Posts

ভ্রমণ

সোনালী সেতুর শ্যামল ভূমিতে ৭ মাস ১৯ দিন

June 12, 2024

সাজিদ রহমান

Original Author সাজিদ রহমান

119
View

৭ মাস ১৯ দিন সময়টা মহাকালের গণনায় হয়তবা কয়েক মুহুর্ত মাত্র। মৃত্যু-শয্যায় ধুকতে থাকা কোন মানুষের জন্য সেটা আবার অনন্ত কালের মতই। আমার মত সাধারণ মানুষ যারা সময়কে অসামান্য কোন কর্মে পরিনত করতে পারেনা তাদের জন্য ৭ মাস ১৯ দিনই বটে। এরকম নাতিদীর্ঘ একটা সময় শরীয়তপুরে কাটিয়ে দিলাম। 

একবার পা ফেললেই মানুষ সে জায়গার জন্য এক ধরনের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করলে সেটা অনেকগুন হবে সেটাই স্বাভাবিক। গত ৭ মাসের বেশি সময়ে শরীয়তপুরে লাখো পদক্ষেপ ফেলেছি। শহরে, বন্দরে, গরীবের চরে, গ্রামে, গন্জে, নড়িয়ায়, জাজিরায়, গোসাইহাটে, বুড়িরহাটে, আলুবাজারে কিংবা টেনিস লনে। সময় কাটিয়েছি, কাজ করেছি আরও কত নাম না জায়গায়।

প্রকৃতিগত দিক থেকে এ জায়গা খানিকটা ভিন্ন। পুরো জেলাকে কিংবা জেলার সীমানা ধরে বয়ে চলেছে অনেক নদী। আছে পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, কার্তিনাশা, জয়ন্তী, দামুদিয়া, পালং নামের নদীরা। সাথে আছে খাল-বিল, নিচু জলা যা এ জেলাতে ধমনি, শিরা-উপশিরার মত ছড়িয়ে আছে। নদী শরীয়তপুরের জন্য আশির্বাদ, আবার এই নদীর ভাংগন-জ্বালায় পিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। একূল গড়ছে তো অন্য কূলে ভাংগন খেলায় মত্ত এসব নদী।

ঢাকার আশেপাশের অন্য অনেক জেলার মত শরীয়তপুরকেও এক কথায় বলা যায় "বাত্তির নিচে অন্ধকার"। এরজন্য ছোট্ট একটা উদাহরণই যথেষ্ট। আর সেটা হলো শরীয়তপুর সম্ভবত একমাত্র জেলা যার সদর থেকে ঢাকা যাওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম যে  সড়ক তা এখনও ১২ ফুট চওড়াই রয়েছে। এছাড়াও পুরোপুরি শহর হিসেবে বেড়ে উঠতে পারেনি। তাই জেলা শহরের নাগরিক সুবিধার অনেক কিছুই অনুপস্থিত। ১৯৮৪ সালে জেলা হলেও এটি দেশের পিছিয়ে পড়া অন্যতম জেলা। হাতের নাগালে ঢাকা শহর। তবুও যেন ঢাকা অনেক দুরে। কারনটা বোধহয় সেই নদী। দেশের মূল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে শরীয়তপুরের বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে রুপালী ইলিশের উৎস সেই পদ্মা নদী।

২ টা বাড়ির মাঝে আছে হয়ত ১ টি খাল। সকালে ব্রাশ করার সময় ২ বন্ধুতে খাজুরে আলাপ করতে চাইলেও জোরে চিল্লাইতে হয়। কিছুক্ষণ চিল্লাইতে থাকলে গলার স্বর কর্কশ হয়ে যায়। তাই দক্ষিণের মানুষ রোমান্টিক গল্প করলেও নাকি কানে বাজে। এরকমই গল্প করেছিলো দক্ষিন বংগে বাড়ি এক ছোট ভাই। আর আমাদের যাদের বাড়ি "ভাড়া হইসে তিরিশ" এলাকায় তাদের কাছে সে গলার স্বর দক্ষিন আফ্রিকার সেই "ভুভুজেলা"র মত। তবে আমার পূর্ব ধারনা থাকায় তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বরং আমি বরিশাইল্লা কিনা সে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। আমিও সুন্দর করে উত্তর দিয়েছি, ভাই আমি সেই "ভাড়া হইসে তিরিশ" এলাকার মানুষ। মানুষ যদিও মফিজ বলে, নিজে নিজেরে তো অত নিচে নামাতে পারিনা!

