সেদিন গোধূলি লগ্ন। সাগরের বুকে সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহুর্তে একটা লালাভ স্বর্গীয় আলো অনেকটা সময় ধরে আমাদেরকে মুগ্ধ করে রাখে। সেন্ট মার্টিনের সৈকত থেকে দেখা সেই সূর্যাস্তটা স্মৃতিপটে বহুদিন অমলিন থাকবে। হয়ত এমন মোহময় মুহুর্তই রবি ঠাকুরের অন্তরে জাগিয়েছিল প্রেম। এমনও হতে পারে, কোন এক গোধূলি বেলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেছেনঃ
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”
২০ ডিসেম্বর ২০২৩। পৌষ মাসের শুরুর এই সময়টায় প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। ঘোরাঘুরির জন্য বেশ উপযুক্ত সময়। সেন্ট মার্টিন যাব বলে ভোর সাড়ে ৫ টায় উঠে পড়ি। সাড়ে ৬ টায় একটা মাইক্রোবাস হোটেলের নিচে এসে হাজির হয়। সেটাতে চেপে ঊষার রক্তিম আভায় মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে যেতে থাকি আমরা। আমার পরিবারের ৪ জন ও ভায়রার পরিবারের ৪ জন মিলে এই টুরের আমরা। ছোট বড় পাহাড়ের সারিকে বামে রেখে, ডানে থাকা সুবিশাল সাগর ও সাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদমন্দ বাতাস গায়ে মেখে মেখে এগিয়ে যাই আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যে হিমছড়ি, ইনানি, পাটুয়ারটেক পিছনে ফেলে টেকনাফের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। টেকনাফে পৌছার পরেও যথেষ্ট সময় আছে বলে পথের ধারের একটা হোটেলে নাস্তা সেরে নেই। কিন্তু সেই নাস্তা করতে গিয়ে অল্পের জন্যই লঞ্চ মিস হয়ে যাচ্ছিলো। শাহরুখ-কাজলের দিল ওয়ালের ট্রেনের সেই শেষ দৃশ্যের মত একটা অবস্থায় পড়ি। দৌড়ে গিয়ে লঞ্চে উঠার সাথে সাথেই লঞ্চের পাইলট ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দেয়। নাস্তার জন্য যেখানে থেমেছিলাম, সেখান থেকে লঞ্চ জেটিতে যেতে ১০ মিনিট লাগবে বললেও প্রায় ৩০ মিনিট লেগে যায়। আরেকটু হলেই কয়েক বছর ধরে সেন্টমার্টিন যাওয়ার শখের আলঝালিখাস্তা হয়ে যেত। অবশ্য এই ঘটনার জন্য দায়ী মাইক্রো ড্রাইভার ছিল বেশ নির্বিকার।
কিয়ারি ক্রুজ এন্ড ডাইন। আড়াই ঘণ্টা নীল জলে ভেসে ভেসে সেন্ট মার্টিনের জেটিতে এসে যখন যাত্রা শেষ করলো সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে অনেকটাই হেলে পড়েছে। তার আগে সাগরের বিশালতা দেখে দেখে, এক দল সাদা গাংচিলের উড়াউড়ি উপভোগ করতে করতে সময় কেটে যায়। জেটিতে একসাথে ৪ টা শিপ ভিড়েছে। যাত্রীদের অনেকেই আজকেই আবার ফিরে যাবেন। সেকারণেই কিনা জানিনা, দ্বীপে নামার জন্য বেশ হুড়াহুড়ি লেগে গেলো। অবশ্য এমন হুড়াহুড়ি করার অভ্যাস আমাদের মজ্জাগত বিষয়। জেটিতে ভেড়ার আগেই অল্প বয়সী কয়েকটি ছেলে লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠে যায়। ছোটবেলায় বালাশি ঘাট থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ বাহাদুরাবাদ ঘাটে লাগার আগেই একদল কুলি ব্যাগ ঘাটে পৌঁছে দেয়ার জন্য জেঁকে ধরত। এখানেও সেই দৃশ্য চোখে পড়ল। আমরা অবশ্য নিজেরাই নিজেদের ব্যাগ-বোচকা সাথে নিয়ে লঞ্চ থেকে নামতে থাকি। অন্যদের মত আমরাও বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা চর সেন্ট মার্টিনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যাই।
