পরের চ্যাপ্টার আগের চ্যাপ্টার

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-০৭)

১৫ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-০৭  
রুচিরা চুপচাপ বসে থাকে। ঘাসের বুকে আপন মনে চিমটি কাটে। আর ভাবে- এই মেয়েটা সত্যিই কত আপন হয়ে কথা বলছে। কথার মধ্যে শাসন জড়িয়ে আছে অথচ কত বিনম্র উচ্চারণ। 
মানুষ ভুল করে। সেটা আবার নিজেকেই শোধরাতে হয়।- পারমিতা রুচিরার অবনত মুখমন্ডলে তাকিয়ে বলে। 
মানুষ তার পরিবেশ নিয়েই বলে। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-সবার সাথেই জীবনের কোন না কোন অংশ জড়িয়ে আছে। তারপরও সবার একটা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ জীবন থাকে।– কথাগুলো বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে বলে রুচিরা পারমিতার দিকে তাকায়। 
রুচিরার চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল করছে। পলকহীন দৃষ্টি। এক পলক জড়িয়ে এলেই যেন চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়বে। পারমিতার মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে গেল। মুহূর্তের নিঃশ্বাসে কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল। রুচিরার হাত দুটো টেনে চেপে ধরে কোন মতে উচ্চারণ করল- আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে আমি আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি। 
রুচিরার উচ্চারণ- আমি কষ্ট পাইনি। একটুও না। আপনি আমাকে বুঝতে পেরেছেন তাই খুশিতে কান্না আসছে। এই প্রথম কেউ আমাকে বুঝতে চষ্টো করছে।-বলে রুচিরা ডুকরে কেঁদে উঠল। 
পারমিতা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আরও কাছাকাছি হয়ে পারমিতা রুচিরাকে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল। 
অনেকক্ষণ নীরবতা। হালকা বাতাসে শেষ বিকেলের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রশান্ত বাতাসের স্পর্শে রুচিরার মনের রঙ একটু একটু করে পাল্টে যেতে লাগল। রুচিরা এই পরিবর্তনের পালাবদল একটুও টের পায়নি। প্রত্যেকের জীবনে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ আঙিনা থাকে ঠিকই কিন্তু এই সীমাবদ্ধ আঙিনায় অন্তত একজনকে বিচরণ করতে দিতে হয়। আর নয়তো বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি কুটকুট করে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে চলে। এই বিষাদময় মুহূর্তটুকু যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যরূপ ধারণ করল। নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে রুচিরার মনের সবুজভূমি আকুল হয়ে ওঠল। অসহায় দৃষ্টিতে রুচিরা পারমিতার চোখে চোখ রাখে। 
পারমিতা ভরসা দেবার ভঙ্গীতে বলে- যদি মনে কিছু না করেন, অবশ্য এই অল্প সময়ে এত কাছাকাছি হওয়াটা ঠিক না।- পারমিতা আমতা আমতা করছিল। 
রুচিরা আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে কোন সংকোচ রাখবেন না। যা ইচ্ছে হয় খুলে বলুন। আমি সব শুনব। শোনেন, কিছু মানুষ আছে যাদের চিনতে দেরি হয় না। এই যে আপনি, পরিচয় মাত্র কয়েক মিনিট হল। অথচ মনে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে আপনি আমার পরিচিত। যার কাছে নিঃসংকোচে সব কথা খুলে বলা যায়। 
আপনি আপনার কষ্টের সাথে অন্য কাউকে জড়ান। মনের সব কথা খুলে বলুন। দেখবেন সকল দুঃখ আর কষ্ট ধীরে ধীরে কমে আসবে। 
রুচিরা আবার চুপ হয়ে যায়। গভীর হয়ে কী যেন ভাবে। তারপর পারমিতার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল চোখে তাকায়। রুচিরা হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলে- আমি আমার জীবনটা একা একা উপভোগ করতে চাই। কোন পুরুষকেই আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না। 
