পোস্টস

গল্প

সুধাময়

১৩ জুন ২০২৪

আলতাফ শেহাব

সুধাময়

সুধাময়ের মোহনীয় কণ্ঠসুধায় উথাল পাথাল মোহিনীদের বসার ঘরের পড়ন্ত বিকেল। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মোহিনী কবিতার অন্তর্গত দৃশাবলী অনুবাদের সূত্র খোঁজেন উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে। শ্রেণীকক্ষে মেধাবী শিক্ষকের কাছে ছক কষে কবিতার ব্যাকরণ শেখা যায়, কিন্তু বসার ঘরে চায়ের আড্ডায় কবিকণ্ঠে কবিতার পাঠ মননে ও মগজে অন্যরকম ঝড় তোলে।

মোহিনী ও সুধাময় একই কলেজে আলাদা বিষয়ে স্নাতকের ছাত্র, সময়ের হেরফেরে প্রতিদিন দেখা হয় না। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র সুধাময়ের ব্যস্ত সময় কাটে মিছিলে-স্লোগানে। সঙ্গত কারণে কলেজে বিশেষ কারো সাথে একান্তে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। দীঘির পাড়, মহাশ্মশান, পৌর উদ্যানে কবিতার রূপকল্প, ছন্দ, উপমার দুরন্ত পাঠ চলে অবিরত। অধ্যাপক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মোহিনীর সুধাময়ের সাথে এই অন্তরঙ্গ বোঝাপড়ার সঠিক নাম বা ব্যাকরণ জানে না দু’জনের কেউই। সুধাময় নিজের কবিতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই সম্পর্ককে শ্রেয়সী নামেই পরিচয় দেয়।

স্নাতক শেষ হতে হতে দু’জনের দেখা সাক্ষাতের উপলক্ষও কমতে থাকে। শুরু হয় জীবনের অন্য আয়োজন। বাবা-মায়ের পরিকল্পনাতে হঠাৎ করে অনাড়ম্বরভাবেই বিয়ে হয়ে যায় মোহিনীর। অল্পদিনের ভেতর প্রবাসী স্বামীর সাথে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়া। আর পাকাপাকিভাবে কবিতার সাথে বসবাস শুরু হয় সুধাময়ের। এলোমেলো হয়ে যায় রাজনীতি, সমাজ, সংসার, হৃদয়ে সাথে বোঝাপড়ায় ছিন্নভিন্ন হয় বারংবার। মোহিনীর সাথে বিচ্ছেদ শ্রেয়সী হারানোর ব্যাথার চেয়েও বেশীকিছু মনে হয় সুধাময়ের।

মধ্যবিত্ত সংসারের বড় সন্তান সুধাময়ের এ বিলাসিতা বেশি দিন চলবে কেন? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষা শিখতে হয় রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র সুধাময়কে। বাবার পেনশনের টাকায় উচ্চ শিক্ষার নামে মূলত সংসারের ভাগ্য ফেরাতে বিলেতে পাড়ি দিতে হয় সুধাময়কে। বন্ধুর বিনামূল্যের আশ্রয় মাত্র ছয় দিনেই শেষ হয়। বিলেতের মোহ ভাঙ্গে যায় সুধাময়ের। শুরু হয় অন্য আলোর খোঁজ। সরকারি চাকুরে বাবার আশ্রয়ে থেকে বিকেলে চায়ের আড্ডায় সমাজ বদলের স্বপ্নদেখা সুধাময়ের কাছে এ এক অন্য জীবনের প্রতিচ্ছবি।

বিদ্যার জোর কোন কাজেই আসে না, পায়ের জোরে দেশি খাবারের দোকানের প্রচারপত্র বিলি করে কোন কোন দিন দুই চার পাউন্ডের সংস্থান হয়। প্রচারপত্র বিলি করা নতুন বিষয় নয় সুধাময়ের কাছে, কিন্তু সাহেবদের বিলেতি কুকুরের তাড়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। হতাশ সুধাময় অল্প সময়ের মধ্যে বুঝে যান, এ সামান্য আয়ে সংসারের ভাগ্য ফেরাতো দূরের কথা নিজেরই টিকে থাকা অসম্ভব। পরিবারের স্বপ্নে জল ঢেলে ফেরার বিমানে চড়তে বাধ্য হয় সুধাময়। বিমান দেশের মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে শুরু হয় নতুন কবিতার চাষবাস। নিশ্চুপ আড়ালে চলে যায় সুধাময়। বছরের পর বছর স্মৃতি হাতড়ে মালা গাঁথে মোহিনীর প্রতিটি স্পর্শ বকুল।

কিছুদিন আগে করোনা মহামারি শুরু হলে, ভয়ানক অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘরে ফিরে সকলে। অন্যদের বন্ধিদশা অনায়েশে খুন করে সুধাময়ের একাগ্র নির্জনতা। এবার ঘর ছাড়ে সুধাময়, পথেপথে খুঁজে ফিরে নির্জনতা। দেখা হয় মৃত্যুর মুখোমুখি অসহায় মানুষের নিদারুন একাকিত্বের সাথে। অন্য অনেককে শুশ্রষার সন্ধান দিতে দিতে মহামারীর কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়,আর ফেরে না সুধাময়।

 

প্রতিধ্বনিতে প্রকাশিত