ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-২৭)
১৬ জুন ২০২৪
পার্থসারথি
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর (ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের ধারাবাহিক উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-২৭
*
গভীর রাত। জানালার কাছে বসে সৈকত বাইরে তাকিয়ে আছে। হলের প্রায় সব রুমেরই বাতি নেভানো হয়ে গেছে। একটা দুটো রুমে বাতি জ্বলছে। অনিকও ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ । চারদিক বেশ নীরব। কিছুক্ষণ পরপর শুধু ন্যাড়া কুকুরগুলো ডেকে ওঠছে। একাকিত্ব সৈকতকে ভীষণ রকম পেয়ে বসেছে। পারমিতাকে মন থেকে মুুছে ফেলতে পারছে না সৈকত। একাকি হলেই পারমিতার প্রতিমূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে এসে সামনে হাজির হয়। বারবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সৈকতের অগোছালো জীবনটাকে গোছাতে রুচিরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সৈকত বুঝতে পারে, ওর প্রতি রুচিরার অন্যরকম একটা টান আছে। গত কয়েকদিন যাবৎ রুচিরা সৈকতকে বেশ সময় দিচ্ছে। প্রথম প্রথম সৈকত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। খোঁজ করে তারপর ঠিকই বের করে নিয়েছে। প্রথম দিন ডেকে আনার পরও সৈকত ওই আড্ডায় গিয়েছিল।
কিন্তু রুচিরা নাছোড়বান্দা । পরে আবার ওখানে খুঁজতে যায়। সৈকত অবশ্য রুচিরাকে দেখতে পেয়ে আড্ডা থেকে সরে চলে আসে। এরকম কয়েকদিন করল রুচিরা।
সৈকত এখন আর ওখানে যায় না। তবে গাঁজাটা পুরোপুরি ছাড়তে পারছে না। আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আড্ডায় না গেলেও অন্য জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে টানে। আজ সৈকতের মনটা খারাপ হয়ে আছে। সারাটা দিনই আজ বেসামাল চলেছে, মনটা খারাপ হয়ে আছে অন্য কারণে। ওর মনের এবং দেহের সমস্ত কিছু যেন কেমন একটা ছন্দহীন অবস্থায় আটকে আছে। সবকিছু সামলাতে চেষ্টা করেও কেমন যেন বেসামাল হয়ে আছে।
দুপুর বেলার ঘটনা। অনেকদিন পর আজ আড্ডায় এল সৈকত। গাঁজার আড্ডাটা মাত্র জমে ওঠেছে। সৈকত হঠাৎ দেখতে পেল রুচিরা এগিয়ে আসছে। সৈকত চুপ করে উঠে চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। তারপর চলে আসে টিএসসির সুইমিংপুল এলাকায়। এখানে সহজে খুঁজে পাবে না। কারণ সুইমিংপুলটা পতিত পড়ে আছ। ফলে এলাকাটা বেশ নির্জন। শুধু বিকেলে কিছু ছেলে-মেয়ে নাটকের রিহার্সাল করতে আসে। তাছাড়া সারাদনি নীরবই থাক। টিএসসির সুইমিং পুল এলাকাটা আপাতত নিরাপদ মনে হলো সৈকতের কাছ। সামনের দাজাটা বন্ধ থাকাতে সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। আর এই ভর দুপুরে কারও আসার সম্ভাবনা নেই।
সৈকত সুইমিং পুলের ছোট্র গ্যালারিতে ঠাঁই নিল। হেলান দিয়ে আরাম করে বসে মনোযোগী হলো গাঁজা টানায়। এখন সে এক অন্য জগতে এবং আছে রাজার মতো। তবে বেশ ঝিমঝাম। গাঁজাতে একের পর এক টান বেশ আয়েশ করেই বসাচ্ছে। আর বসার ভঙ্গী দেখলে মনে হবে রাজ্য শাসনে নিমগ্ন; হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা ফেলেছে আঁড়াআঁড়ি করে। আর দৃষ্টি জোড়া আকাশের বুকে শান্ত হয়ে আটকে আছে। যেন প্রিয়তমাকে দেখছে চুপচাপ।
কাঠাফাটা রোদ্দুর। থেকে থেকে হালকা বাতাস বয়ে যাচেছ। সুইমিং পুলের পূর্বপাশে ঘাসের ওপর এক জোড়া শালিক। লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে আর কী যেন ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। দুটো শালিকই বেশ কাছাকাছি হয়ে হাঁটছে। উড়ে গিয়ে বসল ভগ্নপ্রায় মন্দিরটির চূড়ায়। সৈকতের দৃষ্টিও সাথে সাথে চলল। শালিক জোড়া ঠোঁটের উষ্ণতায় একে অপরকে আদরে-সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছে। আদর সোহাগের পালা শেষ করে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। সৈকতের মনটা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল। কারণ সৈকত এটুকু বুঝতে পেরেছে যে ওই শালিক জোড়ার ভালোবাসায় কোন কৃত্রিমতা ছিল না।