পারমিতা বুঝতে পারে যে, ওর কথার মানেটা অন্যরকমভাবে নিয়েছে। পারমিতা আবার বলে- আমি কথাটা সে অর্থে বলিনি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, আপনার বুকের ভেতর যে কষ্টটা, সেটি অন্য কারও কাছে বলে একটু হালকা হোন। যেমন আপনার মা-বাবা অথবা কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে সেটা বলতে পারেন। দেখবেন নিজের ভেতরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। 
কথাগুলো শোনার পরপরই রুচিবার দৃষ্টি অন্য রকম হয়ে গেল। যেন ভরসা খুঁজে পেয়েছে- এমন ভাব। রুচিরা অনেকদিনই এমনটা ভেবেছে কিন্তু বলার মতো তেমন কোন কাছের জন পায়নি। পারমিতার চোখে-মুখে সুখের বর্ণচ্ছটা খেলে যাচ্ছে। রুচিরার ভাবনার জগতে পারমিতা। রুচিরা ভাবে, এ মেয়েটাই সত্যিকার অর্থে বন্ধু হবে। কারণ, সে মানুষকে বুঝতে পারে। যদিও কিছুক্ষণ আগে পরিচয় হয়েছে, তাতে কোনরকম অনুবিধা নেই। ওকেই সব বলতে হবে। 
বলতেই হবে তেমন কোন কথা নয়। প্লিজ মনে কিছু করবেন না, আমার মনে হল তাই বললাম।- পারমিতা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। 
তারপর হঠাৎ করেই রুচিরা বলে, আমি আপনাকেই আমার কষ্টের সীমানায় টানতেই চাই। 
পারমিতা অবাক হয়। কিছুক্ষণ হল পরিচয় হয়েছে। জানা-শোনা নেই, একজনের কাছে কি এত সহজেই সবকিছু বলতে পারে! হয়তোবা হতেও পারে। 
রুচিরাকে প্রশ্ন করে, বলে আচ্ছা আপনি আমাকেতো একদমই জানেন না, চিনলেন এই একটু আগে। তাহলে আমার কাছে বলতে চাচ্ছেন কেন? 
সবসময় সব কথার ব্যাখ্যা করে বলা কঠিন। তবে আমি এটুকু বুঝতে পারছি, আপনি এই অল্প সময়েই খুব কাছের হয়ে গেছেন। 
পারমিতা জবাবে আর অন্য কিছু বলেনি। রুচিরা নিজের ভেতর জগতের পুরো আঙিনাকে ওলট-পালট করে সুস্থির করে নেয়। স্মৃতির অধ্যায়ে লেপটে থাকা কষ্টগুলোকে নাড়া দেয়। ভীষণ রকমের কষ্ট রুচিরা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। পাশাপাশি পারমিতা চুপচাপ রুচিরার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রুচিরা চোখ মেলে তাকায়; সরাসরি পারমিতার চোখে চোখ । তারপর পারমিতাকে বলে-‘আপনি আবার কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই বলতে যাচ্ছি। তাছাড়া একজনকে না হয় একজনকে তো বলতেই হবে। 
না, না কী যে বলেন। অবশ্যই বলতে পারেন। তবে এর আগে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, কারণ আমি ফার্স্ট ইয়ারে আর আপনার ব্যাপারে জানি।- এই বলে পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পারমিতা। 
পারমিতার কথার পিঠে কথা না বলে রুচিরা চোখজোড়া নীল আকাশের বুকে মেলে দিল। তারপর স্মৃতির পাতায় টেনে নিয়ে গেল পারমিতাকে - আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে মাত্র ভর্তি হয়েছি। সম্ভবত মাস তিনেক ক্লাস হয়েছে। বাড়ি থেকে চিঠি এলো, বাবা লিখেছেন চিঠি পাওয়া মাত্রই যেন বাড়ি চলে যাই। তারপর যথারীতি চলে গেলাম। 
অনেক বছর পর মা আমাকে নিয়ে এক বিছানায় ঘুমুতে বলেন। এটা-সেটা গল্প বলার পর মা আমাকে বলেন- তোর জন্য একটি পাত্র দেখছি। অবশ্য কথাবার্তা ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। সব কথা আমার অজান্তেই উনারা সেরে রেখেছেন। 
আমি কোন কথা বললাম না। চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। 
মা বলে চলেন, পাত্রটি খুবই ভালো। আমেরিকা ফেরত । উচ্চ শিক্ষিত। দেখতে খুবই সুন্দর এবং স্মার্ট। তোর সাথে বেশ মানাবে। এবার বিয়ে-শাদী করে দেশেই থেকে যাবে। তাছাড়া পরবিারটাও বেশ ভালো এবং সচ্ছল। 
 
চলবে...

লেখক সম্পর্কে

পার্থসারথি পার্থসারথি লেখক