পোস্টস

গল্প

সুখতত্ত্ব

১৩ জুন ২০২৪

মাহদি হাসান

নাকের সরুপথ বেয়ে একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল মনির মিয়ার ঠোঁটের দেয়ালে। নোনতা স্বাদের অনুভব পেতেই ধড়ফড় করে জেগে উঠলেন তিনি। শরীরের দিকে তাকাতেই দেখলেন সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার। ক্লান্তির দিবস শেষে ইট-কংক্রিটের শহরে রাত নেমেছে। চারিদিকে ভ্যাপসা গরম। উত্তপ্ত হয়ে আছে প্রকৃতির দেহ। গাছের ডালপালাগুলো চুল পরিমাণও নড়ছে না। সারাদিন সূর্যের প্রখর তাপের অত্যাচার সহ্য করা মৃত্তিকা ফুঁসে উঠে জমিয়ে রাখা সকল উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরণীর উদরে। প্রকৃতির এ রুক্ষতায় প্রকৃতির কোলে বসবাস করা মানুষগুলো পোহাচ্ছে আগুনে দগ্ধ হওয়া গরমের যন্ত্রণা। মনির মিয়া পাশ ফিরে তাকালেন। দেখলেন, চেহারায় নির্মলতা আর কোমলতা মেখে পাশেই শুয়ে আছে তার আট বছর বয়সী ছেলে মুসা আর তার স্ত্রী রাজিয়া। তাদের চোখের পাতা একটু পর পরই নড়ছে। তীব্র গরমে তাদেরও যে কষ্ট হচ্ছে, চোখের পাতায় ঘুম আসছে না, মনির মিয়াকে তারা তা বুঝতে দিতে চাইছে না। কিছুক্ষণ আগে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়ে এক টুকরো প্রশান্তির ঘুমে মগ্ন ছিলেন মনির মিয়া। তখন হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে মুসা বলে উঠে, ‘ও মা! গরমের জ্বালায় আর ঘুমাইতে পারি না। বাজানরে কও না কালকাই একটা ফ্যান কিন্না নিয়া আসতে।’

রাজিয়া ছেলের কণ্ঠ নিচু করতে বলে তাকে সতর্ক করেন, ‘আস্তে কথা ক, তোর বাজানের ঘুম ভাইঙ্গা যাইব।’ তারপর ছেলের পাংশু বর্ণ ধারণ করা মুখ দেখে বলেন, ‘আনব বাজান আনব, এই কিস্তিটা শেষ হউক। এরপরে তর বাজানে টাকা উঠাইয়া ফ্যান কিন্না লইয়াইব। আর কয়েকটা দিন কষ্ট কর বাজান।’

এরপর হাতের পাখা দিয়ে ছেলে আর স্বামীকে বাতাস করতে থাকেন। কিন্তু চোখের পাতা আর এক হয় না রাজিয়ার। মনির মিয়াকে নড়াচড়া করতে দেখে ফিসফিস করে ছেলেকে বলেন, ‘চোখ বন্ধ কইরা থাক। তোর বাজান উঠতে পারে।’

গভীর ঘুমের বিভোর হওয়ার মত ভান করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে মুসা। রাজিয়া কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মনির মিয়ার ক্লান্ত, মলিন, শ্রান্ত অবয়বের দিকে। মুক্তোর মত চিকচিক করছে ঘামের ফোঁটাগুলো। রাজিয়ার ইচ্ছে হয় শাড়ীর আচল দিয়ে সন্তর্পণে ঘামের ফোঁটাগুলো মুছে দিতে। কিন্তু প্রশান্তির পরশ বুলানো ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে বিরত থাকেন। মনির মিয়ার নড়াচড়া দেখে তারপর ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকেন।

