ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-১৮)
১৬ জুন ২০২৪
পার্থসারথি
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের ধারাবাহিক উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-১৮
রুচিরা পারমিতাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। আর পাশাপাশি সৈকত। আর্টস বিল্ডিংয়ের মেইন গেইটের সামনের মাঠের সবুজ ঘাসের উপর ওরা তিনজন বসল। পিচ্চিটাকে ডাকতেই তিন কাপ চা দিয়ে গেল। সৈকত চা শেষে সিগারেট ধরায়। পারমিতা আড়চোখে তাকাতেই সৈকত হাত জোড় করে বলে- প্লিজ, রাগ করো না। ধীরে ধীরে ছেড়ে দেব। হঠাৎ ছাড়তে অসুবিধা হচ্ছে।
পলকহীন দৃষ্টিতে পারমিতা তাকায়, তারপর বলে- ধীরে ধীরে বলতে আবার বছর লাগিওনা যেন।
ঠিক আছে মাহারাণী সময় নেব না।- হাত জোড় করে মুচকি হাসি হেসে সৈকত বলে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে পারমিতা রুচিরাকে বলে- ‘রুচিদি, কিছু মনে করো না। আজ একটু তাড়া আছে। বাড়ি থেকে বাবা আসবেন। আমি এখন উঠতে চাই।
চায়ের কাপটা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে রুচিরা বলে- তাড়া থাকলে অবশ্যই যাবে। এখন ক’টা দিন একটু বিশ্রাম নাও।
পারমিতা উঠে দাঁড়ায়। সৈকত রাতে ফোন করো কিন্তু।- এই বলে আড়াচোখে তাকায় সৈকতের আশ্চর্য ভরা চোখে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নিজে ফোন করব?- সৈকতের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
পারমিতা হাসি ছড়িয়ে বলল- হ্যাঁ, তুমি নিজে ফোন করবে।
সৈকত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে- আমি ! কী ব্যাপার?
কোন ব্যাপার নয়। আজ বাবা আসবেন।- হাসিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পারমিতা বলে।
তাই বল। তোমার বাবার সাথে অবশ্য আমার ভালই জমে। ঠিক আছে ফোন করব। এই বলে সৈকত দু’কদম পিছিয়ে বলে- পারমিতা, বাবাকে আমার প্রণাম জানিও।
পারমিতার সাথে সাথে রুচিরাও হাসে। হাসি থামিয়ে পারমিতা বলে- ঠিক আছে প্রণাম জানাব। তাড়াতাড়ি একটা রিকশা করে দাও প্লিজ।
রিকশায় বসে পারমিতা হাত নাড়িয়ে বিদায় নেয়। তারপর রুচিরা ও সৈকত লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায়।
রিকশাটা বাসার কাছে পৌঁছতেই পারমিতার চোখ জোড়া বারান্দায় পৌঁছে যায়। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বারান্দায় উঠেই বাবাকে প্রণাম করল পারমিতা। ঋতেশ বাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন- পরীক্ষা কেমন দিলে মা?
ভালো দিয়েছি। তোমার শরীরটা ভালো আছে তো?- বলতে বলতে পারমিতা বাবাকে আদরে আর সোহাগে জড়িয়ে ধরে।
হ্যাঁ মা। এই শেষ বয়সেও বেশ ভালো আছি।- মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঋতেশ বাবু বললেন।
পারমিতা আর কথা বাড়ায় না। পারমিতা বুঝতে পেরেছে এই এখনই দিদির প্রসঙ্গে চলে আসবে। তারপর কান্নাকাটি করে অসুখটা বাড়াবে।
