ফার্মগেটে সিএনজি নিয়েছি। গন্তব্য বাগেরহাট। সিএনজি নিয়ে অবশ্য অত দূরে যাব না। বাবুবাজার ২য় চীন-মৈত্রী সেতুর গোড়ায় নামব। ঠিক তখনই ঝমঝমিয়ে এমন বৃষ্টি নামল, সাথে ভয়ংকর বজ্রপাত। লোকজন দৌড়াচ্ছে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। এবং তার চেয়ে দ্রুততার সাথে সড়কে জ্যাম লেগে যায়। কারন কি? বৃষ্টিতে ট্রাফিক পুলিশ সড়ক থেকে একটু সরলেই "সকলের আগে সকলে যাওয়ার" প্রতিযোগিতায় সচরাচর এমনটাই ঘটে। এ কারনে বরাবরই ট্রাফিক পুলিশের চাকরিটা আমার খুব কঠিন মনে হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা সড়কে দাড়িয়ে, সিগনাল মানতে না চাওয়া হাজারও গাড়িকে সিগনাল পার করে দেওয়া, ভয়ংকর ধৈর্য্যের কাজ বৈকি। পুলিশ সদস্যরা কত অবলীলায় সেই কাজ করেন।
সিএনজির পাইলট বুদ্ধি করে বিভিন্ন পথ বদলিয়ে বাবুবাজার চীন-মৈত্রী সেতুর গোড়ায় নামিয়ে দেয়। জ্যামের শহরে গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর এই টেকনিক অনায়াসে মেসির ড্রিবলিং এর সাথে তুলনা করা যায়। আশ্চর্য হই, "বৃষ্টিতে নামিয়ে দিলে ভিজে যাব", "ছাতা আছে কিনা" এমনও টেনশন করছিলো সিএনজির ড্রাইভার। দুনিয়াতে "মানুষ মানুষের জন্য" এমন তাত্ত্বিক জিনিস শাহবাগ জাদুঘরে চলে গেছে, এমন দৃশ্যের পর তা মানতে পারি না। এই যে একজন খেটে খাওয়া মানুষ। সিএনজি চালাতে কত ঘাটে-অঘাটে কতজন যে হয়রানি করে। সড়কে কিংবা অন্য কোথাও কত বিশৃংখলার পরেও, তার মানবতায় এতটুকু মরচে পড়েনি। অন্যদিকে পুরো যাত্রায় তার কথা আমি এতটুকু ভাবিনি।
পদ্মা থেকে যেমন ইলিশ আসে, এখান থেকেও ইলিশ সেখানে যায়। আমি ইলিশ পরিবহন নামের বাসের কথা বলছি। ঢাকা টু মাওয়ার জন্য এর সার্ভিস ভালো। বৃষ্টির মাত্রা কমে গেলেও একদম বন্ধ হয়নি। ইলিশের ভরসায় বেশিক্ষন দাড়ালাম না। অন্য একটা বাসে উঠি। বাসে যাত্রি খুব কম, হঠাৎ বৃষ্টি এর কারন হয়ত। কতক্ষণে মাওয়া ঘাটে পৌছুতে পারব, সে টেনশন হচ্ছিলো। তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে সে টেনশন একেবারে উধাও। আমি ভুলে গেছিলাম, এ শহরে প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। এক কথায় বলা যায়,ঢাকায় বাস করে হাজারও রাবনের গুষ্টি। বাবুবাজার সেতু পার হওয়ার আগেই বাস "বাসফুল"। সিনেমা হল দর্শকে পরিপুর্ন হলে বলে হাউজফুল। বাস যাত্রীতে পুর্ন হলে “বাসফুল” বলা যেতেই পারে।
যা হোক, বাস এগিয়ে চলে। ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল, যাত্রী নামাতে তাড়াতাড়ি করার জন্য ধমক, অন্য কারনেও কন্ডাকটর/হেলপারের ২/৪ টা স্লাং ভাষা শোনা, আমাদের কানের জন্য সহনীয় হয়ে গেছে। এমনকি নারী যাত্রী রেপ-হত্যাও "গা-সওয়া" হয়ে যাচ্ছে ইদানিং। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নিজের ঘাড়ে পড়ার আগ পর্যন্ত কোন কিছুই কোন ব্যাপার মন করিনা আমরা। এসব ভাবনা মাথায় আসাতে ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-হেল্পার কে খেয়াল করা শুরু করলাম। ৩ জনের চেহারাই বেশ রুক্ষ। ভাড়া নিয়ে কিছু উত্তপ্ত বাৎ-চিত হবে, ধরেই নিয়েছি। একজন মানুষকে ভাববেন একরকম, দেখবেন সে আরেক রকম। গহীনে খোঁজ নিলে সেই মানুষে পাবেন একেবারে ভিন্ন রকম। মানুষ এক আজিব চিজ। এখানেও উল্টা ঘটনা ঘটল। ভাড়া উঠানোর সময় পরিবেশ একদম স্বাভাবিক থাকলো। এমনকি যাত্রী নামানোর সময় যথেষ্ট সময়ও দিচ্ছে তারা। বাস হতে নামতে মহিলা যাত্রীর অতিরিক্ত সময়ও ৩ জনের কাউকে বিচলিত করলো না। ৩৫ কিলোমিটার জার্নি কোন রকম বৈচিত্র ছাড়াই কেটে গেল। এই জার্নির সেটাই সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বিষয় ছিল।