ধারণা করা হয়, হাজার বছর আগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছিল টেকনাফ পেনিনসুলার অংশ। টেকনাফের তিন দিকে পানি। শুধু একদিক থেকে মূল স্থলভাগের সাথে সংযুক্ত। সেই অর্থে এটি একটি পেনিনসুলা বা উপদ্বীপ। এরপর সময়ের আবর্তনে টেকনাফ থেকে পৃথক হয়ে যায়। মাদকের একটা বড় অংশ টেকনাফ হয়ে দেশের মধ্যে ঢুকে। সেই বিবেচনায় সেন্ট মার্টিন টেকনাফ থেকে সরে গয়ে মন্দ হয়নি। মাদক চালানের অপবাদ থেকে মুক্ত রয়েছে। মজা করে এটা বলাই যায়। অষ্টাদশ শতকে প্রথম বারের মত আরব বণিকদের নজরে পড়লে তাঁরা এই দ্বীপটির নাম দেন ‘জাজিরা’। ‘জাজিরা’ই পরবর্তীতে স্থানীয়দের মুখে মুখে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক নিজের নামে দ্বীপটির নামকরণ করেন। অফিসিয়ালি এর নাম হয়ে যায় ‘সেন্ট মার্টিন’দ্বীপ। মাত্র ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ (coral island)। অনেকে আবার একে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নামেও ডাকে।
জেটি থেকে নামলেই সেন্ট মার্টিনের একমাত্র বাজার। অনেকগুলো লঞ্চ আসাতে সরু রাস্তায় জ্যাম লেগে যায়। আমরা দুইটা অটো নিয়ে বুকিং দেয়া রিসোর্টে উঠে পড়ি। দ্বীপটির চারিদিক জুড়ে অনেক হোটেল রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। ২০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে পর্যটকদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। এটা পর্যটন শিল্পের জন্য সুখবর হলেও এর ফলে দ্বীপের মূল আকর্ষন প্রবালের বৈশিষ্টে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
লাগেজ রুমে চালান করে দিয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি। এক মিনিটের পথও না। এরপর আছে শুধু সাগর, নীল জল, প্রবাল ও বাতাসের খেলা। সাগরের কাছে গেলে মানুষ কেমন শিশুদের মত হয়ে যায়। আমরাও বাদ যাইনা। আমরা দেরি না করে কিছু সময়ের জন্য সেখানে নিজেদের বিলিয়ে দেই। হাঁটি, লাফাই, দৌড়াই, শুয়ে পড়ি, নানা রঙে ঢং করি। বালুর সাগরের জলে নিজেদের ডুবিয়ে রাখি। জলে নেমে যাওয়ার আগে বেশ কিছু ছবি তুলি। সাফিন, সাফিয়া, জুঁই ও শিহাবের ছোটাছুটি দেখতে বেশ উপভোগ্য লাগে। বিশাল সাগরকে সামনে থেকে দেখলে মানুষ বুঝতে পারে সে কত ক্ষুদ্র। মানুষকে তাই বারবার সাগরের কাছে যাওয়া উচিৎ।হয়ত সেকারণেই কিনা, আমাদের বারবার সাগরের কাছে আসা হয়।