কিছুক্ষণ আগে মা-ছেলের কথোপকথন না শুনলেও তাদের কষ্ট ঠিকই অনুভব করতে পারেন মনির মিয়া। এই তো গত বছর বস্তির এই ছোট্ট ঘরটাতে টাকা জমিয়ে ফ্যান কিনে এনে লাগিয়েছিলেন। এক বছর যেতে না যেতেই নষ্ট হয়ে গেল। চেয়েছিলেন পুরনোটাই আবার ঠিক করবেন। কিন্তু ঠিক করতেই যা টাকা লাগবে তা থেকে নতুন কেনাই ভাল। গত এক মাস ধরে বাড়তি পরিশ্রম করে টাকা জমাচ্ছেন। ঘরে ফিরছেন গভীর রাত করে। তবুও হাতের ফাঁক গলে টাকা শেষ হয়ে যায়। চড়ামূল্যে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে হাতে যা থাকে তা নিতান্তই অল্প। হঠাৎ করেই কী ভেবে যেন মনির মিয়ার ঠোঁটে ভেসে ওঠে এক চিলতে হাসি। ছেলের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, ‘কাইলকাই তগো লাইগা ফ্যান কিন্না লইয়া আসুম। তগো আর গরমে কষ্ট করা লাগবো না। আইজকা বিকালে যেই ব্যাগটা পাইছি হেইডার মইধ্যে নিশ্চয়ই দামি কিছু আছে।’

২.

বাইরে বাতাস নেই একটুও। নেই একটি পাতারও নড়াচড়া। চাঁদ তবু বিলিয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার আলোক ঝর্ণাধারা। মনির মিয়া আস্তে করে দরজাটা খুলে বাইরে বের হলেন। আকাশের উঠোনে ছড়িয়ে থাকা থালার মতো রুপালী চাঁদ মাটি স্পর্শ করতে চাইছে। সে আলোয় ঘরের সামনের খালি জায়গাটাতে একটি কাঠের টুকরা পেতে বসলেন। তার সামনে রাখলেন বিকেলে পাওয়া সেই বস্তুটি। একটি ভ্যানিটি ব্যাগ! বিকেল বেলা এক ভদ্রমহিলাকে রিকশায় করে বাসায় দিয়ে আসছিলেন মনির মিয়া। তখন মহিলাটি ভুলে তার ভ্যানিটি ব্যাগ তার রিকশায়ই ফেলে যায়। ভদ্রমহিলাকে নামিয়ে দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই মনির মিয়া ব্যাগটি দেখতে পান। অমনি তার পাপী সত্ত্বা জাগ্রত হয়ে তাকে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে–‘ব্যাগটা জলদি লুকিয়ে রাখ ব্যাটা! নিশ্চয়ই দামি কিছু আছে। বড়লোকের ব্যাগ বলে কথা! আর কত গরমে কষ্ট করবি? এটা থেকে যা পাবি সেটা দিয়ে ফ্যান কিনার পরেও আরো অনেক টাকা বাঁচবে। তোর বউ আর ছেলেকে তো গত রোযার ইদে কিছুই দিতে পারিসনি। আকামলা মরদ কোথাকার। এটা থেকে ওদেরকে পোশাক কিনে দিস।’

মনির মিয়া অর্থাভাবে থাকলেও কখনো লোভ করেননি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে কুমন্ত্রণায় পড়ে তিনি ব্যাগটা রিকশার যাত্রী-সিটের নিচে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখেন। এরপর রিকশা গ্যারেজে জমা দিয়ে বাজারের ব্যাগে ভরে ব্যাগটাকে নিয়ে আসেন ঘর পর্যন্ত।

মনির মিয়া ব্যাগ খুলে দেখলেন তাতে কিছু খুচরো টাকা আছে। বড়জোর ৫০০ হবে। এ দিয়ে আর কী হবে? মনির মিয়ার চেহারায় রাজ্যের কালোমেঘ নেমে এল। নিরস মনে ব্যাগটা যখন বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখনই তার ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে একটা কিছুর ছোঁয়া অনুভব করেন। তড়িঘড়ি করে ব্যাগের দ্বিতীয় প্যাকেট খুলে দেখেন এক কোণে পড়ে আছে একটি প্লাস্টিকের কৌটা। কৌটাটি বের করে খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে উঠে মনির মিয়ার। কৌটার ভিতরে থাকা বস্তুটার গায়ে জ্যোৎস্নার আলো লেগে এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। মুগ্ধতায় ভরে ওঠে মনির মিয়ার চোখজোড়া। বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই এটা দামি কোন বস্তু। তার চেহারায় ফুটে ওঠে বিশাল রকমের বড়লোক হয়ে যাওয়ার মত অভিব্যক্তি।

৩.

