Posts

ভ্রমণ

দেখে এলাম সাংহাই   

June 22, 2024

সাজিদ রহমান

Original Author সাজিদ রহমান

105
View

২২ এপ্রিল ২০১৭

সাংহাই দেখার জন্য আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে আছি। চীনে আমাদের হোম টাউন হাইকো। হাইনান প্রদেশের প্রধান শহর এটি। বেশ ভোরে রেডি হয়ে বড় লাগেজ সেরেন্জিটির (হোটেলে) জিম্মায় রেখে রওয়ানা হই। বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। মেইলান এয়ারপোর্টে নেমে হাল্কা ঠান্ডা লাগছিলো। সিকিউরিটি চেকের জন্য নির্দিষ্ট কাউন্টারে যাই। ভিন দেশী দেখে লাইনে দাড়ানো চাইনিজরা আমাদেরকে সামনে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে দ্রুতই আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলি। ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছি। এক সময় বৃষ্টির মাঝেই চায়না সাউদার্ণের ফ্লাইট টেক-অফ করে। যে মেঘ হতে বৃষ্টি ঝরছিলো প্লেন সেটার উপরে চলে যায়। ‘মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয় আড়ালে তার সুর্য হাসে’ ছোটবেলায় পড়া এ কবিতার অর্থ এতদিনে পষ্ট হলো। বৃষ্টি পড়তে থাকা অবস্থায় মেঘের উপরে গিয়ে সূর্যের আলোয় রোদ পোহানো, ছোট বেলায় স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।! হাসতে থাকা সুর্যের ঝকঝকে রোদ এসে সকালের ঠান্ডাকে ঝেটিয়ে বিদায় দিচ্ছিল যেন।

সাংহাই এর পুদোং এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করে। আয়তনে বিশাল এই এয়ারপোর্ট সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো। স্টিল-ট্রাস দিয়ে লম্বা স্পানে হাফ সার্কেলের ঢেউ খেলানো টার্মিনাল ভবনগুলো অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। গোটা দশেক শাহজালাল এয়ারপোর্ট এর মধ্যে বসালেও বেশ খানিকটা জায়গা ফাকা থাকবে বোধহয়। এরপরও জোরে-শোরে এক্সটেনশনের উন্নয়ন কাজ চলছে। আর কি ব্যস্ত এয়ারপোর্ট, সারা দিনে কত বিমান উঠা নামা করে। গুয়াংজু, মেইলানের পর পুদোং এয়ারপোর্ট দর্শন। প্রত্যেকটাই আলাদা প্যাটার্নের, সৌন্দর্যের ধরনও ভিন্ন। আর্কিটেক্ট-ইন্জিনিয়ারদের এসব কাজ দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায়।

আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে টুরিস্ট গাইড এমা। বেশ চটপটে, ভালো ইংরেজি বলে। চেহারার মধ্যে চাইনিজ ছাপের চেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের টান বেশি। তবে হোয়াংফু নদীতে রিভারক্রুজ (যা ওদের সিডিউলে ছিলোনা) উপভোগের পর অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে সে চাইনিজ স্ট্যান্ডার্ড ধরে রেখেছিলো। হাইকো ফেরার আগ পর্যন্ত এমা আমাদের সাংহাই ও সুজোর পথ দেখায়। ফয়ার অব সাংহাই এন্ড সুজো। এমা তার পরিবারের সংগ্রামের যে গল্প শুনিয়েছিলো তা আমাদের অনেকের সংগ্রামের গল্পের মতই। পুদোং এয়ারপোর্ট থেকে মাটিতে পা না রেখেই (ফ্লাই ওভার হয়ে) সাংহাইয়ের বিখ্যাত চায়না প্যাভেলিয়নে চলে আসি। চায়না প্যাভেলিয়নের লাল ভবন নিজেই এক বিস্ময়কর স্থাপনা। গ্রামের অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা যখন পড়াশুনা করতে ঢাকায় যায়, মায়েরা খুব ভয়ে থাকে তাঁর সন্তান হারিয়ে যায় নাকি। অনুরুপভাবে এত বড় শহর সাংহাই তে আমাদের সকলের হারিয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করতে থাকে। কারন সর্বত্রই চাইনিজ ভাষায় লেখা সাইন-বোর্ড আর শতকরা আনুমানিক ৯৫ জনের ইংরেজি ভাষা না জানা। শহরের ভিতর দিয়ে যখন আমাদের বাস ছুটে চলছিল তখন সবাই বড় বড় চোখে শহরের সৌন্দর্য গিলছিলাম। নিজেকে হারানোর ভয় কখন যে হারিয়ে গেছে টের পাইনি বরং এমন সৌন্দর্যের মাঝে বারবার নিজেকে হারাতে মন চাচ্ছিল। আকাশচুম্বী নয়ন জুড়ানো সব ভবন, প্রশস্ত সড়ক, ফ্লাই ওভার, মেট্রো, ঝকঝকে শপিংমল সবই আমাদের মোহিত করে রাখে সারাক্ষন। সবাই শহরের সৌন্দর্যে বুদ হয়েছিলাম এবং অজ পাড়া গাঁয়ের লোকজন যেভাবে প্রথম ঢাকা শহর দেখে নিজেদের  ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছিল।

