অশোক কুমার ভদ্র। এই ভদ্র লোককে আমি জানিনা। কখনও দেখিনি। আলাপ করার সুযোগও হয়নি। তাহলে কেন এই আলাপ? আপনার মনে এই প্রশ্ন আসতেই পারে। মনে সেই প্রশ্ন আসা একদম অমূলক নয়।
শহরের একটা ভবনের চার তলায় একটা আড্ডা স্থল আছে। অনেকেই সেখানে যায়। তাঁদের প্রত্যেকেই জ্ঞানী, গুণী মানুষ। নিজ নিজ কর্মে উজ্জ্বল। মাঝে মাঝে আমারও যাওয়ার সুযোগ হয় সেখানে। সেখানে বসে থাকলেই অনেক কিছু শিখতে পারি।
সিঁড়িতে ওঠার মুখেই একটা সাইন বোর্ড। সেই বোর্ডে এই নামটা দেখতে পাই। কিন্তু কখনই শাটার খোলা পাইনি। ভদ্র লোকটির দর্শনও পাইনি।
একটা সমাজ অনেক মানুষ নিয়ে গড়ে উঠে। প্রতিটি মানুষের আচরণই সেই সমাজের আচরণ হয়ে দাড়ায়। সমাজের আচরণ দিয়ে সেই জাতির মূল্যায়ন হয়। দুনিয়া জুড়ে এখন অনেক মানদণ্ড। সেই সব মানদণ্ডে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
মানুষের মুখের কথাকে বন্দুকের গুলির সাথে তুলনা করা হয়। ট্রিগারে চাপ দিলে সেই গুলিকে ফেরত আনা যায় না। মুখ নিসৃত কথার বেলাও একই উদাহরণ টানা হয়। কিন্তু বন্দুকের গুলির সাথে মানুষের একটা বড় পার্থক্য আছে। বন্দুক কোথাও কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। একজন মানুষের অমৃত বচন একটা গোটা জাতিকে, এমনকি গোটা বিশ্বে শান্তির নহর বইয়ে দিতে পারে।
যুগে যুগে আমরা এমন অনেক মহৎ প্রাণ দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কথা বলতে পারি। এমন একটা সময়ে তিনি দুনিয়াতে আসেন, যখন কন্যা সন্তান জন্মানো মাত্র মেরে ফেলা হত। সেই সমাজে ছিল অনাচারের রাজত্ব। সেই সময়কে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত, অন্ধকার যুগ। এরপর এমন একটা সময় এলো, উনার মুখের কথা (প্রধানত কুরানের বাণী) যাদু মন্ত্রের মত কাজ করতে লাগলো। একটা সময় গিয়ে শুধু সেই সমাজ নয়, গোটা জাহান ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিলো।
গৌতম বুদ্ধের কথা বলা যায়। তাঁর প্রচারিত অহিংসার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে উঠেছে নতুন সভ্যতা। এরকম অনেকের কথা বলা যাবে। বলে শেষ করা যাবে না।
একটা সভ্য সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেকটি ব্যক্তির আচরণই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন। সেই ব্যক্তির আচরণ নির্ধারনে সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেক কিছু জড়িত, সেটাকেও অস্বীকার করছিনা। সেটাকে স্বীকার করেই বলি, যে ব্যক্তির মুখের কথা তাঁর সহকর্মীর, বন্ধুর, পরিবারের, কিংবা তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষের জন্য শুভকর হয় না, তাঁর কোন কিছুই ঠিক নেই। খুব অনায়াসে এটা বলা যায়। সমাজে তখন প্রত্যেকের উপর প্রত্যেকের এক ধরণের অনাস্থা তৈরি হয়। নিজেকে ছাড়া আর অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সে যেমন অন্যকে আস্থায় নিতে পারে না, তাঁকেও যে অন্য একজন একই ভাবে নিচ্ছে, সেটা তাঁর বুঝে আসেনা।
সকালের কাঁচা বাজারে, অফিসে আদালতে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আরেক জনের সাথে কথা বলতে গেলেই আমার আপনার সবচেয়ে বড় অভিযোগ, লোকটার ব্যবহার খারাপ। অনেককে বলতে শুনি, দুই টাকা বেশি নিক, অন্তত ভালো ব্যবহার যদি করত।
জ্ঞান তাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, একটা সমাজ কেমন চলছে সেটা বোঝার দুইটা উপায় আছে। সেই সমাজের মানুষ কি পড়ে, আর সেই সমাজের মানুষ কি খায়, তা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে।
এ গেলো সমাজের কথা। একজন ব্যক্তি মানুষ কেমন, সেটা চেনার উপায় কি? উপায় আছে। প্রচুর সুস্বাদু খাবার আছে, এমন জায়গায় নিয়ে একজনকে বলবেন, ইচ্ছেমত খেতে পারেন, পয়সা দিতে হবে না। সেই মানুষটি তখন যে আচরণ বা কাণ্ডখানা করবেন, সেটি তাঁর আসল পরিচয়। একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের কাছে শুনেছি। কথা সঠিক কিনা, বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালি কণা ও বিন্দু বিন্দু জলই মহাদেশ বা মহাসাগর গড়ে তোলে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কত বৃহৎ, মানুষ তা অনুমান করতে পারে মাত্র। কিন্তু একটা কথা সত্য, প্রত্যেক বৃহৎ জিনিসকে ছোট ছোট ভাগ করলে শেষ পর্যন্ত অণু পরমাণু বা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনই পাওয়া যাবে। নামের সাথে ভদ্র টাইটেল থাকুক, আর নাই থাকুক, হৃদয়ে সেটা ধারণ করাই আসল।
প্রতিটি ছোট বিষয়ই গুরুত্বপুর্ন। ছোট একটা ভালো কাজকে যেমন উৎসাহিত করা প্রয়োজন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্যুতি থেকে সরে আসা তেমনি জরুরি।
নামের সাথে থাকুক আর নাই থাকুক, ভদ্রতা সমাজের দর্পনের মত। অশোক কুমার ভদ্রের নামের সাইনবোর্ড আমাকে সেই কথা মনে করিয়ে দেয়।