ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-১৬)
১৬ জুন ২০২৪
পার্থসারথি
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের ধারাবাহিক উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব- ১৬
আর অভীক মজুমদার ভাবছেন কয়েকদিনের মধ্যে সুদেষ্ণা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর কোনদিনে সুদেষ্ণার ভালোবাসার স্পর্শ পাওয়া যাবে না। নবাগত শিশুটি হবে মাতৃহারা। মায়ের ভালোবাসাহীন জগতে বেড়ে ওঠবে। ধরে রাখতে পারেনি অভীক মজুমদার নিজেকে। অবোধ শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠলেন আবার। কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী সুদেষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলেন।
পারমিতা এবার চমকে ওঠল। দিদি আবার অসুস্থ হয়ে গেল না কি? অসুস্থ হলে তো দাদাবাবু এসে ডাকতেন। না , অন্য কোন প্রবলেম হবে হয়তো । ঘরের ভেতরই পায়চারি করতে লাগল।
সুদেষ্ণাকে জড়িয়ে থেকে কাঁদতে লাগল- সুদেষ্ণা, আমি তোমাকে যেতে দেব না, আমি তোমাকে যেতে দেব না!
সুদেষ্ণার মনে এবার সন্দেহ জাগে। চুপচাপ চিন্তা করতে থাকেন- আগে অবশ্য মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিত। কিছুক্ষণ থেকে আবার ঠিক হয়ে যেত। কিছুদিন যাবৎ মাথাটা কেমন ঝিম ধরে থাকে। আর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সর্বক্ষণ সারাটা শরীর কেমন যেন আলগা আলগা মনে হয়। পুরো শরীরটাই একটা অতিরিক্ত বোঝার মত লাগে। তাহলে কি কোন কঠিন অসুখ বাঁধিয়েছি? আমি তার বিন্দু বিসর্গও জানি না! তাহলে কি আমি!- সুদেষ্ণা আর ভাবতে চায় না। বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিয়ে চুপচাপ থাকে।
গোপনে গোপনে দাদাবাবুকে লক্ষ্য রাখছে পারমতিা । যেন দাদাবাবু বুঝতে না পারে। দেখতে দেখতে অভীক মজুমদার কেমন শুকিয়ে গেছেন এই ক'দিনে। চোখের কোণে জমেছে কালির ছোপ। চোখ দুটো কোটরাগত, চুলে যত্নের হাত পড়ে না চেহারা দিনকে দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে। আর নিজেকে তিনি ক্রমশঃ গুটিয়ে নিচ্ছেন।। মোটকথা উদভ্রান্তের মত চলাফেরা করছেন। অথচ বাইরে তা প্রকাশ করছেন না। অফিস ঠিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন। অভীক মজুমদার বোধহয় টের পেয়ে গেছেন যে পারমিতা উনাকে সব সময় লক্ষ্য করছে। তাই পারতঃপক্ষে পারমিতার মুখোমুখি হন না। দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ চলে গেল। অভীক মজুমদার নিজেকে সামলাতে পারছেন না। কেমন ফুরুৎ ফুরুৎ করে দিনগুলো চলে যাচ্ছে। আর মাত্র ক'টা দিন হাতে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছেন। এই ক'টা দিন সুদেষ্ণার সান্নিধ্যে সান্নিধ্যে একটু থাকা খুবই দরকার।
আজ রোববার। অথচ দাদাবাবু অফিসে যাননি। পারমিতা এগিয়ে আসে দাদাবাবুর কাছে। প্রথমে দাদাবাবুই জিজ্ঞ্যেস করে- লেখাপড়া কেমন চলছে?
পারমিতা জবাবে বলে- মোটামুটি চলছে। এই বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পারমিতা আবার বলে- আজ অফিসে গেলেন না?
ছুটি নিয়ে নিয়েছি।- অভীক মজুমদার খুব স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন।
দিদি ক্লিনিক থেকে চলে এল অথচ এখন ছুটি নিচ্ছেন ব্যাপারটা কী?- বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করে পারমিতা। এবং বলেই চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে।
শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না।- কিছু একটা লুকোবার প্রচেষ্টা অভীক মজুমদারের কণ্ঠে।
পারমিতার দৃষ্টিকে এড়াতে পারেননি। পারমিতা জানতে চায়- দাদাবাবু, আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার কাছে কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছেন।
অভীক মজুমদারের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পরক্ষণইে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন- না, না তোমার কাছে কী লুকাব?