রুমে এসেই পারমিতা শরীরটাকে বিছানায় ঢেলে দিল। একটা বালিশ টেনে মুখ গুজে দিল চুপচাপ। দিদিকে খুব বেশি মনে পড়ছে ক’টা দিন ধরে। দিদি মারা গেছেন আজ প্রায় আড়াই মাস হতে চলল। পারমিতা পরীক্ষা দিতে চায়নি। পরীক্ষার ব্যস্ততায় যদি আবার দিদির রেখে যাওয়া সন্তান তৃষ্ণার অযত্ন হয় এই ভয়ে। কিন্তু অভীক মজুমদারের বক্তব্য- পৃথিবীতে কোন কিছুই থেমে থাকে না। আপন গতিতে সবকিছুই চলে। কেন মিছিমিছি একটা বছর নষ্ট করবে। তাছাড়া তোমার মা তো আছেনই। তুমি তোমার পরীক্ষা ঠিকমত দাও। তারপর অন্য চিন্তা করো। ঠিক, একদম ঠিক! পৃথিবীতে কেউ কারো জন্যে চিরদিন বসে থাকে না। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে সকল দুঃখ-কষ্ট মনের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে লীন হয়ে আসে। কষ্টের এবং দুঃখের বোঝা মনের অজান্তেই হালকা হ'তে থাকে। এই যেমন, সুদেষ্ণা সবাইকে কাঁদিয়ে অথৈ দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেল। সুদেষ্ণার অন্তিম যাত্রায় সবাই যেন আচমকা দুঃখ আর কষ্টের ভেতর ডুবে গেল। তারপর ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই কেমন যেন একটু একটু করে স্বাভাবিক হ'তে চলল। মানুষের জীবন-মৃত্যু সবই যেন ঋতু চক্রের পালাবদলে সীমাবদ্ধ।
পাশে কেউ বসেছে পারমিতা টের পেল। কিন্তু দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায়নি। কিছুক্ষণ নীরবতা। পারমিতার মাথায় হাত রেখে প্রভাময়ী দেবী বলেন- কিরে মা, এই অসময়ে শুয়ে আছিস? হাত-মুখ ধুয়ে কিছু একটা মুখে দিয়ে নে।
পরমিতা শুয়ে শুয়ে বলে- একটু পরে উঠছি মা।
প্রভাময়ী দেবী পারমিতার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। পারমিতা বুঝতে পেরেছে যে- মা নিশ্চয়ই কিছু বলবেন। মা সবসময় যেমন আদর করেন তেমনি আবার কিছু কিছু ব্যাপারে বেশ কঠিন। আবার যখন কোন উপলক্ষ্য ছাড়া আদর করেন, তার মানে কোন উদ্দ্যেশ্য মনের ভেতর আছে।
পারমিতা চুপচাপ শুয়ে আছে। প্রভাময়ী দেবী পারমিতার কপালে হাত রাখেন। তারপর বলেন- মা উঠ, আগে মুখে কিছু একটা দিয়ে নে। তারপর আবার শুয়ে থাকিস।
পারমিতা উঠে বসে। তারপর মার দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টি নিয়ে। পারমিতাকে আরেকটু আদর করে প্রভাময়ী দেবী রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
পারমিতা বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। বেসিনে গিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটায়। তারপর মুখে তোয়ালে বুলাতে বুলাতে ড্রেসিং টেবিলে গিয়ে চুলটা ঠিক করে যায় ডাইনিং টেবিলে। প্রভাময়ী দেবী নিজ হাতে মেয়েকে খাওয়ালেন। খাওয়ানোর এক ফাঁকে মা বললেন- পারমিতা তোর বাবাকে আমিই খবর দিয়ে আনিয়েছি।
এক বাক্যে উত্তর দিল পারমিতা- খুব ভালো হয়েছে।- বলেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে পারমিতা।
এনেছি একটা কাজে।- মা প্রভাময়ী দেবী বলেন।
কী কাজে?- মায়ের কথা শুনে পারমিতা একটু অবাকই হয়।
মা একটু ভেবে বলেন- তুই খেয়ে তোর রুমে যা। তোর বাবাকে নিয়ে একটু পরে আমি আসব। তখনই সব বলব।
পারমিতা মাথা নাড়ে- আচ্ছা, ঠিক আছে মা। পারমিতা আর কোন কথা বাড়ায় না। রুমে এসে পারমিতা চুপচাপ শুয়ে থাকে। কপালের উপর দুটো হাত আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, বেশ চিন্তা-ভাবনায় ডুবে আছে। সত্যি বলতে কী দিদির মৃত্যুটা দারুণভাবে নাড়া দিয়ে গেছে পারমিতাকে। দিদির মৃত্যাটাকে সে সহজে মেনে নিতে পারছে না। তার ওপর মেয়েটা কেমন অসহায় হয়ে গেল। দিদি ছিল একজন চমৎকার পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যার ভেতর ছিল আকাশের মত স্বচ্ছ আর নির্মল। আকাশের অসীমতাও ছিল দিদির সারা বুক জুড়ে। - সবাইকে ভীষণরকম ভালোবাসতো আর অতি অল্প সময়েই আপন করে নিতে পারতো। দিদিরা হয়তো এমনই হয়। ভালোবাসার মাঝে কোন রকম কৃপণতা ছিল না।
চলবে...