এক.
-আম্মু, দেখো ওইটা কি আব্বু না?
শেলী বেগম এসে দেখলেন টিভি স্ক্রিনে সাজোয়া যানে অস্ত্র তাক করে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে তার স্বামীর মতোই মনে হচ্ছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য আরেকটু সামনে এগোলেন তিনি। এবার নিশ্চিত হলেন অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটি তারই স্বামী। ছেলের আতংকমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-হ্যাঁ, তোর আব্বুকেই তো দেখা যাচ্ছে।
-তাহলে আব্বু এভাবে কাদেরকে গুলি করছে আম্মু?
-জঙ্গিদের গুলি করছে।
-জঙ্গি কারা আম্মু?
শেলী টিভি স্ক্রিনের দিকে ইশারা করে বললেন,
-ঐ যে দেখো পাঞ্জাবি টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে।
-কিন্তু তাদের কী দোষ? তারা তো মসজিদের সামনে খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
শেলী বেগম কী বলবেন ভেবে পেলেন না। ছেলেকে নিবৃত্ত করার জন্য বললেন,
-ওদের কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু ওরা জঙ্গি। ওরা মানুষের ক্ষতি করে।
-তাহলে কি দাদাও জঙ্গি? দাদাকে তো দেখি পাঞ্জাবি টুপি পরতে। নামাজ পড়ে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমিও তো পাঞ্জাবি টুপি পড়ে মসজিদে যাই। আমিও কি জঙ্গি? আব্বু কি আমাকেও গুলি করবে?
এবার ছেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না শেলী বেগম। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ক্লাস টু পড়ুয়া সাত বছরের ছেলের দিকে।
কিছুদিন পর বাড়িতে এলেন পুলিশ অফিসার রাশেদ আলম। স্ত্রী শেলী বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন,
-কই, আমার আব্বুটা কই?
-ওর দাদার রুমে।
রাশেদ আলম তার বাবার রুমে গেলে ছোট্ট রুমেল তার দাদার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রাশেদ আলম বারবার ডাকলেও ছেলে কিছুতেই দাদার পিছন থেকে যাচ্ছে না। শেষে দাদা জিজ্ঞেস করলেন,
-কী হয়েছে দাদু, বাবা ডাকছে যাচ্ছ না কেন?
-দাদু, তুমি জানো না, আব্বু পাঞ্জাবি টুপি পরা কাউকে দেখলে গুলি করে দেয়। তোমাকেও গুলি করে দিবে। তুমি আর মসজিদে যেও না।
রুমেলের ভয়ার্ত কণ্ঠে কথাগুলো শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন দাদু। এখন তার দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছেন পুলিশ অফিসার রুমেল। লজ্জায় তার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করেছে। ছেলের এই উত্তরে তিনি তার সকল অপকর্মের জবাব পেয়ে গেছেন।
দুই.
বাইতুল মুকাররমের দক্ষিণ গেটে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন মধ্যবয়সী রফিক মিয়া। বয়স ৪৫ হবে। আজই প্রথম ঢাকায় এলেন। তার ছেলে ঢাকার এক মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে এ বছর। ছেলের জন্য পিঠাপুলী দিয়ে পাঠিয়েছেন মা। তার মনের বড় ইচ্ছে ছিল একদিন বাইতুল মুকাররম মসজিদে জুমার নামাজ পড়বেন। তাই ছেলেকে দেখতে যাওয়ার আগে বাইতুল মুকাররমে চলে এলেন। ইস্তিঞ্জা-অজু সেরে প্রশান্তচিত্তে প্রবেশ করলেন মসজিদের ভেতরে। তখনো জামাতের বেশ বাকি ছিল। তাই নিচতলায় জায়গা পেয়ে গেলেন। ব্যাগটাকে একপাশে রেখে বসে পড়লেন মুসল্লিদের সঙ্গে। একটু পর শুরু হলো বয়ান। বয়ান-খুতবার পর জুমার নামাজ শেষে খতিব সাহেবের লম্বা মুনাজাতে প্রাণ ভরে উঠল রফিক মিয়ার। সুন্নাত শেষ করে দেখলেন মুসল্লিদের অনেকেই উত্তর গেটের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে আসবে। ভারতে হাজার হাজার মুসলমানের খুনের পেছনে দায়ী এই লোক। তাই এদেশের মুসলিম ভাইরা কখনোই মেনে নিবে না মোদির আগমন। হয়তো এভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে তারা মোদির আগমন রুখে দিতে পারবে না। কিন্তু মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের জানান তো দিতে পারবে। রফিক মিয়ারও ইচ্ছে হলো তাদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু ছেলের কাছে যেতে হবে। তারপর রাতে আবার ধরতে হবে ফেরার বাস। তাই ব্যাগটা নিয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে এলেন। এদিকে শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। নিরস্ত্র মুসল্লিদের উপর হামলা করেছে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এসব হট্টগোল শুনে রফিক মিয়ার হৃদয় কেঁপে উঠল। ভেসে উঠল ছেলেটার মুখ। কতদিন ছেলেটাকে দেখেন না। যে করেই হোক ছেলেটার কাছে যেতে হবে। ওর মা কত যত্ন করে পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছে!