দুপুর প্রায় ২ টা বাজে। এয়ারপোর্টে নামার পর সবাই বুঝতে পারি বেশ খিদে লেগেছে। গত রাতের (রাত না বলে মাগরিবের সময় বলাই শ্রেয়) ডিনারের পর পেটে কিছু পড়েনি। তবে অভিজ্ঞ অনেকেই সুদূর বাংলাদেশ থেকে আনা চিড়ে-বিস্কুটে জলপান সেরেছে। কুটকুট শব্দ ও বিচিত্র মুখ-ভঙ্গিমায় বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিলো। এয়ারপোর্ট ম্যাকডোনাল্ডে বার্গার কোক দিয়ে লান্চ সারি। টুরিস্ট বাসে করে মূল শহরে ঢুকতেই সাংহাই-স্বপ্ন-দর্শন বাস্তবে রুপ নিতে থাকে। কত স্কাই স্ক্রাপার, প্রশস্ত সড়ক, বহুতল ফ্লাইওভার। রাতের সাংহাই বড় রোমান্টিক, আলোর পসরা দিয়ে সাজানো এ শহর যেন প্রিয়ার ওষ্ঠাধারে চুম্বন-আকাংখার ন্যায় স্বাদ না মেটা শিহরণ। শহর দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। শহর ঢুকতেই ঘোর লাগা শুরু হয়। বাপ। এরা কি উন্নতি টা না করেছে আর থামার কোন লক্ষনই নাই। বলা মুশকিল, বর্ণনা করা দুরুহ। কাওসার ভাই ৩৫ টি দেশের অনেক শহর ভ্রমন করেছেন, উনিও টাসকি খেয়ে যাচ্ছেন।  সাংহাইয়ের অবকাঠামো দেখে বারবার আমাকে খোচা মারছেন।  বলছেন, 'কিরে ভাই ৪০ মিনিট হল, ফ্লাইওভার থেকে নামব কখন, এখনও মাটিতে নামতে পারলাম না? রাস্তায় কোন গর্ত নাই, কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে'। আমরা থাকলে গর্তও ঠিকই থাকত। আমিও জুতসই জবাব দিই।

চায়না প্যাভিলিয়নে আসি। এখানে ancient art, literature সহ অনেক ঐতিহ্যের স্মারক সংগ্রহ করে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। আর লাল রঙে রাংগানো চায়না প্যাভিলিয়ন ভবন নিজেই এক বিস্ময়কর অবকাঠামো। পাশে Mercedenz-Benz নির্মিত থিয়েটার ভবন, আর সবার উপর মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে 'সাংহাই টাওয়ার' (২০৭৩ ফুট উচু)। সবই এক একটা বিস্ময়কর অবকাঠামো যা নিয়ে কথা বললে শেষ হবেনা। সন্ধা বেলা যখন ডিনারে যাচ্ছিলাম, এমনকি হোটেলে ফেরার পথেও যে সাংহাই দেখছিলাম তা রীতিমত বিস্ময়কর। চোখ ধাধানো অসহনীয় সুন্দর । সড়কের ২ পাশে, কিংবা আরও ভিতরে প্রত্যেকটা  সু-উচ্চ ভবনে যেভাবে আলোক সজ্জার বাহার তা অকল্পনীয়। এ আলোক সজ্জা, এই সাংহাই কখনও ভুলবার নয়।

আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছিলেন, জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সূদুর চীনে যাও। কেন বলেছিলেন, এ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে। তবে মোদ্দাকথা এই যে, আজকে চীন যে উন্নতি-শিখরে উঠেছে তা গবেষনার দাবিদার। এখন শুধু চীনকে ফলো করেই আমরা আগাতে পারি। সত্যি, মনে হচ্ছে আমাকে সাংহাইয়ে ছেড়ে দিলে আমি হারিয়ে যাব। বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারব কিনা সন্দেহ আছে।

