ডাকপিয়ন

১১ জুন ২০২৪

নাঈম গাজী

সাল ১৯৮৯,বয়স আমার ২১, পারিবারিক অবস্থা এবং কোনো চাকরি না পেয়ে ডাকপিয়নের চাকরি টা পাই মামার মাধ্যমে। প্রতিদিন সাইকেলের টিং টং শব্দে এক প্রকার বিরক্ত হয়ে পড়লাম। তাও সেদিন একজনের চিঠি অন্যজন কে দিয়ে কি যে বিপদে পড়লাম।

 যাই হোক এই সাইকেল এই চিঠি  একই চাকরি আর ভালো লাগে না। আর কোনো অপশন নেই সে কারনে চাকরি টা ছেড়ে দিচ্ছি না, এই বিরক্তিবোধ টা কাটানোর জন্য আমি সবার চিঠি পড়তে লাগলাম কি আর করব এই মনকে একটু আনন্দ দেওয়া।

 মীনা নামের ঠিকানায় একটা চিঠি খুললাম চিঠি পড়ে বুঝলাম তাদের মধ্যে প্রেম। আমি চিঠি পড়ে বেশ মজাই নিতাম। আমি সবসময় তাদের চিঠি পড়তাম। যে ঠিকানা থেকে আসতো তার নাম ছিল শহিদ। ঠিকানা মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ আমি চিনি বয়স বারোতে বাবার সাথে ফুফির বাসায় গিয়েছিলাম ওখানে ফুফির বাসা।

 ওদের চিঠি পড়ে মনে অনেক ইচ্ছে প্রেম করবার, আবার নিজেই বললাম আমাকে দিয়ে আবার প্রেম। মীনা সাইকেলের টিং টং শব্দ শুনে দৌড়ে চলে আসতো একটুও দেরি করতো না, প্রতি সপ্তাহে চিঠি আসতো। মীনা আমাকে ভাইয়া সম্বোধন করিল আরো কত কি আবদার আমি যেন সবার আগে তার চিঠি দিয়ে আসি। এভাবে চলছিল প্রায় সাত মাস। 

হঠাৎ শহিদের ওখান থেকে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলো,এই কয়দিন তাদের মধ্যে অভিমান ছিল। আমি ভাবলাম হয়তো ঝগড়া।  কিন্তু মীনার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় মীনা জিজ্ঞাসা করল এতোদিন চিঠি নিয়ে আসেন  নাই কেন?  আমি বললাম না আসিলে দেবো কি? সে বলল আসে নাই মানে? সে গম্ভীরতায় চেয়ে রইল। আমি বললাম কোনো চিঠি আসে নাই। এমনভাবে মাস কেটে গেল। মীনা অপেক্ষা করতে না পেরে সে চিঠি লিখে আমাকে দিলো পোস্ট করে দিতে। আমি পোস্ট করে দিলাম। কিন্তু কোনো চিঠি আসে নাই। মীনা প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাঠায়তো। তাও একটা চিঠি ও আসতো না।

 শহিদের ব্যাপার টা বুঝতে পারলাম না, আমার এখনো মনে আছে শহিদ বলেছিল আমি আসব এবার তোমাকে বউ সাজিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবো। কিন্তু হঠাৎ শহিদের কি হলো?  মীনার থেকেও আমার চিন্তা বেশি হতে লাগলো। মীনা প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাঠায়। এভাবে কেটে গেল ৬ মাস। 

মীনা এখনো চিঠি পাঠায়। প্রতিউত্তরে কোনো চিঠি আসে না। তার গম্ভীর চেহারা, শুকনো মুখ, চোখে জল, আমি আর দেখতে পারলাম না। এক প্রকার সহ্য হচ্ছিল না। তাই আমি ফুফির বাড়িতে চলে গেলাম ছুটি নিয়ে । শহিদের দেওয়া ঠিকানা মতো তাকে খুজতে বের হলাম। ঠিকানা মতো গিয়ে শুনলাম শহিদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মাথার ভিতর চমকায় উঠল। আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। একদমই মন ভেঙে গেছে। আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন মীনার কি হবে?  জানি না তাদের কতদিনের সম্পর্ক।

 বাড়িতে চলে আসলাম। কাজে যোগ দিলাম। গিয়ে দেখি মীনার দেওয়া শেষ একটা চিঠি ও পোস্ট করে নাই আমি খুলে পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে সর্বশেষ চিঠিতে দেখলাম সে আত্মহত্যা করবে যদি চিঠির উত্তর না দেয়। আমি ভিষণ বিষন্নতায় চলে গেলাম। কি করব, কিভাবে মীনাকে বোঝাবো?  কোনো পথ না পেয়ে  ভাবলাম আমি নিজেই শহিদের জায়গায় গিয়ে চিঠি লিখবো। মীনার জন্য। আর আমি তো তাদের সব চিঠি পড়লাম সব জানা আছে আমার তাদের ব্যাপারে। তাই নিজেই একটা চিঠি লিখে শহিদের ঠিকানা দিয়ে আমার টিং টং শব্দ করা সাইকেল নিয়ে চললাম মীনার বাড়ির দিকে। 

বাড়ির সামনে গিয়ে সাইকেলের টিং টং শব্দ করলাম। কিন্তু আজ সে আসছে না, আর দিন একটু ও দেরি করতো না। খুব ভয় হলো সে আত্মহত্যা করল না তো?  বাড়ির ভিতরে যাবো এমন সময় মীনা এসে হাজির। সে বলল কোনো চিঠি আসছে ভাইয়া?  কেমন রুগ্ন কন্ঠে। আমি তাকে দেখে খুব খুশি হলাম। পরে তারে চিঠিখানা দিলাম সে যে কী খুশি হয়েছে বলে বুঝাতে পারবো না। তারপর থেকে আমি রোজ শহিদের নাম ব্যবহার করে চিঠি দিতাম। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে কি বলব?  কবে নাগাদ এই চিঠি আদান - প্রদান হবে? 
আজ প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো সে আমাকে চিঠি দিচ্ছে আমি ও দিচ্ছি কিন্তু সে জানে না আমি শহিদ নই আমি ডাকপিয়ন।