়া আমাকে বাতাসের মতন হালকা ও রঙীন করে তুলত। আমার সাদা কালো চোখেও তোমার ঠোট, তোমার কথা বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করে তোমার ঘর আঙিনায়, আঙিনা পেড়িয়ে আমগাছের ডাল ডিঙ্গুতে যেয়েই দিঘির জলে টুপ করে ছন্দ তোলে। তারপর দিঘি পেরুল, তেতুল ডালে নূপুর তুলে মাঠে তারপর বন…। তারপর বন পেড়িয়ে ওইতো ওখানটায়, যেখানে প্রতি বছর মেলা বসত। মেলার সবচেয়ে প্রিয় সেই নাগর দোলায় দোলবার কতো স্মৃতি তোমাকে বড় করতে লাগল। প্রতিটি ঘোরাতেই তোমার এদিক সেদিক বেড়ে ওঠা দেহ আমাকে শিহরিত করে আবারও ঘোরা আবারও করে- আমাকে শিহরিত করে! কিন্তু চড়কার সেই ঘোরার শব্দে তোমার কান সচকিত হয়, হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার হাফ ডান সিলেবাসেও তাল কাটে, তোমার শরীরেও প্রথম চিঠির মতন ভাজ পড়ে, তুমি খামে গুজে আড়াল হও। আর আমি প্রসারিত হাতে তোমায় ধরতে যাই - সেই মেলায় নাগর দোলার ঘূর্ণিতে। কিংবা প্রতিটি ঘোরার মধ্যে। আটবার..আট ঘূর্ণন এক আধুলি, দুয়াধুলি করে হয়তো পাঁচ টাকা!! আমাকে তৃপ্ত করে না কিছুতেই। আমার শুধু চড়তে ইচ্ছে হয়- তোমার বড় হওয়া হাতের সাথে, চোখের সাথে, পায়ের সাথে। কানে কানে বলতে ইচ্ছে হয়, ভালো করে ধরে বসো নইলে চড়কা থেকে ছিটকে পড়বে কিংবা বেয়ারা চুলটাকে সামলাও কিংবা তোমার ঠোট আমার গালে চিমটি কাটুক।

 

তবুও তুমি বড় হতে লাগলে আরও বড়। যেখানে আমার হাত ক্রমাগত ছোট হতে থাকে। আমার কন্ঠ আমাকে প্রতারিত করে কিংবা কিছু বলা থেকে বিরত থাকে; যেখানে তোমার ভাজ করা চিঠি আমার হাত ফোসকে যায়, খোলা হয়না...। তবুও তোমার বড় হওয়া, আমার দেয়ালের মানিপ্লান্টের মতন ও তোমার উঠোনের এক কোণে মাচায় বেড়ে উঠা লাউ ডগার মতন হয়তোবা।

 

এখন যৌবনে…

 

তোমার দিকে চোখ মেলতে আমার ভয় হয়, কিন্তু ভালো লাগে! ভালো লাগে যখন তোমার গালে টোল পড়ে, তুমি হাসো, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়। আর তোমার দেহ আমার পৃথিবীকে কাপিয়ে তোলে ভূকম্পিত হয়, সোনামিতে ভেঙ্গে পড়ে আমার পাঁজরের কয়েকটি হাড়, প্লাবিত হয় হাড়ের ভিতরে সযত্নে তুলে রাখা আমার দেহ ঘড়ি। সময় জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি তোমার হাতে হাত রাখি, ভেসে থাকি মেঘ হয়ে, দিঘির জলে শাপলা হই, সাতার কাটি। তারপর হাটতে শুরু করি। তোমার পিছু আমার ছুটে চলা ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত হয় একসময় অথচ তারই পাশে সময় ছিল! সময়ের চেয়েও দ্রুত চলা আমায় একসময় তুলোর মতন ভেসে বেড়ান মেঘ বলে পরিচয় দিতে হয়! তোমার কাছে, তোমার জানালার কাছে কিংবা ফুল তোলা নকশী করা কাঁথায়! যখন তুমি ঘুম যাও।
 

-'যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভোলে না মোরে' -  আমি আবৃতি করি তারপরও তোমার ঘুম ভাঙে না। তোমার  শীতল চোখে তখন আমি কুয়াশায় কুয়াশায় হারাতে বসেছি হয়ত। হয়ত তখনও তোমার ভোর হয়নি কিংবা জেগে আছো। অথচ 'ঘুম' যা, তুমি আমাকে দিয়েছো সেটাই ভাবতে শিখেছি জেগে থাকা। - এই ঘুম এই জেগে থাকা তুমি আর আমি কিংবা তুমি আর অন্যকেউ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সকালের কড়া রোদ তোমার ঘুম ভাঙ্গায়। জ্বালাও-পোড়াও চোখে তোমার তখনও এলোমেলো চলাচল আমাকে বিভ্রান্ত করে, এখনও করে বরাবরই করে। আমি বিভ্রান্ত হই কিন্তু পাশের বাড়ির ডানপিটে ছেলেটি কখনই  হয়নি। সে তোমাকে দেখিয়ে বেড়িয়েছে সাত তারার তিমির, তিন প্রহরের বিল, হাওয়ার রাত - তেত্রিশ বছর পর্যন্ত তখনও আমি আট বছর আগের দিনগুলো নিয়ে খেলা করি, স্বপ্ন দেখি, ছবি আঁকি, গান গাই কিংবা কবিতা লিখি।

 