গাঁজার একটা স্টিক ধরায় সৈকত। আপন মনে টানতে থাকে। নিঃসঙ্গ সময়ের সাথে সৈকতের যেন চিরসখ্যতা। এই মুহূর্তে দেখলে তাই মনে হবে। কারণ সৈকত তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু কোন কিছুতেই দৃষ্টি আটকে নেই।
সৈকতের সাথে সাক্ষাৎ না হলেও চলবে। কিন্তু সেই তখন থেকে রুচিরা সৈকতকে খুঁজছে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। রুচিরা বুঝতে পারে, সৈকতকে এখন দরকার নেই তবুও অদৃশ্য একটা টান ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও সৈকতকে না পেয়ে রুচিরা টিএসসির ভেতর চলে আসে। বারান্দার এক কোণে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। আশপাশের ব্যস্ততা রুচিরাকে একদম টানে না।
রুচিরা মনে মনে ভাবতে থাকে, সৈকত কোথায় যেতে পারে? ভাবনার অলিগলি পেরিয়ে হঠাৎ সুইমিং পুলের কথা মনে পড়ে। রুচিরা আর দেরি করেনি। এসে দেখে সুইমিং পুলের দরজায় বড় এক তালা ঝুলছে। দরজার ফাঁক গলে রুচিরা তাকায় কিন্তু ভেতরে কিছুই দেখতে পায়নি। রুচিরা জানে সুইমিং পুলে যাওয়ার পেছন রাস্তাটা । কারণ ওর বান্ধবী একজন নাটক করে। ওর সাথেই একদিন ভেতরে গিয়েছিল পেছন রাস্তা পেরিয়ে। পেছন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে রুচিরা।
রুচিরাকে দেখতে পেয়েই সৈকত স্তব্ধ হয়ে যায়। হাত থেকে গাঁজার স্টিকটা ফেলতেও ভুলে গেছে। অবাক চোখে পলকহীন তাকিয়ে থাকে রুচিরার দিকে।
রুচিরা এসে চুপচাপ পাশে বসে। সৈকত হাত থেকে গাঁজার স্টিকটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রুচিরা তাকিয়ে দেখল। কোন কথা বলল না। রুচিরা অভিমানী হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল। সৈকত ভাবল, একটু পরেই কথা বলবে। তখন হয়ত রাগটা একটু পড়ে আসবে।
এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। সৈকত এবার সাহস সঞ্চয় করে বলে- সরি রুচিদি আর টানব না।
টানো, আরও বেশি করে টানো। আমি তোমার কে যে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে?- রুচিরার কথাগুলোতে বেশ অভিমান ঝরে পড়ে।
সৈকত লাজুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। রুচিরা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
একটা ইটের টুকরা হাতে নিয়ে রুচিরা সইমিং পুলের জলে ছুঁড়ে ফেলে। সৈকত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল। ঢিলটা পড়তেই গোলাকৃতির ঢেউটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে হালকা হয়ে তারপর মিশে গেল। যেমন ইদানীং সৈকতের কষ্টগুলো গভীর থেকে ক্রমশ হালকা হয়ে এসেছে ঠিক তেমনি। সৈকত নিজেকে আর সামলাতে পারে না। রুচিরার দুটো হাত টেনে ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে- রুচিদি আমাকে ক্ষমা করে দাও। এখন থেকে তুমি যা বলবে সব শুনব। কোনদিন তোমার অবাধ্য হবো না।
রুচিরা তাকায় না। অভিমানভরা দৃষ্টি চারদিকের বাতাসে ভালো লাগার বীজ বপন করে যাচ্ছে। রুচিরা অনুভব করে বুকের ভেতরটা এক অজানা ভালোলাগার কাঁপনে অস্থির করে তুলছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চিন্তাটা মিইয়ে যায়। কারণ সৈকত ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই। তাছাড়া রুচিরার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সৈকত হাত দুটো ধরে থেকে বলে- রুচিদি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না?
কোন উত্তর নেই।- রুচিরা চুপচাপ বসে আছে ঠিকই কিন্তু ভেতর জগতটা কেমন যেন ওলটপালট হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
তুমি যতক্ষণ কথা না বলবে ততক্ষণ হাত দুটো ধরে বসে থাকবো। এবং সম্ভব হলে আজীবন।
চলবে...