‘মা, তুমি এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পার? ড্রাইভারকে বললেই তো সে তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসত। রিকশা নিতে গেলে কেন তুমি? এখন কি আর ঐ ডায়মন্ডের রিংটা ফেরত পাওয়া যাবে? যা দিনকাল পড়েছে! কেউ রাস্তায় কিছু পেলে নিজের ভেবে লুফে নিতে দেরি করে না।’

সেদিন রিকশায় ভ্যানিটি ব্যাগটা ফেলে আসার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পরই বড় মেয়ের মুখনিঃসৃত ঝাঁঝালো বাক্যগুলো শ্রবণ করতে হচ্ছে মনোয়ারা বেগমকে। কৈফিয়তের স্বরে প্রায় প্রতিবারই উত্তর দিচ্ছেন, ‘তোরা জানিসই তো গাড়ির ভিতর আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে জন্যই তো রিকশা নিলাম। বুড়ো মানুষ! আগের মত সবকিছু মনে থাকে না। তোরাই তো ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আমাকে পাঠালি। আমার মন বলছে রিকশাওয়ালা ব্যাগটা ফেরত দিতে আসবে। আমার লোকটাকে ভাল মনে হয়েছে। আমি তাকে বেশি টাকা দিতে চেয়েছিলাম। সে যত ভাড়া ততই রাখল।’

‘ওসব ভান করেছে। এ শহরের রিকশাওয়ালাদের আমার হাড়ে হাড়ে চেনা আছে। সবকটা চোর, বদের হাড্ডি। নিশ্চয়ই ডায়মন্ডের আংটিটা পেয়ে এতক্ষণে শহর ছেড়ে পালিয়েছে।’ তীব্র ঘৃণামিশ্রিত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন মনোয়ারা বেগমের বড়মেয়ের জামাই। যেন হরহামেশাই তাকে এমন এক্সপেরিমেন্টের মুখোমুখি হতে হয়।

ওদিকে মনোয়ারা বেগমের নাতনী তার জন্মদিন উপলক্ষে কেনা ডায়মন্ডের রিংটার জন্য রাত থেকে কান্না জুড়ে দিয়েছে। সাথে নাওয়া-খাওয়াও ছেড়েছে। ডায়মন্ডের রিং তার চাই-ই চাই। রফিক সাহেব তার নাতনিকে বার বার বুঝিয়ে যাচ্ছেন, ‘আহ কাঁদে না দাদু ভাই। একটা গেছে তো কী হয়েছে? তোমাকে নতুন আরেকটা এনে দিব।’ তবুও তার কান্নার রেলগাড়ি অবিরাম চলছেই। ঠিক এমন সময়ে ‘সুখের ঠিকানা’ ভিলার সকল নাগরিকের মনযোগ কেড়ে নিল বাইরের হৈ চৈ-এর আওয়াজ। তারা সবাই তড়িঘড়ি করে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন বসে বসে স্বাস্থ্যের ঈর্ষণীয় উন্নতি ঘটানো তাদের দারোয়ানটা একজন রোগা পটকা লোকের সাথে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। মনোয়ারা বেগম আঁতকে উঠে বললেন, ‘আরে! ঐ তো আমার ভ্যানিটি ব্যাগ। আর লোকটাকে দেখে তো কালকের রিকশাওয়ালাই মনে হচ্ছে।’

