ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-১৯)
১৬ জুন ২০২৪
পার্থসারথি
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের ধারাবাহিক উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-১৯
রুমে ঢুকেই ঋতেশ বাবু গলা খাকাড়ি দেন। পারমিতার চিন্তার জগতে যতি পড়ে। উঠে বসতে বসতে পারমিতা বলে- বাবা, এস বসো।
বাবা বসতে বসতে মা-ও চলে এলেন।
বাবা কী কথা দিয়ে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মায়ের দিকে একবার তাকালেন। মা চোখ নেড়ে ইশারা করলেন কথা শুরু করার জন্য। বাবা তবুও কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে তারপর শুরু করলেন- মা পারমিতা, তৃষামনি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে। ওকে একটু নিজের মত করে মানুষ করিস।
পারমিতা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে- বাবা, আমি কি তৃষার প্রতি কোনরকম অযত্ন করেছি?
না মা, সে কথা নয়। তুই ছাড়া তৃষামনিকে আর কে দেখবে? আমরাতো আর সবসময় থাকতে পারবো না?
ঠিক আছে বাবা, তোমরা এ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করো না। আমি যতটুকু পারি করবো। আমার অজান্তে কোন অযত্ন আমি করবো না।- পারমিতা মা-বাবাকে বুঝাতে চষ্টো কর।
সে কথা তোকে বলতে হবে না। ঋতেশ বাবু একটু আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করেন। আমরা একটু অন্যরকম চিন্তা ভাবনা করছি।
পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে- তোমরা কী ধরণের ভেবেছ জানতে পারি কি?
মা, তুই আমাদের ভুল বুঝিস না। তোর অমঙ্গল হবে এমন চিন্তা-ভাবনা কখনও করিনি। তাছাড়া অভীক চমৎকার ছেলে। তোর দিদির স্মৃতিকে আগলে রাখ মা। এই আমাদের অনুরোধ।
পারমিতা নির্বাক । এ রকম চিন্তা ভাবনা মা বাবা করবেন তা পারমিতার মনের ভেতর কোনদিন আসেনি। আসার কথাও না। কারণ পারমিতার হৃদয়-জগৎ জুড়ে একজনের নিত্য আনাগোনা। মনের পুরো বাগানটি জুড়েই সৈকতের একাধিপত্য। সৈকত ছাড়া অন্য কারও কথা মনের ভেতর কখনও ঠাঁই দেয়নি পারমিতা। পারমিতার ইচ্ছে ছিল রাতে যখন সৈকত ফোন করবে তখন বাবাকে ব্যাপারটি বলবে এবং প্রয়োজনে বোঝানোর চেষ্টা করব। তাছাড়া পারমিতা দাদাবাবু অভীক মজুমদারকে খুবই শ্রদ্ধা করে। তিনিও পারমিতাকে দারুণ স্নেহ করেন। এছাড়া অন্য কোন চিন্তা কোন দিন মনের ভেতর উঁকি পর্যন্ত দেয়নি। আর আজ শেষ পর্যন্ত মা-বাবা কি-না! চিন্তার জগত পেরিয়ে এসে পারমিতা অতি কষ্টে উচ্চারণ করে- বাবা!
