পোস্টস

চিন্তা

আমাদের নিজেদের এই শূন্যতা!

২১ জুন ২০২৪

Azmain Muhi

মূল লেখক মুনতাকা আজমাইন মুহী

স্বাভাবিক অর্থে “কে আমি” বা “কে আপনি” এর বাইরে এসে আমরা যেভাবে নিজেকে খুঁজে পাই তা একান্ত আমাদের নিজেদের পরিচয়। জগত সংসারে সবকিছুতে অর্থ খুঁজতে চাওয়ার মধ্যে মানুষের সবসময়েরই তীব্র এক অনুসন্ধান কাজ করে। যা কিছু তীব্র তা একদিন শিথিল ঠিকই হয়ে আসে। জীবিতদের শরীরের উষ্ণতা মৃত্যুর পর লাশের শীতলতার মতো আমাদের অনুসন্ধানী মনেরও নক্ষত্রপতন ঘটে একদিন।

 

পৃথিবী’তে হৃদয়ের ক্লান্তি আছে। শরীরের ক্লান্তি আছে। প্রাণের ক্লান্তি আছে। আবার, বিশ্রাম আছে। অবসর আছে। ঘুম আছে। আমাদের যা প্রয়োজন আমরা তা গ্রহণ করি হয়তো। কিন্তু, প্রয়োজন আর চাওয়ার মাঝে কিছুটা বৈষম্যের তারতম্যে আমাদের অভিযোগে জমা থাকে মন খারাপ। এসব স্মৃতির রেখা ধরে অলকানন্দা নদী বেয়ে আমরা ফিরে আসি পাশবালিশের কাছে।

 

আমার হৃদয় অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত, সে চলচ্চিত্রে এমন বাক্য আমাদের সকলের হয়ে যা জানিয়ে দিয়ে যায় তা আমরা কখনোই অক্ষুণ্ণ রাখতে পারি না। বুদ্ধের অনুরতি বা প্রত্যাশার বাধ পেরিয়ে আমরা ঠিকঠাক ভাবে হয়তো ভালো থাকতে পারি না। যা কিছু হবার কথা ছিল, তা সবসময় বৈপরীত্যেই ঘটে জীবনে— নিজ মৃত্যুর চে’ অস্বাভাবিকভাবে বিয়োগাত্মক এই বিষয়।

 

আমরা আমাদের ভাবনার সমষ্টি। মন থেকেই জগতের সবকিছুর উদ্ভব। আপনারা একাগ্রচিত্তে অসম্মতি জানাতে পারেন, কিন্তু জাগতিক সবকিছুই দার্শনিক। এই গাছ, পাতা, বাতাস থেকে শুরু করে আমাদের প্রেম, বেঁচে থাকা সবকিছুই দার্শনিক। কেউ কেউ কিছু দেখে বা কোনো শব্দ শুনে দীর্ঘ সময় নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে অন্তরালে। অর্থ খুঁজে পাবার জন্যে নয় কিন্তু, সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে। সৌন্দর্যের অর্থ হয় না দর্শনের মতো। কেবল হারিয়ে ফেলা। খোঁজার উদ্দেশ্যে নয়। আরো অতলে যাওয়ার লক্ষ্যে।

 

তোমার ভালোবাসার সংজ্ঞা জানতে চাওয়ার প্রশ্নে আমি উত্তর দিয়েছিলাম একদিন, “ভালোবাসা হচ্ছে নিজ প্রজাতি’কে বাঁচিয়ে রাখার স্বঘোষিত এক বিপ্লব।” অথচ, তুমি ভেবেছিলে আমি প্রতিবারের মতো সেবারেও “করুণাই ভালোবাসা”— উত্তর হিসেবে বলবো। পরিবর্তনীয় বেঁচে থাকাকে তুমি সবসময় আত্মোন্নয়ন ভেবেছো, কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় ঠিক একইরকম থাকতে আরো বেশী আগ্রহী। মানবীয় সব ক্রুটি আমরা নিজেদের বেলায় খুব করে অপছন্দ করি। আমাদের নিজেদের এই জটিলপ্রক্রিয়ার বেঁচে থাকাকে সহজাতভাবে কেউ নিতে পারে না কখনো। অথচ, মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে এটিই কখনো কখনো আমরা ভুলতে বসি।

 

কে বাঁচাবে আমাদের?— এসব “কথা আর শব্দেরা।” একদিন তাকে এসব কথা বলেছিলাম। সে উত্তরে বলেছিলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি— এর চেয়ে সহজ, সত্য, সুন্দর আর কি হতে পারে? এতোকিছু ভেবো না। তুমি ভাবনাগ্রস্ত তাই তোমার দুঃখবোধ বেশী। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিলাম। আমাদের নিস্তব্ধতা শব্দের চেয়েও শক্তিশালী। আমরা চুপ করে থেকে যা জানান দিই, তা কখনো কখনো কথা বলেও হয়তো জানাতে পারি না।

 

মানুষেরা কল্পনাপ্রবণ আর ভাবনাশীল। আমরা সকলেই তা জানি। সুদূরপ্রসারী এসব চিন্তা আছে বলেই আমরা জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। অপরদিকে, আমরা মুহূর্তে বাঁচতে পারি না। আমাদের সকল চিন্তা আগামী দিন নিয়ে। এটিকে ঘিড়ে আবার আমাদের নানান দুঃখ। এ যেনো মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। মানবজীবন হচ্ছে সিসিফাসের মতো চক্রমান এক প্রক্রিয়া, যে আমাকে এটি বলেছিলো সে আজ পৃথিবীতে নেই। যারা আজ পৃথিবী’তে নেই অথচ একদিন পৃথিবী’তে মেতেছিল উৎসবের কলরবে তাদের অনুপস্থিতি’তে পৃথিবী শূন্য বোধ করে না।  সবকিছুর শেষে, অতঃপর, অবশিষ্ট কেবল আমাদের নিজেদের এই শূন্যতা।

 

নির্ঘণ্ট:
১. “কে আমি” বা “কে আপনি” গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের “Know Thyself” মতবাদ হতে অনুপ্রাণিত।

২. নক্ষত্রপতন শব্দটি মৃত্যুর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত।

৩. “স্মৃতির রেখা” বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত দিনলিপি সংকলন।

৪. “আমার হৃদয় অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত”, এই বাক্য ইমতিয়াজ আলী পরিচালিত ২০১১ সালের ভারতীয় চলচ্চিত্র রকস্টার থেকে উদ্ধৃত।

৫. “আমরা আমাদের ভাবনার সমষ্টি। মন থেকেই জগতের সবকিছুর উদ্ভব।"— ধম্মপদের প্রথম অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত।