Posts

প্রবন্ধ

লেখা এবং দেখায়ঃ ভিতর-বাহিরের মুজতবা আলী

June 12, 2024

MIZAN FARABI

172
View

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি লেখক হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টাও। সাহিত্যে তাঁর গল্প বলার ভঙ্গী ও লেখার শৈলী ছিল অনন্য। সৈয়দ মুজতবা আলী অনেকগুলো ভাষা জানার পরেও তিনি শব্দ ব্যবহারে ছিলেন সচেতন। এই নানান ভাষার অভিজ্ঞতাই তাঁকে এনে দিয়েছে সাহিত্যের রসবোধ। অবলীলায় তিনি বিচরণ করেছেন বাংলাসাহিত্যের পথে প্রান্তরে। 
 

সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর লেখায় ভাষার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতেন না বরং সব ভাষার সাহিত্যকে লব্ধ করেই তিনি তুলনা করেছেন এক ভাষার সাহিত্যের সাথে অন্য ভাষার সাহিত্যের। বিভিন্ন ভাষার ভেতরের কথাকে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বাংলা ভাষা নিয়ে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮  সাল থেকেই তিনি বাংলা নিয়ে কাজ করে গেছেন। তিনি বলতেন, "যে ভাষায় সংগ্রামের ইন্ধন নেই, প্রাণের প্রাচুর্য আর সুধা নেই, সেই ভাষায় কোমল-মধুর গান গাওয়া যায় কিন্তু জীবনের কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে বলা যায় না।"  এই বলিষ্ঠ ভাষার কথা বলতে গিয়ে, মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী হলেন পাকিস্তানীদের চিরশত্রু। হলেন দেশান্তরীও। 
 

এই যে সৈয়দ মুজতবা আলী পরবাসে গেলেন এটা ছিল তাঁর জন্য যুগান্তকারী সময় ও উদ্যোগ। পরবাসের এই জীবন তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এনে দিয়েছে খ্যাতি আর খুলে দিয়েছে তার ভেতরের দৃষ্টি। এই অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তিনি মূলত দেখেছেন ও লিখেছেন প্রকৃতি আর বাইরের জীবন। তিনি প্রবাসী হওয়ার পরেই শিখেছেন মানুষের জীবন পড়তে। কৌতুক বলেন আর রসবোধ বলেন উভয়ই তিনি সাহিত্যে প্রকাশ করেছেন সার্থকভাবে। 
 

সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেও। শান্তিনিকেতনে তার যাতায়াত ছিল চোখে পড়ার মতো। শান্তিনিকেতনে তিনি পেয়েছেন জাতীয়তার পাঠ। দেখেছেন হিন্দু-মুসলিম বিভাজনও। এতসবকিছু দেখার পরেও তিনি তা সাহিত্যে প্রকাশ করেন নি কোনভাবে। আঞ্চলিকতা নিয়েও তার প্রবল আগ্রহ-অভিমান ছিল। যখনই কথা বলতেন আঞ্চলিকতার ছোঁয়া পাওয়া যেত তাঁর কথায়। তাঁর মাঝে আঞ্চলিকতার টান থাকলেও তিনি ছিলেন উদার ও বৈশ্বিক মানুষ। সে সময়ে বাংলায় তার মতো অসম্প্রদায়িক মানুষ কমই ছিল বলা যায়। তার ভিতরে ছিল না কোন হিংসা ও রেষারেষি। তিনি দেশপ্রেমেও ছিলেন অবিচল। 

অন্য আরো যে বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর আগ্রহ বা ইচ্ছে ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঘুরে বেড়ানো। তিনি বিশ্বের অলিগলি পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শুধু যে ঘুরে বেড়িয়েছেন তা নয়। করেছেন নিজেকে সমৃদ্ধ, জেনেছেন অজানা এক পৃথিবীকে। এই বিশ্বকে জয়ের মাধ্যমে স্যাটায়ার বা বঙ্গসাহিত্যে তিনি প্রকাশ করেছেন নানা কৌতুকের সঞ্চার করে। রসবোধ জাগিয়ে। তিনি খেলেছেন শব্দের সাথে। নির্মাণ করেছেন সাহিত্যের আলাদা ধারা। সাহিত্যে রম্য ও রসের উপস্থিতি কখনো অতিমাত্রায় করেননি। সবকিছু জেনে-বুঝে তিনি প্রয়োগ করতেন কৌশলে।

তো কথা হলো, বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলী তার নিজের অবস্থান জানান দেন রম্যলেখক হিসেবে। সাহিত্যের যে ক'জন রম্য ও রসবোধ কিংবা নানান কৌতহল জাগিয়ে লিখতেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের কাহিনী ও বিস্তার কিংবা তার গভীরতা ছিল বিচিত্র এবং ব্যাপক। এই যে লেখায় বৈচিত্রতা এনেছেন তার কারণ হলো সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ও বিশ্বকে জানার পরিধি। বিশ্বকে দেখতে গিয়ে তিনি দেখেছেন মানুষের জীবন ও জগৎ। শুনেছেন দেশ-বিদেশে মানুষের নানান গল্প। মুখোমুখি হয়েছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার। এই পটপরিবর্তনই সৈয়দ মুজতবা আলীকে সাহিত্যের জগতে করেছে নানাভাবে বিন্যস্ত ও বহুমাত্রায় নির্মাণ। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট গল্প বলার ভঙ্গী ছিল আলাদা। আর তিনি যে গল্প বা উপন্যাস লিখতেন তা আসলে বলার মতোই। এই গল্পের বাহিরে এসে তিনি যে উপন্যাস রচনা করেছেন তা ছিল শৈল্পিক শব্দের গাঁথুনিতে নির্মাণ। ছিলো আলাদা বাচনভঙ্গি। সাহিত্যের খোশগল্প আর আড্ডা-রসের ভাবছিল তাঁর লেখায়। লেখকের অমর সৃষ্টি "দেশে-বিদেশ'র" মাধ্যমে সুখ্যাতি এনে দিয়েছিল সাহিত্যে। বর্ণালি এই সাহিত্য জগতে তাঁর প্রবেশ হলো এই "দেশে-বিদেশে"  গ্রন্থের মাধ্যমে। এরপর তিনি জলে ডাঙ্গায়, শবনম, বড়বাবু, পঞ্চতন্ত্র, প্রেম ও চতুরঙ্গসহ নানান বইয়ে আবিভূত হয়েছেন পাঠক মহলে। দেশ বিদেশের নানান অভিজ্ঞতায় ভ্রমণ কাহিনী রচনা করে পূর্ণ করেন বাংলাসাহিত্যের ষোলকলা।

সাহিত্যের সৈয়দ মুজতবা আলী এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়েই মানসপটে বেঁচে থাকবেন। তাঁর লেখার স্বীকৃতিতে পান "নরসিংহ দাস পুরস্কার-১৯৪৯" আনন্দ পুরস্কার- ১৯৬১" এবং ২০০৫ সালে পান বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় পুরস্কার "মরণোত্তর একুশে পদক" । তিনি মূলত লিখেছেন সাহিত্যের নানান শাখায়। টিকে থাকার জন্য তাঁর যে সাহিত্যকর্ম কিংবা যে অভিধায় তিনি মানুষের কাছে পৌঁছেছেন তা অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি পাঠকের কাছে হাজির হয়েছেন নানাভাবে, কখনো রম্যলেখক কখনো বা উপন্যাসিক আর কখনো গল্পের মানুষ হিসেবে। আসলে তাঁর বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবনে রয়েছে বিচিত্রসব অর্জন। তাঁর এই জাদুকরী দেখা ও লেখার শক্তি দিয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকমহলে। দেশ-বিদেশে।

Comments

    Please login to post comment. Login