আমি কে? কী আমার পরিচয়? আমার এই পার্থিব যাত্রা কোথা থেকে কীভাবে শুরু হলো আবার এর শেষই বা কোথায়? পরিচয় দেয়ার মতো কোন কিছু কী সত্যিই আমার আছে? আমিতো আদতে কিছুই না, যার সূচনা এক অতি নগণ্য সূক্ষ্ণকণা (শুক্রাণু) থেকে আবার পরিসমাপ্তিও ঘটবে আরেক সূক্ষ্ণ কণিকায় (ধুলিকণা)। আমার আবার পরিচয়!
অথচ আমাকে নিয়ে এই আমার কত গর্ব, কত অহংকার! কত বড় আমি! কত ক্ষমতা আমার! কত মানুষ আমাকে ভক্তি করে, মান্য করে, ভয় পায়! আমার একটুখানি অনুকম্পা পেতে কত মুখ মুখিয়ে থাকে! আমার একটুখানি সুদৃষ্টি লাভে ধন্য হয় কত প্রাণ! আমি চাইলে হয়তো কারো জীবন পর্যন্ত চলে যেতে পারে। আমার কথায় কত মানুষ তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। আমার প্রশংসা, আমার গুণকীর্তণে মুখরিত সারা বিশ্ব! আমার কত যশ, কত খ্যাতি, কত প্রভাব, কত প্রতিপত্তি, কত লোক, কত বল! কত জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ আমার নখদর্পনে! আমার জ্ঞানের দিগ্বিজয়ী অগ্রযাত্রা ধূলির ধরাকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে মহাকাশের সুউচ্চ সীমায়, মহাসমুদ্রের অতল তলে। জ্ঞানের আতিশয্যে কখনো কখনো হয়তো বা আমি আমাকেই ভুলে বসি। কত শৌর্য্য-বীর্য! কত শক্তি আমার! আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে এমন দু:সাহস কার? কত শত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, মরণাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র আমার করায়ত্ত। যার ফলে গোটা দুনিয়া আমার অনুগত। অঢেল ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, হীরা-জহরত, কত ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য আমাকে ঘিরে! আমি চাইলেই এই বসুধাকে স্বর্গীয় আভায় ভরিয়ে তুলতে পারি। কী নেই আমার? জ্ঞান-বিজ্ঞান, শক্তি-ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, লোক-লসকর, ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্য, বিত্ত-বৈভব, যশ-খ্যাতি সব, সব আমার পদচুম্বন করছে। আমার জীবনকে করেছে প্রাচুর্যময়।
আচ্ছা! সত্যিই কী এসব কিছু আমার? আমিই কী আমার? আমি যদি আমার হই তবে কেন আমার শরীর আমার কথা শুনে না? কেন আমার দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়, কেন আমার কানগুলো ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যায়, দিন দিন চামড়া কেন কুঁচকে যেতে থাকে, মাথার চুলগুলো কেন সাদা হয়ে যায়, দাঁতগুলো উঠে যায়, শরীরের শক্তিমত্তা কেন হ্রাস পায়, কেন আমার জীবন প্রদীপ নিভে যায়? আমার এই ক্ষুদ্র শরীরটিকে কেন আমি বাগে আনতে পারি না?
যদি বলি এগুলো প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম, তবে কেন এই প্রকৃতিকে আমি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি না? অথচ এই আমিই মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে অজানা সব তথ্য উদঘাটন করি, পর্বতের সুউচ্চ চূড়ায় অভিযান পরিচালনা করি, ভূগর্ভের সুগভীর গহ্বরে পৌঁছে কত মহামূল্যবান বস্তু আহরণ করি, মহাসমুদ্রের অতলে ডুব দিয়ে কত কী সংগ্রহ করি, ট্যানেল নির্মাণ করি, অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ স্থাপন করে সারা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসি। তবে কেন আমার নিজের (শরীর, আত্মা, মন) উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই?
আসলে আমিই কী আমার? যে আমিত্বের গর্বে আমি দিশেহারা, যে আমিত্বের গোলক ধাঁধায় আমি সর্বদা ঘুরপাক খাচ্ছি, যে আমিত্বের করাল গ্রাসে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি সেই আমার কী গর্ব করার মতো সত্যিই কিছু আছে?