তড়িৎ গতিতে নিচে নেমে এলেন তিনি। বাড়ির অন্য সদস্যরাও তার অনুসরণ করল। বাড়ির লোকদের দেখে চুপসে গেল দারোয়ান। তার শক্তিমত্তা শূন্যের কোঠায় নেমে এল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মনির মিয়া। বসে বসে খেয়ে শরীর ফুলানো দারোয়ানটার সাথে কুলিয়ে উঠতে তার বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছিল। হ্যাংলা একটা শরীর নিয়ে আর কত পারা যায়? মনোয়ারা বেগম অগ্নিঝরা দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন দারোয়ানের দিকে। তার কাচুমাচু ভাব আরো বেড়ে গেল। আত্মপ্রতিরক্ষার জন্য কিছু একটা বলতে চেয়েও তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। এরপর মনোয়ারা বেগম রিকশাওয়ালাটির দিকে তাকালেন। কোমল স্বরে বললেন, ‘আপনি কি কালকের রিকশাওয়ালাটা না?’

‘জি মেমসাব। আপনি যে কাইল আপনের ব্যাগটা রিকশায় ফালাইয়া গেছিলেন। সেইটাই ফেরত দিতে আসছিলাম। আইসা দারোয়ান ভাইরে কইলাম, ভাইজান এই বাড়ির মালিকের লগে একটু দেখা করুম। উনি কয় কোন ছোটলোক ভেতরে ঢুকতে দেওন যাইব না। পরে হাতে ব্যাগ দেইখা আমার সাথে টানাটানি শুরু কইরা দিছে।’ বিনীত কণ্ঠে মনোয়ারা বেগমের উত্তর দিলেন রিকশাওয়ালা মনির মিয়া। বাড়ির সকলে তখন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দারোয়ানের দিকে। বেচারা দারোয়ানের ‘ধরণী দ্বিধা হও’ টাইপ অবস্থা হয়ে গেল। এরপর বাড়ির সকলেই প্রায় সমস্বরে মনির মিয়াকে ভেতরে যেতে বললেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিলেন মনির মিয়া। তাদের হাতে ব্যাগটা দিয়ে বললেন, ‘অনেকগুলা সময় লস হইয়া গেল। আর দুই তিনটা খ্যাপ দিতে পারলে আজকা ফ্যানটা কিনতে পারুম। কিছু মনে করবেন না। আমার অহন যাইতে হইব। জানি, ব্যাগটার লাইগা আপনারা অনেক চিন্তায় আছিলেন। আমার কালকাই ফেরত দেয়া উচিত আছিল। দেরী হইয়া গেল। এর লাইগা আমারে মাফ কইরা দিয়েন।’

বাড়ির সমস্ত লোক বিস্ময়ে থ বনে গেল। একটু আগেই যে দারোয়ান মনির মিয়ার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়েছিল, তার চোখেও দেখা গেল সীমাহীন শ্রদ্ধা।

মনির মিয়া আবারো ছুটে চলছেন। এই ছুটে চলা দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের লক্ষ্যে। হাতে কিছু টাকা জমেছে এই কদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে। যে করেই হোক আর কটা টাকা রোজগার করে আজকের মধ্যে ফ্যান না কিনলেই নয়। তবে এত চাপের মাঝেও এই মুহূর্তে নিজেকে বেশ ভারমুক্ত মনে হচ্ছে মনির মিয়ার। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে মাথার উপর থেকে বিরাট ভারি একটা বোঝা নামিয়ে দিয়ে এসেছেন। বুকের গভীরে অনুভব করছেন অদ্ভুত প্রশান্তি। শত হীরার মূল্য দিয়েও যা কেনা দুঃসাধ্য। গতকাল রাতে আংটিটা দেখে সাময়িকের জন্য মনে আনন্দের সৃষ্টি হলেও একটুপরই রাজ্যের চিন্তা ভর করে তার মস্তিস্কে। তিনি ভাবলেন, এমন দামী জিনিসটা যে হারিয়েছে সে নিশ্চয়ই অনেক কষ্টে আছে। আর এই জিনিসটা বিক্রি করে দিলে তা পাপ হবে। পাপ দিয়ে ক্ষণিকের জন্য সুখ কেনা গেলেও তার বিপরীতে পরবর্তীতে নেমে আসবে অবর্ণনীয় দুঃখ। তা ছাড়া এমন দামী বস্তু যদি কেউ তার হাতে দেখে তাহলে নানা বিপদ হতে পারে। তার ছোট্ট সুখের সংসারে নেমে আসতে পারে দুর্যোগের ঘনঘটা। এসব ভেবে আঁতকে উঠে মনির মিয়ার পিতৃসুলভ ও স্বামীসুলভ মন। তখনই নিজের অসৎ ইচ্ছার জন্য তওবা করে দৃঢ় সংকল্প করে নেন। কাল ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই তিনি এই দামী বস্তু তার মালিকের হাতে সোপর্দ করে আসবেন।

