ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-২০)
১৬ জুন ২০২৪
পার্থসারথি
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর (ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের ধারাবাহিক উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-২০
পারমিতা কথা বলার মত কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে শুধু বলল- সৈকত ভীষণ কষ্ট পাবে বাবা। ওর যদি কিছু হয় তাহলে তার জন্য আমি দায়ী থাকব।
ঋতেশ বাবু এবার যেন সুযোগ পেয়ে গেলেন, বললেন- তোকে যদি সত্যি সত্যি ভালোবেসেই থাকে তাহলে তোর অবস্থা বোঝা উচিত। তাছাড়া যাদের মাঝে ভালোবাসা আছে তারা ত্যাগেও প্রস্তত থাকে।
দু’জন চুপচাপ। পিনপতন নীরবতায় শুধু দেয়াল ঘড়িটা টিকটিক তালে বেজে চলছে। তারপর ঋতেশ বাবুই শুরু করলেন- এটা শুধু সময়ের ব্যাপার, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মা, তুই বড় হয়েছিস। তবুও তোর কাছে চাওয়ার আছে আমাদের । তুই ফিরিয়ে দিস না মা।
বাবার আকুল আরজিতে পারমিতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। আবার মুহুর্তে মুহূর্তে সৈকতের ছায়ামূর্তি এসে হানা দিচ্ছে। বুকের ভেতর কষ্টের কুয়াশা জমাট বাঁধছে ক্রমশ। পারমিতা নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। ঋতেশ বাবু ভাবলেন এই মূহূর্তে কথা বলা আর ঠিক হবে না। মনটা দুর্বল হয়ে এসেছে। একটু কাঁদতে দেয়া উচিত। কাঁদুক, বুকটা হালকা হবে । ঋতেশ বাবু শব্দগহীনভাবে উঠে চলে এলেন।
পারমিতার সারাটা রাত কেটেছে এক দ্বন্দ্বমুখর অন্তর্ঘাতে। ভাবনার সীমানায় সৈকতকে নিয়ে একটি নিজস্ব জগতের স্বপ্ন যখনই আঁকে তখন দিদির আকুতি মাখা মুখ অসহায় তৃষার নির্মল চাহনি, অভীক মজুমদারের ছিন্নভিন্ন মূহূর্তের প্রতিচ্ছবি আর মা-বাবার আকুল আর্তি এসে পারমিতাকে হানা দেয়। পারমিতা ঠিক থাকতে পারে না। এক সময় বাধ্য হয়েই পারমিতা সৈকতের প্রতিচ্ছবি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর মনে মনে দুঃখী উচ্চারণ- আমাকে ভুল বুঝো না সৈকত ! তুমি সুখে থেকো, তুমি সুখে থেকো!- এর বেশি কিছু আর ভাবতে পারে না পারমিতা।
ঋতেশ বাবু, প্রভাময়ী দেবী ও অভীক মজুমদার নাস্তার টেবিলে। পারমিতার জন্য অপেক্ষা। অভীক মজুমদার লজ্জায় গুটিশুটি মেরে চুপচাপ বসে আছেন। দৃষ্টি সীমানা খুবই কাছে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে অভীক মজুমদারের । ঋতেশ বাবু কাজের মেয়েটিকে দিয়ে পারমিতাকে ডেকে পাঠালেন।
পারমিতার দু’চোখ অসম্ভব রকম ফোলা ফোলা এবং লাল হয়ে আছে। মাটিতে দৃষ্টি রেখে পারমিতা এগিয়ে এল। বাবার পাশের চেয়ারটায় বসল। কারও দিকে এক পলক তাকায়নি পারমিতা। অন্যদিন হলে দাদাবাবু কী খাচ্ছেন না-খাচ্ছেন তার খোঁজ-খবর নিত। অভীক মজুমদারও যথারীতি সুবিধা-অসুবিধা অকপটে বলতেন। কিন্তু আজ চোখ তুলে একবারও পারমিতার দিকে তাকালেন না। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছেন। নাস্তাটা শেষ করেই অভীক মজুমদার যেন পালিয়ে বাঁচলেন।
পারমিতা সেই তখন থেকে প্লেটে খুটে খুটে খাচ্ছে। ঋতেশ বাবু মেয়ের দিকে তাকালেন এই প্রথম। মেয়ের অবস্থা দেখে বুকটা হু, হু করে কেঁপে ওঠল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মেয়েকে বললেন- কেন মা নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস। তোর ভালর জন্যই তো আমরা এরকম ভাবছি।
প্রভাময়ী দেবী এবার ক্ষেপে উঠলেন, বললেন- মেয়েদের এতো নানা বাহানা থাকলে চলে না। মা-বাবার কথা শুনতে হয়। কোন মা-বাবা তাদের সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে না।
পারমিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- আমি কি তোমাদের কিছু বলেছি? আমার কষ্টটাকেও আমি নিজের মত করে লালন করতে পারবো না? তোমরা যা বোঝ কর। কথাগুলো বলে আবার শান্তভাবে বাবাকে বলে- বাবা, আমি একটু ক্যাম্পাসে যাচ্ছি দুপুরের আগেই চলে আসব।
‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোন কথার জন্যই পারমিতা অপেক্ষা করেনি। সোজা নিজের রুমে চলে আসে। চুলে চিরুনিটা বুলিয়ে পার্টসটা তুলে নেয় হাতে। তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে।
এত সকালে পারমতিাকে আশা করেনি রুচরিা। পারমিতাকে উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে। পুরো শরীরে একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে রুচিরা বলে- পারমিতা তোমার কী হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে কাল সারারাত ঘুমোওনি।
পারমিতা দৃষ্টি লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। রুচিরা আরও কাছাকাছি হয়ে বসে। গভীর দৃষ্টি নিয়ে রুচিরা পারমিতাকে দেখে। চোখ দেখেই বোঝা যায় পারমিতা কষ্টের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। পারমিতাকে দেখে রুচিরার কষ্ট হচ্ছে। রুচিরা একহাতে পারমিতাকে আগলে ধর ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলে- প্লিজ, আমাকেও কষ্টে ফেলো না। সব খুলে বল আমাকে।
পারমিতা রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পারমিতার পিঠে হাত রেখে রুচিরা বলে- শান্ত হও পারমিতা, শান্ত হও।
পারমিতা সব কথা রুচিরাকে খুলে বলে। সব কথা শোনার পর রুচিরা কথা বলার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। যেন বিস্ময়তায় কেটে গেল হাজার নিঃশ্বাসের মুহূর্তে।নীরবতা ভেঙে পারমিতা বলে- দিদি, তুমি সৈকতকে একটু বুঝিয়ে বলো, ও যেন আমাকে ভুল না বোঝে।
রুচিরা বেশ চিন্ততি হয়ে পড়ে। তারপর একটা র্দীঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পারমিতাকে বলে- যদিও তোমার কিছু করার ছিল না। কিন্তু সৈকত খুবই কষ্ট পাবে। কারণ তোমাকে নিয়ে ও অনেক স্বপ্নের ভুবন তৈরি করে নিয়েছে। ওকে যে কিভাবে বুঝিয়ে বলব! চিন্তুা করে কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না। তবে মুখ্য ভূমিকা তোমাকেই পালন করতে হবে।
প্লিজ দিদি, আমি ওর মুখোমুখি হতে পারবো না। ওর কষ্ট দেখে আমি সহ্য করতে পারব না। তুমিই ওকে বুঝিয়ে বলো।- কথা বলতে বলতে পারমিতা রুচিরার হাত জড়িয়ে ধরলো।
তুমি নিজে গিয়ে বললে ভালো হতো না?- বলেই রুচিরা পারমিতার চোখে চোখ রাখে।
না দিদি, আমি যেতে পারব না? তুমিই বুঝিয়ে বল।- পারমতিা আকুল মিনতি করে রুচিরাকে বলে।
রুচিরা কিছু একটা ভাবে। তারপর পারমিতাকে বলে- ঠিক আছে, তুমি চিন্তা করো না। আমি সৈকতকে সব বুঝিয়ে বলবো।
পারমিতা একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে- রুচিদি, তুমি খুব ভালো।
জবাবে রুচিরা শুধু হাসে। কোন কথা বলে না। মনের ভেতর নানান কথার তোলপাড় চলে। কিন্তু মনের ভেতর মন খারাপের হাওয়া বইতে শুরু করে সৈকতের কথা ভেবে। বাহির থেকে রুচিরাকে দেখে কিছুই বুঝবার উপায় নেই।
অল্পক্ষণ পরই রুচিরা সৈকতের উদ্দেশে রওনা হয়। ঘটনা শোনার পর থেকেই রুচিরার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। আর এখন গিয়ে কীভাবে যে কথাটা উত্থাপন করবে তার শুরুটাই ভেবে পাচ্ছে না।
চলবে...