দেখুন আমাকে এড়াবার চেষ্টা করবেন না। আপনি একটা কিছু লুকাবার চেষ্টা অবশ্যই করছেন।- বেশ দৃঢ়তার সাথেই পারমিতা জানতে চায়।
বিশ্বাস কর, আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাচ্ছি না।
দাদাবাবু আমি ওই রাতে সজাগ ছিলাম। আপনার কান্নাটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে।
অভীক মজুমদার ভীষণ রকম একটা ধাক্কা খেলেন যেন। তারপর নির্জীব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। পারমিতা তুমি তোমার রুমে গিয়ে বসো। আমি একটু পরে আসছি। তোমাকে সব খুলে বলবো।- এই বলে অভীক মজুমদার উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
পারমিতার নিজের রুমে চলে আসে। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অভীক মজুমদার চলে এলেন। পারমিতা পায়চারি থামিয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয় অভীক মজুমদারকে। অভীক মজুমদার চেয়ারটা টেনে বসেন। পারমিতা কাছাকাছি হয়ে খাটের এক কোণে বসে।
আমি ক’দিন ধরেই ভাবছি তোমাকে সব খুলে বলব। কিন্ত বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কথা বলেন অভীক মজুমদার, কিন্ত দৃষ্টি অন্যদিকে। পারমিতা দাদাবাবুর দিকে তাকায়। কোন কথা বলে না।
সব তোমাকে খুলে বলব। কিন্ত কাউকে বলো না।- অভীক মজুমদার অনুরোধ করেন।
বলার না হলে অবশ্যই গোপন রাখব।- জবাবে পারমতিা বলে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেন অভীক মজুমদার। একটা সিগারেট মুখে গুজে দিয়ে তাতে আগুন ধরান। লম্বা একখানা টান দিয়ে তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন- সিজার করানোর পরদিন থেকেই কিন্তু তোমার দিদির অবস্থা ক্রমশ খারাপে দিকে। সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই ডাক্তারের পরামর্শে করোনা হল। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু শেষে ব্লাডে ধরা পড়ে। কিছুক্ষণ থেমে থেমে আবার বলেন- ব্লাড টেস্টে দেখা গেল তোমার দিদির ব্লাড ক্যান্সার। আমি উদভ্রান্তের মতো একের পর এক ডাক্তারের কাছে যাই এবং আরও কয়েকবার ব্লাড টেস্ট করাই। সব সময় একই রেজাল্ট আসে।
কথাগুলো শোনার পর পারমিতার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসে। কথা বলার এতটুকু শক্তি শরীরে নেই। নির্বাক হয়ে বসে আছে। সারা শরীরে অসম্ভব রকমের মৃদু কম্পন শুরু হয়ে গেল। গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কোলের উপর।
অভীক মজুমদার বলে চলেন- এই অসুখের শুরু আরও অনেক আগে থেকেই । তোমার দিদি গোপন করে রেখে গেছে অথবা পাত্তা দেয়নি। এমন সময় রোগটা ধরা পড়ল যখন আর কোন কিছুই করার নেই। তবুও আমার পীড়াপীড়িতে ডাক্তার শেষ পর্যন্ত বলল- চেষ্টা করলে বড়জোড় মাস দুয়েক আয়ু বাড়তে পারে কিন্তু কষ্টের মাত্রাটা এতই হবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না । এবং নিয়ে যেতে হবে বিদেশে। এছাড়া কোনরকম সম্ভবনা নেই। অনর্থক দৌড়াদৌড়ি না করে যতদিন বাঁচবে ততদিন উনাকে ভালোভাসায় ভরিয়ে রাখুন। শেষ দিনগুলো উনাকে শান্তিতে থাকতে দিন। তোমার দিদির প্রতি আমার ভালোবাসাটুকুই সম্বল। ভালো চিকিৎসা করিয়ে তোমার দিদিকে যে আরও কিছুদিন আগলে রাখব সে সুযোগটুকু আমার নেই। অভীক মজুমদারের কথায় অপরাধবোধ ফুটে ওঠল।
চলবে...