‘মুসার বাপ, আপনের হাতে এইটা কী! দেখে তো তো অনেক সুন্দর লাগতাছে। মনে হয় অনেক দামী জিনিস। কই পাইলেন? পিছন থেকে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠেন রাজিয়া। মনির মিয়া তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মৃদুস্বরে ধমক দিলেন, ‘তুমি ঘুম থেইকা উইঠা আইছ ক্যান? মুসার ঘুম ভাইঙ্গা যাইব। যাও, ভিতরে যাও।’ মনির মিয়া ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। রাজিয়াও দরজা লাগিয়ে চলে আসেন ঘরের ভিতরে। তার চোখে রাজ্যের কৌতুহল। তিনি ইতিমধ্যেই ভেবে নিয়েছেন তার স্বামীর হাতের ঐ বস্তুটার মধ্যেই রয়েছে তাদের টানাটানির সংসারের স্বচ্ছলতার উপাদান। মনির মিয়া টিনের বেড়া কেটে তৈরী করা জানালাটা তুলে দেন। তাদের ছোট্ট ঘরটায় ফালি ফালি জ্যোৎস্নার আলো প্রবেশ করে এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য মনির মিয়া তার স্ত্রীকে বলেন, ‘মুসার মা, দেখছ বাইরে কি সুন্দর জোনাকপইরা (জ্যোৎস্নাভরা) রাইত। চান্দের কি ফকফইক্কা (পরিস্কার) আলো! আরে কই তুমি? দেইখা যাও, কেমুন সুন্দর সিনারি (দৃশ্য)।’

‘হ, দেখলাম তো! এই সুন্দর ফকফইক্কা আলোর মইধ্যে আপনের হাতের ঐ জিনিসটা কী সুন্দর ঝিলিক মিলিক করতাছিল!’ এড়িয়ে যেতে চাওয়া প্রসঙ্গটা আবার উল্লেখ করেন রাজিয়া। এরপর আরো অনুনয় করে বলেন, ‘ও মুসার বাপ, কন না! কই পাইলেন এইডা? মনে হইতাছে অনেক দামি! এইটা বেচলে অনেক টেকা পাওয়া যাইব। আমাগো আর কষ্ট কইরা দিন কাটান লাগব না।’

মনির মিয়া জোরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এইসব কি কও তুমি? মাইনসের জিনিস বেইচ্চা আমি পাপের ভাগী হইতে পারুম না। মাথার উপরে আল্লাহ সব দেখেন। তিনি কষ্ট দিছেন। একদিন তিনি সুখও দিবেন। এই পাপের কামাই দিয়া আমার ছোট্ট সোনার সংসারে বিপদ ডাইকা আনতে কও? আল্লাহ তোমারে মাফ করুক।’

স্বামীর এমন ভয়াল রূপ দেখে পিলে চমকে গেল রাজিয়া বেগমের। সাথে সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে বললেন, ‘আমি তো এতকিছু ভাইব্বা দেহি নাই। আমার ভুল হইয়া গেছে। আমারে মাফ কইরা দেন। মনির মিয়ার ধমকের আওয়াজে মুসারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে এসে দাঁড়ায় মা-বাবার পাশে। বাবাকে জাগ্রত দেখে বলতে শুরু করে, ‘ও বাজান! ফ্যান কিন্না আনবা কবে? গরমে ঘুমাইতে পারি না।’

