সম্প্রতি আমার এক সুহৃদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্যটি এরকম- “ছোটবেলায় গরুর রচনা পড়েছিলাম, তাই গরু চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু মানুষের রচনা পড়া হয়নি তাই মানুষ চিনতে এখনও ভুল হয়।” তার মন্তব্যটি হাস্য-রসাত্মক মনে হলেও আসলে কথাটির অর্থ কিন্তু অনেক গভীর। সত্যিই মানুষ চেনা রীতিমত কঠিন কাজই বটে। এজন্যই বোধ করি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের “Know Thyself” এই শব্দ দুটিকে তাঁর মহামূল্যবান বাণী হিসেবে গন্য করা হয়। একই কথা আরেক মনীষী অ্যারিস্টটলও বলেছিলেন-“Knowing yourself is the beginning of all wisdom”। তাছাড়া মহাগ্রন্থ আল কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতগুলোতেও (৯৬: ১-৫) কিন্তু মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও তার স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আত্ম পরিচয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা তথা জ্ঞানার্জন করা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা বলাই যায়। অথচ কত জ্ঞান-বিজ্ঞান, কত শিল্প-সাহিত্য, কত ইতিহাস-ঐতিহ্য আমরা জানার চেষ্টা করি কিন্তু মানুষ সম্পর্কে বা নিজের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ তেমন নেই। ফলস্বরূপ মানুষ চিনতে আমাদের ভুল হয়। তাই আমার আজকের লেখার বিষয় ‘মানুষ’।
২.
মানুষ কাকে বলে বা মানুষের সংজ্ঞা কী? ছোট বেলায় গরুর রচনা পড়তে গিয়ে আমরা বলতাম- গরু একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। যার চারটি পা, দুটি কান, দুটি চোখ, দুটি শিং বিশিষ্ট একটি মাথা ও একটি লম্বা লেজ আছে। একইভাবে মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে যদি বলা হয়, মানুষ একটি প্রাণী যার দুইটি হাত, দুইটি পা, দুইটি চোখ, দুইটি কান, একটি নাক, একটি মুখ ও একটি মাথা বিশিষ্ট শরীর রয়েছে। এটুকু বললেই কি মানুষের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। এর উত্তর হলো- না। তার কারণ শুধু মানুষের মতো শারীরিক কাঠামো বা অবয়ব থাকলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ হতে হলে প্রথমত মানুষের মতো আকার-আকৃতি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তন্ত্র, কলা-টিস্যু ইত্যাদি থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত আত্মা বা প্রাণ এবং তৃতীয়ত মন থাকতে হয়। এই তিনটির সামষ্টিক রূপকেই মানুষ বলা যায়। আর এখানেই মানুষ নামের তাৎপর্য। প্রাণ থাকলেই আমরা তাকে প্রাণী বলি আর মানুষ হতে হলে প্রাণের সাথে মনও থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ মন আছে বলেই আমরা মানুষ। চলুন একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি- একটি কম্পিউটার যেমন কিছু হার্ডওয়্যার (মনিটর, সিপিইউ, কীবোর্ড, মাউস) ও সফটওয়্যার (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) এর সমন্বয়ে গঠিত, ঠিক একইভাবে মানুষও শরীর (হার্ডওয়্যার), আত্মা ও মন (অপারেটিং ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার) এই তিনটির সমন্বয়ে সৃজিত একটি প্রাণী যাকে অন্যান্য সকল সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদেরকে জলে-স্থলে চলাচলের জন্য বাহন দিয়েছি, তাদেরকে উত্তম জীবিকা (পবিত্র রিযিক) দিয়েছি এবং তাদেরকে আমার অনেক সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (১৭:৭০)।”
৩.
মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য হলো তার মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি ইত্যাদি। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যাপিত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে টিকে থাকতে হয়। যেমন- মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা ক্ষুধা নিবারণের জন্য তাকে মেধা খাটাতে হয়। অন্যান্য সৃষ্টি বা পশু-পাখি যেখানে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাবার সরাসরি গ্রহণ করে, মানুষকে সেখানে তার মেধা খাটিয়ে খাদ্য উৎপাদন, চাষ, খাদ্যের উৎস সন্ধান, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে তার খাদ্যের সংস্থান করতে হয়। একইভাবে তার লজ্জা নিবারণ, বাসস্থান তৈরি, চিকিৎসাসহ জীবনের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের জন্য কত প্রযুক্তি, কত কলা-কৌশল রপ্ত করতে হয়, কত জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ করতে হয়। এজন্যই মানুষকে এই মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের আরেকটি আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো- মানুষকে স্রষ্টা কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য সৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে একটি নিয়মের অধীন। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে কিছু বিষয়ে (জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে উঠা, বিভিন্ন জৈবিক বিষয়াবলী ইত্যাদি) নিয়মের অধীন ঠিকই, তবে তার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। তৃতীয়ত, মানুষের রয়েছে চিন্তা ও কল্পনা করার ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে তার জৈবিক চোখ ছাড়াও কল্পনার চোখ দিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের অনেক কিছু দেখতে পারে। চতুর্থত, মানুষের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার মনের ভাব, চিন্তা-কল্পনাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। আবার সেই ভাবকে প্রতীক, সংকেত বা চিহ্নের মাধ্যমে লিপি আকারেও প্রকাশ করতে পারে। যা এই মহাবিশ্বে অন্য কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্বব নয়। সর্বোপরি, মানুষকে এই সৃষ্টি জগতের অনেক কিছুর উপর আধিপত্য করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
৪.
তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বহন করে না। কারণ মানুষের মাঝে একাধারে দুইটি বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্য রয়েছে- মনুষ্যত্ব ও পশুত্ব। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একদিকে যেমন সৃষ্টির সেরা হওয়ার মতো গুণাগুন দিয়েছেন অন্যদিকে তার মাঝে এমন কিছু প্রবৃত্তি দিয়েছেন যা তাকে মহাবিশ্বের নিকৃষ্টতম অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারে (আল কুরআন, ৯৫ : ৪-৫)। আর বিপরীতমুখী এই দুইটি স্বভাবের মাঝে যার মধ্যে যেটির আধিক্য পরিলক্ষিত হয় সে সেই দলভূক্ত। সুতরাং মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ‘মনুষ্যত্ব’। আর মনুষ্যত্ব হলো সেসকল গুণাবলীর সমষ্টি (দয়া-মায়া, প্রেম-ভালোবাসা, মহানুভবতা, উদারতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেকবোধ, চিন্তাশীলতা, সভ্যতা, সৌন্দর্য্যবোধ, শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্ততা, পরিচ্ছন্নতা, সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি) যা মানুষকে অন্যান্য সকল প্রাণী বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। মানুষকে একদিকে যেমন ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আবার এই মহাবিশ্বের হেন অপকর্ম নেই যা মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। তাইতো আমরা দেখি হত্যা-মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বৃক্ষ নিধন, পাহাড় ধ্বংস, কার্বন নিঃসরণ, জলাশয় ভরাট ইত্যাদি), পরিবেশ (বায়ু, পানি, মাটি) দূষণসহ জলে-স্থলে যত ধরণের অনিষ্ট সবই মানুষেরই কর্ম।
মোদ্দাকথা, মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচায়ক হলো ‘মনুষ্যত্ব’। মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তি আকারে অবয়বে মানুষের মতো দেখালেও আদতে সে মানুষ নয়। আর এদের জন্যই ‘অমানুষ’ শব্দটির উদ্ভব ও প্রয়োগ। তাইতো বলা হয়- There is a big difference between Human Being and being Human.