গেটের কাছে যেতেই পেছন থেকে কেউ লাঠির আঘাত করল রফিক মিয়ার মাথায়। বিক্ষোভ মিছিলে না গেলেও পরিধিত পাঞ্জাবি আর টুপি তাকে ঘাতকের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। লাঠির আঘাতে রফিক মিয়ার মাথা ঝিনঝিন করে উঠল। নিমিষেই ঝাপসা হয়ে এল চোখের সামনের গেট, গেটের ওপাশের সারিবদ্ধ গাড়ী, দালান-কোঠা সবকিছু। খানিক দূরে ছিটকে পড়ল হাতের ব্যাগটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল ছেলের জন্য পাঠের মায়ের হাতের পিঠাগুলো। রফিক মিয়ার মাথা থেকে প্রবাহিত রক্ত এবং সেই খাবারগুলোর মধ্যে তৈরী হলো সংযোগ।
তিন.
আপনাদের কাছে একটি গল্প বলতে এলাম। চলতি বাসে দাঁড়িয়ে হকার যেমন তার পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে যায়। প্রবল অনাগ্রহ আর তীব্র অসন্তোষ ভরা শত দৃষ্টিকেও সে অগ্রাহ্য করে অবলীলায়। ঠিক তার মতো করেই আপনাদের কাছে একট গল্প বলতে এসেছি। আমাকে যতই দৃষ্টিবানে বিদ্ধ করুন না কেন! আমি গল্পটি বলে যাব। চাই গল্পটি আপনাদের কর্ণকুহর ভেদ করুক বা না করুক, আমি গল্পটি বলে যাব। গল্পটির আবেদন আপনাদের হৃদয়ে ব্যাথা জাগরণ করুক বা না করুক। আমি আমার নিজস্ব ব্যথা থেকে আপনাদের কাছে গল্পটি বলে যাব।
আমার গল্পের চরিত্র একজন অথবা সহস্রজন। একজনের গল্প বলে যাব। সেখানে সহস্রজনকে কল্পনা করে নিতে আপনাদেরকে মোটেও কষ্ট পেতে হবে না। আমার গল্পের চরিত্রটির প্রতি আমার খুব মায়া হয়। তার জীবনটা এক যাযাবরের জীবন। আপনজনদের কাছ থেকে বহুদূরে আছে সে। হালাল রুজির তালাশে। স্রষ্টার সন্তুষ্টির তালাশে। মানুষের সেবার মানসে। আমার চরিত্রটির সুন্দর একটি নাম আছে। সে নামের আছে আকর্ষণীয় অর্থ। এককালে নামের মতোই তার দাপট ছিল। কালের পরিক্রমায় আজ তার নামটা ঠিকই আছে। কিন্তু নামের যেই অর্থ, তা পাল্টে গেছে বিপরীত অর্থে।
গল্পটি শুরু করা যাক। আমাদের গল্পটি শুরু হবে একটি বিশাল ডুপ্লেক্স মসজিদ থেকে। গল্পের নায়ককে খুঁজে পেতে হলে আমাদের যেতে হবে মুসল্লিদের কাতার বেয়ে একেবারে প্রথম সারিতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পাবেন, সুদৃশ্য এক মিম্বারে বসে শুভ্র পরিচ্ছন্ন বসনে এক সুপুরুষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন কথার মূর্ছনা। আপনি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকবেন তার কথা। ভাবতে থাকবেন, আমার সংলাপের সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না কেন? তার জ্যোতির্ময় মায়াবী মুখচ্ছবি দেখে ভাবতে থাকবেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সুখী মানুষ বোধ হয় তিনিই। একটু পরেই খুঁজে পাবেন তার আসল রহস্য। আপনি যেখানটায় বসেন আছেন, তার পাশেই আসন গেড়ে বসা ক্রমাগত ঝিমুতে থাকা লোকটা হঠাৎ চমকে উঠবে। বাজখাই গলায় ধমক দিয়ে বলে উঠবে, ‘বন্ধ করেন। যত্তসব। আপনারে আমরা রাখছি মানুষরে হেদায়াতের কথা কওয়ার লাইগা।’
আপনি আশ্চর্য হয়ে ভাববেন- কী আজব দুনিয়া সপ্তাহে একদিন পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়ানো লোকের কাছে শিখতে হবে হেদায়াতের কথা। আমাদের গল্পের নায়ক এরপর কী করবেন? থেমে যাবেন নাকি নিজের মতো করে গর্জে উঠবেন? আপনি নিজেই চাইবেন তিনি যেন থেমে যান। অস্থিতিশীল, অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও আমরা একদিক থেকে খুব সহিষ্ণু হয়ে গেছি। মুখ বুজে অন্যায় সয়ে যেতে, অত্যাচারীদের আস্ফালন দেখে যেতে আমরা খুব এক্সপার্ট। আমাদের গল্পের নায়ক থেমে যাবেন ঠিকই। তবে তার নীরবতার উৎস এই কাপুরুষোচিত সহিষ্ণুতা নয়। তিনি জানেন, ইন্নাল্লাহা মাআস সাবিরিন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
চার.
