“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন ‘মানুষ হইতে হবে’ - এই তার পণ,
সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ- ‘মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন’।
কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার সবারি রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার,
হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ।”
শৈশবে পড়া কুসুমকুমারী দাসের আদর্শ ছেলে কবিতাটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব মনে পড়ছে। পুরো কবিতাটিতে মোটাদাগে দুইটি বিষয়ে কবির প্রত্যাশা/আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এক, কাজ প্রিয় ছেলে। অর্থাৎ কোন কাজকেই ছোট না ভেবে সকল অভাব-অভিযোগ, ভয়-ভীতিকে অতিক্রম করে কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন ছেলে। দুই, মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়া।
২.
যখন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর নানা প্রতিকূলতা, অভাব-অভিযোগ, সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে বিশ্ব-দরবারে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অর্থনীতি, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠমো, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তিসহ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র যখন উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে ঠিক তখনই নিত্য নতুন কিছু সংকট আমাদের এই উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এমনই এক সংকটের নাম ‘মূল্যবোধ বা নৈতিকতার সংকট’। বিষয়টি যদিও নতুন নয় তথাপি সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু ঘটনায় দেশের জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবীমহল ও সুশীল সমাজ এই শব্দটি বার বার উচ্চারণ করছেন। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার সূত্রপাত- বখে যাওয়া এক শিক্ষার্থী কর্তৃক তার শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে মিছিল-মিটিং, প্রতিবাদ-সমাবেশগুলো থেকেও এই বিষয়টি নিয়ে (মূল্যবোধ বা নৈতিকতার সংকট) কথাবার্তা হয়েছে। তাছাড়া নৈতিকতার অবক্ষয়জনিত এরকম ঘটনা আজকাল আমরা মাঝে মধ্যেই দেখতে পাই যেমন - সন্তানের হাতে মাতা/পিতা খুন, পিতা/মাতা কর্তৃক সন্তান হত্যা, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি, ধর্ষণ, ইভটিজিং, রাহাজনি, সাম্প্রদায়িক উগ্রতা, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনি ইত্যাদি। এসব ঘটনার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে এবং এককভাবে কোন কিছুকে এর জন্য দায়ী করা যাবে না একথা যেমন সত্য। আবার একথাও মনে হয় না তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, ‘মূল্যবোধ বা নৈতিকতার অবক্ষয়ের’ কারণে এই ঘটনাগুলো অনেকটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঘুরে ফিরে বারবার একটি প্রশ্নই মাথা চাড়া দিচ্ছে - কবির ভাষ্যমতে “তোমারা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ” কল্যাণকর মানুষ কি সত্যিই আমরা হতে পারছি? আরেকটু সহজভাবে বললে- উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা কাজ করছি সেই স্বপ্ন পূরণের কান্ডারি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাসম্পন্ন উন্নত মানুষ কি আমরা তৈরি করতে পারছি?
৩.
অথচ প্রতি মুহূর্তে আমরা উন্নত দেশ, উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন দেখি। উন্নত দেশগুলোকে অনুকরণ করি। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চাল-চলন, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদি অনুকরণ করে আমরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে চাই। আর এক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এগুলোকেই সূচক হিসেবে মনে করি বা প্রাধান্য দেই। কিন্তু উন্নত জাতি হতে হলে কি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি বা বস্তুগত উন্নতিই যথেষ্ট? নাকি সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নত মানুষ? যাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছেন ‘সোনার মানুষ’ হিসেবে। আচ্ছা, জাতি বলতে আমরা কী বুঝি বা জাতি কী নিয়ে গঠিত? যেমন বাঙালি জাতি বলতে আমরা কি বাংলার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, দালান-কোঠা, মিল-কারখানা ইত্যাদি বুঝি নাকি বাংলার মানুষকে বুঝি? হ্যাঁ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন এবং অপরিহার্য কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন মানুষের উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন মানে- মানবিক উন্নয়ন, মনুষ্যত্বের উন্নয়ন, মানব সত্তার উন্নয়ন। মানুষ বলতে শুধু সুন্দর ও সুঠাম দেহ বিশিষ্ট দুপেয়ে প্রাণীকেই বুঝাচ্ছি না। মানুষ বলতে আমি বুঝি স্রষ্টার এমন এক সৃষ্টিকে যার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ রয়েছে। যেই গুণগুলি (দয়া-মায়া, প্রেম-ভালোবাসা, মহানুভবতা, উদারতা, জ্ঞান, বুদ্ধি- বিবেক, চিন্তাশীলতা, সভ্যতা, সৌন্দর্য্যবোধ, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্ততা, পরিচ্ছন্নতা, সহিষ্ণুতা, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি) মানুষকে অন্যান্য সকল প্রাণী বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে সেইসকল গুণাবলীর একটি সামষ্টিক রূপকেই আমি মানুষ বলতে চাচ্ছি। আসলে মানুষ হতে হলে একই সাথে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে পরিপূর্ণ এক সত্তায় পরিণত হতে হয়। এই তিনটির সামষ্টিক বিকাশ ব্যতিরেকে সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়া যায় না। তাই আমার কাছে মনে হয়- মানুষ হিসেবে যে যত বেশি যথার্থতা অর্জন করতে পেরেছে সেই তত উন্নত মানুষ। আর এরকম উন্নত মানুষ নিয়েই গড়ে ওঠে একটি উন্নত জাতি। তাই মানব সম্পদ (Human Resource) উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত মানুষ তৈরিতে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র তথা সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু এই উন্নয়ন আজ আর শুধু ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা যথেষ্ট নয়। সাথে সাথে তার মানবিক ও নৈতিক উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই অনুমান করা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নৈতিক দিক থেকে অধ:পতিত মানুষ দিয়ে উন্নত জাতি তৈরি করা যাবে না, হোক সে জাতি বৈষয়িক বিভিন্ন সূচকে যতই অগ্রসরমান। যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় এই কথার সত্যতাই পরিলক্ষিত হয়েছে। মানুষকে যে কারণে মানুষ বলা হয়, সেই কারণগুলো পরিচর্যার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করা এবং মানুষের ভেতরের পশুত্বের বিনাশ ও মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে উন্নত মানুষে পরিণত হতে পারলে তবেই না উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। অন্যথায় ১ বাদ দিয়ে শুধু ০ দিয়ে যত বড় সংখ্যাই (০০০০০০০০০০০) গঠন করি না কেন তার যেমন মূল্য নেই ঠিক তেমনি উন্নত জীবনবোধ ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি না করে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বস্তুগত উৎকর্ষ সাধন বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে উন্নত জাতি বা দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখাও আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
৪.
এমনিভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভালোর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাদের মজ্জাগত। আমরা সর্বদা ভালোটিই চাই। আমার শরীর ভালো হোক, স্বাস্থ্য ভালো থাকুক, আমি যেন দেখতে ভালো হই, আমার খাবার ভালো হোক, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো হোক, বাসস্থানটি ভালো হোক, একটি ভালো ক্যারিয়ার আমার হোক, আমার একজন ভালো জীবনসঙ্গী হোক, সন্তানরা ভালো হোক, পরিবার ভালো থাকুক ইত্যাদির প্রত্যাশা সহজাত। এসব চাওয়া অমূলক বা অযৌক্তিকও নয় এবং এই প্রত্যাশাগুলো করাই উচিত। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিসত্তাটি ভালো হোক বা ব্যক্তি হিসেবে আমি ভালো হই সেটি আমরা কয়জন চাই? আমি ভালো মানুষ হই এরকম স্বপ্ন আমরা কি দেখি? অথচ এই স্বপ্নটিই সর্বাগ্রে দেখা উচিত। আমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে চায়, তার সন্তানটি খারাপ হোক, দুষ্ট হোক, প্রতারক হোক, সন্ত্রাসী হোক, অত্যাচারী হোক, দুর্নীতি পরায়ণ হোক, অমানুষ হোক? না, আমার কেউই এমনটি চাই না। এমনকি সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষটিও চায় না যে তার সন্তান খারাপ হোক। কিন্তু কেন যেন নিজের ব্যাপারে বা নিজের ব্যক্তিসত্তায় ভালোর এই প্রত্যাশাটি আমরা করতে চাই না। কেন যেন আমরা ভালো মানুষটি হতে চাই না। ধরুন, আম গাছের একটি চারা লাগালাম। চারাটি লাগানোর পরে আমরা কী প্রত্যাশা করি? আমরা প্রত্যাশা করি- চারাটি ধীরে ধীরে বড় হবে, সুবিস্তৃত হবে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত হবে, সুবিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে, সুমিষ্ট আম দেবে এরকমই তো? হ্যাঁ, ঠিক তাই। স্বভাবত আমরা এমনটিই চাইবো। এখন প্রশ্ন হলো - সুমিষ্ট আম পেতে আমরা সর্বপ্রথম কোন কাজটি করি? আমরা কিন্তু সবার আগে একটি ভালো, পোকামুক্ত, নীরোগ, সুস্থ বীজ বাছাই করি। অসুস্থ বা পোকাযুক্ত, দুর্বল বীজ থেকে কি ভালো চারা বা ভালো ফল আশা করা যায়? অথচ আমরা নিজেরা ভালো না হয়েও আমাদের সন্তানদের থেকে ভালোর সর্বোচ্চ প্রত্যাশাটুকু করি। যে প্রত্যাশাটি আমরা আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করি বা যে স্বপ্নটি আমরা আমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে দেখি, সেই একই প্রত্যাশা আমরা আমাদের নিজেদের বেলায় করি না।
৫.
আবার আমরা মনে করি, আমাদের ছেলে-মেয়েদের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে শুধু নামিদামি স্কুলে পাঠালেই তারা মানুষ হয়ে যাবে। অথচ তাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মাতা-পিতা বা পরিবারেরও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা অনুধাবন করি না। ফলস্বরূপ সন্তানদেরকে বাবা-মার সান্নিধ্য বা তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে শুধু অর্থ ব্যয় করাকেই যথেষ্ট মনে করি। এজন্যই বোধ হয় অর্থ, বিত্তের কথা না বলে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন- “Give me an educated mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation.” বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদও (সা.) সন্তান ভালো বা মন্দ হওয়ার পেছনে মাতা-পিতার দায় রয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছেন এবং এব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক হতে বলেছেন। তাই সন্তানদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি তারা যেন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজেদেরকে উন্নত বা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কেননা আমরা জানি শিশুরা অনুকরণ প্রিয় অর্থাৎ আমাদের বড়দেরকে দেখেই তারা শিখে থাকে। হ্যাঁ, নামিদামি স্কুল হয়ত তাদেরকে বড়োজোড় অর্থকরী মানুষ (অর্থাৎ যার অর্থোপার্জন ক্ষমতা বেশি) বানাবে কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন উন্নত মানুষ কি বানাতে পারছে? যদিও পরিবারের পরই এব্যাপারে তাদের দায়িত্ব অপরিসীম। তাছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারও এই দায় এড়াতে পারে না। তাই আসুন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে আমরা ভালোর প্রত্যাশা করি একইভাবে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার উন্নয়নেও যত্নবান হই এবং উন্নত জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করি।