‘এই তো কালকাই কিন্না আইন্না দিমু। আইজকার রাতটা একটু কষ্ট কর। কালকাই কিন্না আনুম ‘ স্নেহের স্বরে ছেলেকে নিবৃত্ত করলেন মনির মিয়া। এরপর নিশ্চুপ রাতের কোলে তিনজনকেই দূরাকাশের চন্দ্রালোকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। রাতের আঁধার কেটে গিয়ে কোমল ভোরের প্রথম আলোর ফোঁটা পৃথিবীর গায়ে আছড়ে পড়তেই মনির মিয়া বস্তুটি ফেরৎ দেয়ার জন্য বের হয়ে পড়েন। কিন্তু ঢাকা শহরে অলিগলি ভরা পথে ভদ্র মহিলার বাড়ি খুঁজে বের করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। এক টুকরো খাবারও পড়েনি মনির মিয়ার পেটে। ওদিকে দারোয়ানের সাথে টানাহ্যাঁচড়া করে কাহিল শরীরে বেশ ক্লান্তিবোধ হচ্ছে তার। শরীরের প্রতিটি গ্রন্থি, কোষ যেন বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু নিজের অবসন্ন দেহটাকে জোর করে রিকশায় প্যাডেল মেরে চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। চেহারায় তার তীব্র মলিনতা। আজকেও ফ্যান কিনা হবে না। কারণ দিবস শেষে অন্ধকারের উঁকি দেয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু তার পকেটে এখনো যোগ হয়নি প্রয়োজনীয় টাকার অংকটা। মনে হয় না আজকে আর পারবেন। ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। তাই রিকশাটা থামিয়ে রাস্তার পাশে একটি বয়স্ক গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন।

মনির মিয়া আজো ফ্যান কিনতে পারেননি। যে কয়টাকা পেয়েছেন তার সিংহ ভাগ মালিককে ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে। হাতে আছে সামান্য কিছু টাকা। তীব্র অপরাধবোধ নিয়ে ব্যর্থ মনোরথে বাড়ির পথ ধরলেন। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই তিনি যে বস্তিটাতে থাকেন তার প্রবেশমুখে বিশাল একটা কালোগাড়ি দেখলেন। মনির মিয়া কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন দামি গাড়ি বস্তির মত নোংরা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার উদ্দেশ্য তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন না। আরেকটু দূর এগোতেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন। পিছন থেকে তাকে কেউ নাম ধরে ডাকছে। বয়স্ক কণ্ঠ থেকে আওয়াজ আসছে, ‘কে যায় ? মনির মিয়া না? দাঁড়াও।’ মনির মিয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন গাড়ির ভেতর থেকে দুজন মানুষ বেরিয়ে আসছে। চেহারা দেখে মনির মিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো সেই বাড়ির সাহেব আর সাহেবা! তারা কীভাবে তাকে খুঁজে বের করল? রফিক সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার নাতনিটা তোমার ছবি তুলে রেখেছিল। সেটা দেখিয়েই এ পর্যন্ত এলাম। তোমার নাম দেখছি সবাই জানে।’ মনির মিয়া ইতস্তত কণ্ঠে বললেন, আপনেরা এত কষ্ট কইরা আমার মত গরীব মানুষরে খুঁজতে আইছেন? আপনেগো কই বইতে দেই? গরিবের খালি একটা ছোড ঘর আছে।