এলাকার সাধারণ মানুষ নিশ্চিত ভাবে অসাধারণ। কিন্তু অসাধারণ সেই সাধারণ মানুষদের সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ নেই আমাদের। তাদের প্রতিনিধি হয়ে যারা আমাদের কাছে আসেন তাদের কেউ কেউ ডটডটডট। টেকনিক্যাল কারনে ডটডটের অবতারনা সেটা বুঝতেই পারছেন। তবে পদ্মা সেতু এবং চাঁদপুর-শরীয়তপুরের মাঝে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল হলে এ জেলা হতে পারে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

আমরা রাস্তার মানুষ। কাজ করতে গেলে বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। তার কিছু কিছু মনেও গেঁথে যায়। যেমন অনেকগুলো বাজার অংশে রাস্তায় পানি জমে। পিছনে নিচু জলাশয়, কোদালের ২ টা কোপে সরু নালা করে দিলে পানি বের হয়ে যেতে পারে। এতে রাস্তা নষ্ট হয়না, সরকারি সম্পদ রক্ষা পায়, জনগনও সেবা হতে বন্চিত হয়না। কিন্তু কোদালের সামান্য ২ টা কোপ দেয়া যায় না। এতে সড়ক নষ্ট হয়। আবার সে নষ্ট সড়ক ঠিক করে দেয়ার জন্য তাদের উতলা হতে দেখা যায়। আমি এতে সাধারণ মানুষের কোন দোষ দেখিনা। আমরা যারা সরকারের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করি কিংবা জনপ্রতিনিধিরা হয়তবা জনগনের সেই আস্থা অর্জন করতে পারিনি। 

আরও একটা গল্প বলি। শহর লাগোয়া কীর্তিনাশা নদীর উপর ১টি সেতু নির্মান হবে। আমরা গেছি এলাইনমেন্ট ঠিক করতে। নদীর ওপারে সার্ভে চলছে। এক বয়স্ক কাকু এসে আলাপ পাড়েন। শহরে গিয়ে গ্যান্জাম লাগলে নদীর কারনে তাদের মাইর খেয়ে আসতে হয়। খুব দুঃখ কাকুর। ব্রীজ হয়ে গেলে আর মাইর খেতে হবেনা। বরং ঝটপট পিডানি দিয়ে ব্রীজ হয়ে দ্রুত সরে পড়তে পারবে। একটা ব্রীজ হলে নির্যাতিত একটা গ্রুপ উল্টো নির্যাতন করতে পারবে। এ কম কথা নয়!!! ব্রীজের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে এধরনের বোনাফাইড কারন অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত বটে!!

ঢাকা শহর থেকে শরীয়তপুরের দুরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আরও ৬ টি জেলা শহর আছে। উন্নত বিশ্বের মডেলে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ঐ শহরগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। ওয়েল কানেক্টিভিটি গড়ে তুলতে হবে। পদ্মা সেতু এবং শরীয়তপুর-পদ্মাসেতু এপ্রোচ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শরীয়তপুর হতে ঢাকা পৌঁছুতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট। মিরপুর হতে গুলিস্তান যেতে বর্তমানে ওরকম সময়ই লাগে। পরিকল্পনা করে এগুতে পারলে শরীয়তপুর হতে পারে দেশের অন্যতম শিল্পনগরী। 

 অতুল প্রসাদ সেন (গীতিকার), আব্দুর রাজ্জাক (বঙ্গবন্ধুর সহচর ও জাতীয় নেতা), পুলিন বিহারি দাস (স্বাধীনতা সংগ্রামী) আবু ইসহাক (ঔপন্যাসিক), গীতা দত্ত (বিশিষ্ট গায়িকা), গুরু প্রসাদ সেন (বাংলাদেশের ১ম এমএ পাশ) সহ অসংখ্য গুনীজনের জন্ম এই মাটিতে। দক্ষিন বংগে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে তার সুবাতাসে শরীয়তপুরও আমোদিত হবে। 

শরীয়তপুরে অসাধারন কিছু মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়। সে সুযোগ থেকে এখন বন্চিত। বিদায় কালে শরীয়তপুরবাসী যে ভালোবাসা দিয়েছে তা অতুলনীয়। শরীয়তপুরের সাথে অন্তরের সম্পর্ক কখনো টুটবেনা।

উন্নয়নের জোয়ারে জেগে উঠুক, ভালো থাকুক শরীয়তপুর।

নওগাঁ, অক্টোবর ২০২০

Comments

    Please login to post comment. Login