তবুও শুধু সৌন্দর্যের সুধা পান করে পেট ভরেনা। সন্ধায় এক রেস্টুরেন্টে গেলাম ডিনারের জন্য। যেটাই মুখে দিই, ঠেলে ভিতরে নেয়া যায় না। উল্টো ভিতর থেকে নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে আসার জোর চেষ্টা চালায়। গত ২৪ ঘন্টায় পেটে পড়েছে শুধু ঐ এক বার্গার, তার উপর সারাদিনে লম্বা জার্নি। আর খেতে বসে কিছু খেতে না পেরে বড় অসহায় লাগছিলো সবাইকে। এর চেয়ে পিঠে ২/৪ টা কিল মেরেও যদি ভাত-ডাল-গরু ভূনা খেতে দিত, কেউ টু শব্দটি করতনা। আমাদের সফর সঙ্গী কাওসার ভাই (PMO এর একজন পরিচালক) সামান্য ভাতও ডিমভাজির জন্য বিভিন্ন কায়দায় বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আর কোন আশা নাই, এরপর বাধ্য হয়ে যে যা পারে মুখে দিয়ে ডিনার শেষ করি।

ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সারাদিন পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। ওদের টেনশন করাই স্বাভাবিক। wifi এর পাসওয়ার্ড চাইতে গেলে রিসিপশন থেকে বলা হয়, সেটা দেবার নিয়ম নাই। আমরা অনেকে হোটেলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রুমে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঠিক তক্ষুনি কাওসার ভাই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। বেশ সাউটিং করেন, এম্বাসিতে অভিযোগ করবেন বলে জানিয়ে দেন। বাংলাদেশীদের কি ভোদাই পাইছে নাকি? বাংলাদোশ আর মোনজেলা নাই। সুদূর চীনের সাংহাইতেও PMO অফিসের কার্যকর ভূমিকায় আমরা আশান্বিত হই। তখন আমাদের কন্ঠেও জোর আসে। এমাকে আমরাও বলি, what's going on Ema? এমা বার বার বলছে, Ok, I'm taking care of it. এবং আশ্চর্যজনক ভাবে কাজ হয়ে যায়। আমরা নেট কানেকশন পেয়ে যাই। ঝাড়িতে শুধু বাংলাদেশ, চীন নয়, সারা দুনিয়ায় হয়ত কাজ হয়। কাওসার ভাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

সাংহাইতে তখন ১০ কি ১২ ডিগ্রি চলে। রুমে এসে চেন্জ করেছি মাত্র। এমন সময় দরজায় নক। খুলে দেখি, আমাদের সফর সঙ্গী কালাম সাহেব। উনি রুমে একা ভয় পাচ্ছেন। অন্য রুমে যাবেন। ভয় পেয়ে আমার রুমে এসে এমন ভাবে ডাক দেন, আমিও তড়িৎ গতিতে বের হয়ে আসি। সাথে সাথে ডোর-লক হয়ে যায়। রুমের চাবি রুমের ভিতরে থেকে যায়। আমি শুধু ট্রাউজার পরা। উনি পেলেন ভয়, আমি হলেম আধেক নাঙ্গা। উনার রুমে গিয়ে রিসিপশনে ফোন দিলাম। হ্যালো, My room is locked, but I'm out of room, please l need a alternative key. এ কথা শুনে কি বুঝল জানি না। শুধু বলতে শুনলাম, wait for tomorrow morning আমি ফের রিপিট করলাম। তখন বলছে... try with window... একথা শুনে কি করা উচিৎ। কচুক্ষেতে আমার ফাস দেয়া উচিৎ কি? এই জাতি ইংরেজি না জেনে কেমনে এত উপরে উঠতাছে, বুঝতাছিনা। তবে এটুকু বুঝলাম, ফোনে কাজ হবে না। কালাম সাহেবের রুম থেকে একটা টাওয়েল জড়িয়ে ১২ তলা থেকে নিচে নামলাম। রিসিপশনে কোন বিকার নাই। অনেক কায়দা কানুন করে বোঝাতে সক্ষম হলাম, কি ঘটেছে। 

অবশেষে রুমে ফিরতে পারলাম, শাওয়ার নিয়ে জম্পেস ঘুমে চলে যাই।

Comments

    Please login to post comment. Login