রফিক সাহেব বললেন, ‘তোমার মত ভালো মানুষ আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। পৃথিবীর প্রতিটি শহরে যদি তোমার মত একজন করেও ভাল মানুষ থাকে, তাহলে পৃথিবীর রূপটাই পালটে যাবে। তুমি আমাদের যা উপকার করেছ তার বিনিময়ে তোমাকে যাই দেই না কেন তাই তুচ্ছ হবে। তোমার মাঝে যে সততার মহৎ গুণ আছে অমন শত শত হীরের আংটি দিয়েও তার মূল্য দেয়া সম্ভব নয়।’ রফিক সাহেবের এমন উপচে পড়া প্রশংসা শুনে মনির মিয়া তার প্রথমবারের ইচ্ছের জন্য অনেক অনুতপ্ত হলেন। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হল তার। রফিক সাহেব আরো বললেন, ‘তোমার উপকারের যথাযথ বিনিময় হয়তো আমরা দিতে পারব না। কিন্তু তোমার মত ভাল মানুষ এমন কষ্টে দিন কাটাবে তা আমরা মেনে নিতে পারব না। তাই তোমাকে একটা কাজ দিব। তোমাকে রাজি হতেই হবে। শহরের অপর প্রান্তে আমাদের আরেকটা বাড়ি আছে। আমরা তাতে বাসা ভাড়া দিই। কিন্তু সেটা দেখভাল করার জন্য বিশ্বস্ত লোক পাচ্ছি না। তাই আমরা চাই তোমাকে সেই বাড়ির কেয়ারটেকার রাখব। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না। তোমাকে আর কষ্ট করে রিকশা চালাতে হবে না। মাস শেষে তোমাকে বিশ হাজার টাকা দেব। চাইলে আরো বেশিও নিতে পার।’

মনির মিয়া নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না। ভাবতে লাগলেন, মাসে বিশহাজার টাকা দিবে! তাহলে আর তাদের সংসারে টানাটানি হবে না। এদিকে মনির মিয়ার মৌনতায় চেহারায় চিন্তার ভাঁজ স্পস্ট হল রফিক সাহেবের কপালে। তিনি ও তার স্ত্রী প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘কি বল বাবা, যাবে না?’ তারা দু জন মনির মিয়ার বাবা-মায়ের সমবয়সীই হবেন। তাদের এমন দরদমাখা আহ্বান প্রত্যাখান করার সাহস হল না মনির মিয়ার। তার নেত্রজোড়ায় আনন্দের বারিধারা বর্ষণ হল। তিনি তাদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক খন্ড সম্মতির হাসি দিলেন। পৃথিবীর উঠোনে এক মধুরতম দৃশ্যের অবতারণা হল।

৭.

আকাশের বিশাল সামিয়ানাজুড়ে অগণিত তারার মেলা বসেছে। তারকা-নক্ষত্রের সমাবেশের মধ্যমনি হয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে বিপুল আলো ছড়াচ্ছে চতুর্দশী পূর্ণিমার চাঁদ। সে আলোয় মনোমুগ্ধকর সাজে সেজে উঠেছে শহর। শহরের এক টুকরো ভূমিতে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার অপরূপ প্রকৃতির মুগ্ধতায় ভাসছে তারা তিনজন। মনির মিয়া, রাজিয়া, আর তাদের ছোট্ট সন্তান মুসা। মনির মিয়া বুকভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে তার সহধর্মিণী রাজিয়াকে বললেন, ‘দেখলা মুসার মা, কইছিলাম না! ঐ যে আসমান, জমিন, চান, সুরুজ যে বানাইছে উনি সবকিছু দেহে। উনিই কষ্টের পরে সুখ দেয়। একটা কথা মনে রাখবা, পাপে কোনদিন সুখ আসে না। পাপে বিপদ বাড়ে। আর ভাল কাজের পুরস্কার আল্লাহ এই জনমে না দিলেও পরজনমে অবশ্যই দিবেন।’ মনির মিয়া জীবন-উপলব্ধ একটি সুখতত্ত্বের সন্ধান দিলেন। রাজিয়া বেগম মনির মিয়ার বুকের পশমে পরম নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে নিলেন। আকাশভরা তারকারাজি, গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ সবাই মিলে সেই পবিত্র দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল।

পরদিন জুমআর নামায আদায় করতে গেলেন মনির মিয়া। জুমআর বয়ানে শুনতে পেলেন ইমাম সাহেব বলছেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘ইন্না মা’আল উসরি ইয়ুসরা।’ নিশ্চয়ই কষ্টের পরে সুখ রয়েছে। তাই সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা’আলার শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত। সাথে সাথে নড়ে উঠল মনির মিয়ার ঠোঁটজোড়া। তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’।