মায়ের অপেক্ষা আর ফুরোচ্ছে না। স্টেশনে এসে শেষ ট্রেন চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। ছেলে রবিউল ফোন দিয়ে বলেছিল পরীক্ষাটা শেষ করে দু দিন পরেই বাড়ি ফিরছে। সে হিসেব করে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে তার অপেক্ষার পালা। স্টেশনের অনেকেই বলেছে শুক্রবার হাটহাজারি গুলাগুলি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন আপনার ছেলের কিছু হয়েছে কি না। মা তাদের কথা কানে নেন না? মনে মনে ভাবেন, ‘এই অলি-আউলিয়ার জমিনে ছেলের মাদ্রাসায় পড়তে দিলাম। মাদ্রাসার ছাত্রের উপর গুলি করব এমন শিমার কি পৃথিবীতে আছে?’ মা জানেন না এমন বহু শিমার এই অলি আউলিয়ার জমিনে তৈরী হয়ে গেছে। শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর মা যখন মলিন মুখে ফিরে যাচ্ছেন তখন হঠাৎ পল্লীর নীরবতা ভেদ করে বেজে উঠল অ্যাম্বুলেন্সের ভীতিকর আওয়াজ। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মায়ের বুক। আশঙ্কাকে সত্যি করে অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে থামল রবিউলদের বাড়ির উঠোনে। মা বাড়ি ফিরতে ফিরতে ততক্ষণে বাড়িতে লোক জমে গেছে। দেখতে পেলেন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে রবিউলের বাবা। ছেলের এমন করুণ প্রত্যাবর্তন থেকে ভালো ছিল চিরজনমের অপেক্ষাই।
পাঁচ.
ক্লাব ঘরটাতে বেশ হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রুমেলদের সাকসেস পার্টি চলছে এখানে। আজ নিরস্ত্র হুজুরদের পিটিয়ে বেশ কিছু টাকা হাত করা গেছে নেতার কাছ থেকে। সেটারই সদ্ব্যবহার করছে তারা। রাত যখন দুটো বাজে সবাই ক্লাব ছেড়ে যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সবাই কম বেশি নেশা করেছে। এই অবস্থায় রুমেলকে বাইক নিয়ে যেতে নিষেধ করে অন্যরা। রুমেল বলে, আরে না কিছু হইব না। হুজুর পিটাইয়া যখন এই পর্যন্ত আসতে পারছি। এখন বাইক নিয়া বাড়িতেও যাইতে পারব। কিছু হইব না।
সকালে ফজর পড়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন ইমাম সাহেব। যে সড়ক ধরে হাঁটছেন এর আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলেন সড়কের পাশে গাছের নিচে বাইকটি পড়ে আছে। তড়িঘড়ি করে সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন এর চেয়ে খানিক দূরে পড়ে আছে একটি লাশ। সড়কটি জনপদ থেকে দূরে হওয়ার কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও টের পায়নি এই এক্সিডেন্টের কথা। লাশটি পড়ে আছে উলটো হয়ে। দূর থেকে চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। কাছে যেতেই চমকে গেলেন তিনি। গতকাল যে তাকে লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করেছে তার চেহারা কী করে ভুলবেন তিনি! ইমাম সাহেব জানতেন, মজলুমের দোয়া আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না। কিন্তু এত দ্রুতই দোয়া কবুল হয়ে যাবে ভাবেননি তিনি।