বল মা।- এই বলে ঋতেশ বাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বাবা, তোমরা অন্য চিন্তা করো প্লিজ।- এই বলে পারমিতা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মা প্রভাময়ী দেবী পারমিতাকে কোলে টেনে নেন। স্নেহের হাত মাথায় বুলাচ্ছেন। বাবা, ঋতেশ বাবু ধরা গলায় বলেন- কাঁদিস না মা, তোকে আমরা জোর করব না। তুই চিন্তা-ভাবনা কর। তুই এখন বড় হয়েছিস। তোর মতামত অবশ্যই থাকবে। তবে এটুকু জেনে রাখিস, তোর অমঙ্গল হবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা অভীক যদি অন্য কোন মেয়েকে তুলে আনে তাহলে তৃষার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। তৃষাকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। তৃষা কষ্ট পেলে তোর দিদির আত্না শান্তি পাবে না।
কথাগুলো কানে পোঁছামাত্রই দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো পারমিতার কানে ষ্পষ্ট হয়ে বেজে ওঠে।
মা, না করিস না। অভীককে অনেক বুঝিয়ে তবে রাজী করিয়েছি। এখন তুই না করলে ও ভীষণ কষ্ট পাবে। তাছাড়া আমাদের ভাববে কী?- মা প্রভাময়ী দেবী খুব শান্ত গলায় বললেন।
মা এবং বাবা যেভাবে কথা বলেছেন পারমিতা রাগ করার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। অবশ্য পারমিতা কাছে আসার আগে ঋতেশ বাবু প্রভাময়ী দেবীকে বারবার বারণ করে এসেছেন, কোনমতেই যেন তিনি পারমিতার সাথে রাগারাগি না করেন। এখানেই পারমিতার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারমিতা উভয় সংকটে আছে। যদি বাবা কিংবা মা রাগ করে বলতেন তবে একটা কিছু সরাসরি কঠোরভাবে বলা যেত। পারমিতা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।
মা এই শেষ বয়সে তোদের সুখী দেখে যেতে চাই। মা-বাবা ছেলে-মেয়েদের অমঙ্গল কখনও চিন্তা করে না। তাছাড়া তোর ওপর আমার সবসময় আস্থা ছিল এবং এখনও আছে।- এই বলে ঋতেশ বাবু চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পারমিতা চুপচাপ , নিঃশ্বাসও যেন থেমে আছে। দৃষ্টি সরিয়ে অভিমান ভরা মন নিয়ে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। মনের ভেতর হাজার কথার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পারমিতা এখন কোন কথাই বলতে পারছে না।
ঋতেশ বাবু পারমিতার হাত ধরে বলেন- মা, তুই অমত করিস না। তাহলে আমরা শান্তিতে মরতে পারব না। ঋতেশ বাবুর কণ্ঠস্বরটা কেমন বেসুরো মনে হচ্ছ্। পারমিতা তাকায়, বাবার চোখে জল। পারমিতার ভেতরটা কষ্টের ঝড়ে হু, হু করে ওঠে।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে- বাবা, আমাকে একটু সময় দাও।
ঋতেশ বাবু ইশারা করতেই প্রভাময়ী দেবী উঠে চলে গেলেন।
শান্ত হও মা, শান্ত হও!- ঋতেশ বাবু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন।
বাবার বুকে কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে পড়ে রইল পারমিতা। তারপর পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। মাকে দেখতে না পেয়ে একটু সাহস পায় এবং বলে- বাবা, আমার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে। আমি ওর কাছে কী জবাব দেব?
ঋতেশ বাবু মর্মার্থটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। অবশ্য পরক্ষণই মুখমগুলটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মেয়ে বলে কি! কপালে চিন্তার রেখা বলি হয়। পারমিতা ব্যাপাটা বুঝতে পারে। ঋতেশ বাবু হতাশাগ্রস্ত এবং শংকায় কাবু হয়ে বসে আছেন।
পারমিতা বলে- বাবা, সৈকত আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে। আমিও ওকে ভীষণ ভালোবাসি।
ঋতেশ বাবু চিন্তাচ্ছন্ন অবস্থায় পারমিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। মেয়ের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছেন না। এই মূহূর্তে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। খুব কষ্ট করে শেষে উচ্চারণ করলেন- মা এই বয়সে এমন ঘটনা সবার জীবনেই থাকে। তোর ভালোবাসাকে কিংবা ভালোবাসার জনকে উপেক্ষা করছি না। তবে ভালোবাসা কি শুধু মিলনেই সার্থক হয়?
আশ্চর্য-ভরা দৃষ্টিতে পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। বাবার দৃষ্টি কাছে নেই, সুদূরে মেলে ধরছেন। পারমিতার দিকে না তাকিয়েই তিনি বলেন- ‘বিচ্ছেদের মধ্যেও ভালোবাসার সার্থকতা থাকে। তখন ভালোবাসার জনকে চিরদিন বুকে লালন করা যায়। তাছাড়া বর্তমান টানাপড়েনটা মানবিক টানাপড়েন। এক্ষেত্রে মানুষকে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। তোকে আমি কখনও কিছু বলিনি। এখনও কিছু বলতাম না।
চলবে...