স্পিড বোটে ১২ মিনিটে পদ্মা পার হলাম। বেশ খিদে লেগে গেছে। ঘাটের হোটেলে বসে পদ্মার মচমচে ইলিশ ভাজি দিয়ে ইচ্ছে মত খেয়ে নিলাম। স্পীড বোটের গতির মতই পদ্মা সেতুর কাজও দ্রুত গতিতে চলছে। আগে যখন এ নদী পার হতাম মানুষের মুখে সরকারের সমালোচনার খৈ ফুটতো। আর এখন একসাথে পার হওয়া মানুষগুলোর মুখে বেশ আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখি। রোজাদার ব্যক্তি ইফতারের ঠিক আগে যেমন খুশি থাকে, তাদেরকে দেখে তেমনি মনে হল। সামনে রমজান মাস, এসময় এরচেয়ে জুতসই উদাহরণ পেলাম না। ওপারে আগের কাওড়াকান্দি ঘাট আর নাই। বিলুপ্ত হওয়ারই কথা। মাওয়ার নাম ডাক এত বেশি ছিল, মানুষ কাওড়াকান্দির নাম কদাচিৎ মুখে নিত।
শরীয়তপুরের কাঠালবাড়ি ঘাট থেকে পদ্মা সেতুর এপ্রোচে কানেকশন হয়ে গেছে। সে সড়ক ধরে ভাংগার পথে এগোতেই উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ল। একই সাথে সড়ক, সেতু/কালভার্ট, ফ্লাইওভার নির্মান চলছে। ভাংগা-গোপালগন্জ-নওয়াপাড়া সড়কের পাশ দিয়ে রেলপথ নির্মান কাজও শেষ পথে। এ সকল প্রকল্প সমাপ্ত হলে বরিশাল, খুলনা ও প্রস্তাবিত পদ্মা বিভাগের মানুষের জীবন-মান একধাপে অনেক উপরে উঠে যাবে। মধুমতি নদী থেকে খুলনার নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানি নেওয়ার কাজ চলছে। খুলনা ওয়াশা সওজের জমির তলদেশ দিয়ে পানির লাইন বসানোর অনুমতি নেওয়ার সময় আমি বাগেরহাটে কর্মরত ছিলাম।
কেউ কোন জায়গায় একবার পা ফেললেই সে জায়গার জন্য মায়া তৈরি হয়ে যায়। আর সে কথাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার জন্য কিনা, বাগেরহাটের সীমানায় ঢোকা মাত্রই অনুভূতি গুলো বদলাতে থাকে। নিজের এলাকায় ফিরে আসলাম, এমনটাই মনে হচ্ছিল। যে সড়ক দিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে চলছি, সে সড়ক নিয়ে কত না অম্ল-মধুর স্মৃতি রয়েছে। রাস্তার লোকজনের বড়জোর সড়ক নিয়েই কিছু স্মৃতি থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। সড়কগুলোকেই বেশি আপন মনে হচ্ছিলো। ফলতিতা, ফকিরহাট, নোয়াপাড়া, ষাটগম্বুজের সাথে কতদিন দেখা সাক্ষাত নাই। শেষে সাবেক অফিসে ঢুকে আরও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। অফিসের রুম, বাসা, ক্যাম্পাস সবাই আমার সাক্ষাতের অপেক্ষায় ছিলো। আর অফিস কলিগ, স্টাফদের আচরনে বিহবল হয়ে পড়ি। দৌড়িয়ে আসে। সালাম জানায়।কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। কেউ কেউ বুকেও জড়িয়ে ধরে।
সামান্য একজন মানুষ আমি, নিজের অনিচ্ছায় প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দুরের এই বাগেরহাটে এসেছিলাম। ছিলাম মাত্র ১ বছর ৮ মাস। তবুও এত ভালবাসা, এতটা মায়া সহ্য করতে পারি না। বড় অস্বস্তিতে ভূগি। কাল যখন রংপুর ফেরার পথ ধরব, মায়ার অদৃশ্য শিকলটা পিছনে বারবার টেনে ধরবে যে।
বাগেরহাট, মে ২০১৮