সূর্যটা প্রতিদিন নিয়ম করে পূব আকাশে উঠে, একই নিয়মে পশ্চিমে ডুবে যায়। ডুবে গেলে সারাটা রাত সে থাকে কোথায়? ছোটবেলায় এই প্রশ্নটা খুব করে মাথায় ঘুরত। আমি খুব বোকা সেটা অন্যেরা ধরে ফেলবে বলে কাউকে কখনও প্রশ্নটা করা হয়নি। শেষে উত্তরটা পেয়ে গেলাম সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম উপকূলে। সন্ধ্যার আগে আগে দুপুরের খাবার খেয়ে যাই পশ্চিমের সৈকতে। পশ্চিমের সৈকতটা বেশ প্রসারিত ও জনপ্রিয়। এই সৈকতে অনেক টুরিস্টের আনাগোনা। সেখানে পৌঁছেই দেখি সূর্যটা ধীরে ধীরে সাগরের পানিতে স্নানের জন্য নেমে যাচ্ছে। লোহা গরম করলে যেমন লাল হয়ে যায়, তেমনি ডুবতে থাকা সূর্য থেকে গনগনে লাল আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এমন মায়াময় গোধূলির দেখা কালেভদ্রে পাওয়া যায়।
সেই কবে শুনেছিলাম, হুমায়ুন আহমেদের একটা রিসোর্ট আছে সেন্ট মার্টিনে। খানিকটা হাঁটতেই ‘সমুদ্র বিলাস’ এর দেখা মিলে যায়। আমার বিশ্বাস সাকিব আল হাসান কিংবা শাকিব খান নয়, বেঁচে থাকলে এখনও হুমায়ুন আহমেদই হতেন সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা। ‘সমুদ্র বিলাস’ এর গেটে মানুষের ভিড়, ছবি তোলার হিড়িক সেই বিশ্বাসকে আরও মজবুত করে। ভিড় কমে গেলে আমরাও সমুদ্র বিলাসের সামনে গিয়ে ছবি তুলি। ফেরার সময় শুধু এই ভাবনাটা কাজ করে, একটা মানুষের পছন্দ কতটা স্মার্ট, একই সাথে কতটা সুন্দরের পূজারি হলে এরকম একটি জায়াগায় রিসোর্ট করার সাহস দেখাতে পারেন। সময় গড়িয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসলে রাতের খাবারের জন্য বাজারের দিকে এগিয়ে যাই। এইদিকটায় বেশ কয়েকটা রেস্তোরা আছে। রাতের খাবারের আইটেমের মধ্যে ফিশ বারবিকিউ খুব জনপ্রিয়। আমরাও একটা বড় সাইজের রূপচাঁদার বারবিকিউ অর্ডার করে অপেক্ষা করতে থাকি।
পরের দিন সকাল। দুইটা অটো নিয়ে ছেড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সেন্ট মার্টিনের উত্তর প্রান্ত থেকে একটা সরু স্ট্রিপের স্থলভাগ চলে গেছে। জোয়ারের সময় একটা অংশ ডুবে গেলে স্থলভাগের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ মূল ভূখণ্ড সেন্ট মার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য ভাবে বললে বলা যায়, ছিঁড়ে যায়। সেই থেকে এর নাম ছেড়াদ্বীপ বা ছেড়াদিয়া। অটো ছেড়ে দিয়ে হেটে হেটে একটা দ্বীপে যাই। এরপরেও আছে আরও দুইটা দ্বীপ। আমাদের ফেরার তাড়া থাকায় সেখান থেকে ফিরে আসি।
প্রকৃতির সৌন্দর্যের মায়ার বাধন থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। হয়ত বাংলার এমন অপরূপ সুন্দর রূপ দেখেই জীবনানন্দ লিখে গেছেনঃ
“নীরবে পা ধোয় জলে একবার – তারপর দূরে
নিরুদ্দেশে
চলে যায় কুয়াশায় – তবু জানি কোনদিন পৃথিবীর
ভিড়ে
হারাব না তারে আমি – সে যে আছে আমার এ বাংলার
তীরে।”
বিকেল ৩ টায় লঞ্চ ছেড়ে দিলে ফিরে আসি টেকনাফ হয়ে কক্সবাজারে। আসার পরেও সেন্ট মার্টিনে কাটিয়ে আসা সুন্দর স্মৃতির হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে আমাদের। ফিরতে ফিরতে প্রিয় কবি জীবনানন্দের কোথা আবারও মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় তাঁর লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে’। আমাদেরও ইচ্ছে আছে আবার কোন একদিন ফিরে আসবো এই দারুচিনি দ্বীপে।
(সমাপ্ত)