আট বছর আগে তুমি পঁচিশে ছিলে। তোমার চুল হাত পা তখনও মানিপ্ল্যান্টের মতন আমার গা বেয়ে চলতে থাকত সাবলিল গতিসীমায়। চুরি করা রোদেলা এক সকাল তোমাকে প্রসারিত করলো অন্য কারো হাত ধরে বেড়ে ওঠায়। হয়ত তুমি কিংবা পাশের বাড়ির ডানপিটে ছেলেটি আমাকে মুক্তি দিলে!! যদিও তার চেয়ে আমার ছেলেবেলা তোমার কাছাকাছি ছিল, তার চেয়েও কাছে ছিল তোমার বেড়াল। আর আমি! বিড়ালের চেয়েও বেশি তোমার গা ঘেঁষে থাকতে চাইতাম। তখন তোমার এলার্জি হয়নি কিংবা এলাচের চেয়েও তীব্রভাবে আমাকে প্রত্যাখান করনি হয়ত। আমি ঘুড়ির চেয়েও আরো উচুতে আরোও উচুতে তোমাকে মেলে ধরতে পরতাম তখনও। যেখানে তোমাকে ডানা মনে হতো। পরীর চেয়েও সুন্দর ডানায় তুমি আমার ঘুড়ি মেলে ধরতে। লাল-সাদা-হলুদ-নীল মাঞ্জা সূতায় তোমার ভানা কেটে গেল বছর তিনেক আগে। তুমি উড়তে চললে, তুমি ভাসতে চললে তারও চেয়ে তুমি ক্রমাগত নিচে নামতে লাগলে । তোমার ডানা ঝুলে পড়ল ইলেক্ট্রিসিটির তারে, সেখানে দাঁড়িয়ে গেল ৩ তলা ডুপ্লেস্ করা লাল ইটের দালান, ৩য় তলায় চিলেকোঠা। চিলে কোঠায় দাড়িয়ে গেল তালপাতার সিপাহী ও অন্যান্যরা… যাদের সাথে তুমি, পাশের বাড়ির ছেলের মতই এক দেয়ালে ঠেসে ধরলে আমায়। সেই পুরনো মানিপ্ল্যান আজ আর দেখা যায় না তারও চেয়ে তোমার লাউ ডগার মাচা অতি পুরনো বলেই’ তুমি আধুনিক হলে আর আমিও তোমার উল্টোদিকের কোন এক দালানের ৩য় তলার বারান্দায় বসে ভাবতে চাইলাম- রাত মন্দ হয়নি। কিন্তু এখন গভীর রাত!! উত্তরের জানালার বাহুময় কপাট মেলে ধরলে এখন চোখ ঝুলন্ড ইলেক্ট্রসিটির তার প্যাচিয়ে থাকা তোমার ডানায় আর আটকে থাকেনা! কতক ইটের প্রানহীন ঘুমন্ত দালানের বহির্গায়েও আটকে যায়। দিনের আলোতে যেখানে আমার মত বেঁচে থাকার দাম্ভিকতা সেখানে এখন মাঝ রাত। ফোঁড়ন কাটার মত করে সময় আর আমাকে কাপিয়ে চলে যাওয়া দানবাকৃতি ট্রাক, নিঃশব্দ তোমাকে এবং শব্দকে, এ নগরীতে প্রতিষ্ঠিত করাতে পারে না কোনভাবেই। উন্মুক্ত হয়ত কিছু জানালা আমার মতন হয়ত আলো ধরে রাখাই সারা। অন্যকোন অর্থ কিংবা জানালার ওপারে চার প্রকোষ্ঠে নিছক ঘুমহীন কারো অস্তিত্ব এ মূহুর্তে আমাকে ভাবতে শেখায়- সে অসুস্থ কিংবা কামুক কিংবা তোমার আমার সম্পর্কের মধ্যরাত। রাত এখনও মন্দ নয় কিন্তু এখন গভীর রাত। চোরদের জন্য এই সময়টা হয়ত মঙ্গল, হয়ত অমঙ্গল। এখনও নাইট গার্ডদের হাক-ডাকা, কুকুরের ডাকের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও বেশ জোরালো। আমার এই বারান্দায় আসা হয়ত তোমাকে ভাবা তারচেয়েও অর্থহীন এই চেয়ে থাকা কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি হয়ত তোমারও। ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ কোন বাচ্চার চিৎকার কিংবা বেড়ালের কান্না কোন সত্য শব্দটি আমাকে শব্দের অস্তিত্বকে জানান দিলো আমার পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু ধরা সহজ হয় রাতের ঘুমন্ত নগরী আর তোমাকেও। সেই একই চিত্র। গতকাল রাতের কিংবা আগামীকাল রাতেরও; যা দিনের আলোতে সহস্র প্রানে নিক্ষিপ্ত হলেও আলোকিত হয় না।

 

এখন গভীর রাত কিন্তু সকাল নয়। আমার চোখ ব্যালকনির বাহিরে ঝুলে পড়ে ঠিক তোমার ডানার পাশাপাশি। আমার কানও বিভ্রান্ত টেপকলের শব্দে খাড়া হয়। আমার মাথা এলোমেলো চিন্তায় তোমাকে ভাবে, দাঁড় করাতে চায় অক্ষর বিন্যাসে! অথচ তুমি আগাগোড়াই নামহীন ও খুবই অবিন্যস্ত রয়ে গেলে। তেত্রিশ বছরেই তোমাকে মৃত ঘোষণা করতে উদ্যোত আমার হাত আমাকে চল্লিশে দাঁড় করিয়ে দেয় যদিও এখন রাত চারটা। এই রাত চারটায় আমি আমার মুক্তি খুঁজি চল্লিশ পেরিয়ে যেখানে তুমি সকাল হবে আর আমি ঘুমতে যাবো।

 

শেষ সিগারেটের ফিল্টারের কঠিন টান, অন্ধকারে আগুনে দমকে ওঠা মুখাগ্নি!আমাকে মনে করিয়ে দেয়- সময় নেই, সময় নেই অথচ তোমার নামটাই জানা হলো না!!!