পরিচয় বলতে গেলে আবুল মনসুর আহমদকে নানান দৃষ্টিকোন থেকে পাঠকের সামনে হাজির করা যায়, তাঁর বিচিত্র জীবনকে তুলে ধরা যায়। তাঁর বণাঢ্য জীবনের পট-পরিবর্তনে আইনের পেশা থাকলেও খ্যাতিটা ছিলো অন্য জায়গায়, আলাদা মাত্রার। অন্য আরো পরিচিতির যে ব্যাপকতা তাতে আইন পেশার চেয়েও তার সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবনটাই এখানে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সমাজের দর্পণে। ফলে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির বরণীয় ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
কীর্তিমান এই আবুল মনসুরের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানিখোলা গ্রামে ১৮৯৮ সালে। জন্মের সময়কালে বাংলার মুসলিম সমাজে বিরাজমান ছিলো এক ঘনঘোর অমানিশার দুর্দিন। নানান রকমের কুসংস্কার ও প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করেই তার বেড়ে উঠার গল্প। এমন সমাজে অজ্ঞতার অকালে তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক চিন্তাধারা সমাজ জীবনে আনে জাগরণের জোয়ার। পাল্টে দিলেন সমাজ ও সংস্কৃতির গতিপথ। বাঙালি জাতির শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নে রাখলেন অসামান্য অবদান। যা ইতিহাস হলো সোনালী অধ্যায়ের পাতায় পাতায়।
আবুল মনসুর আহমদ ১৯১৭ সালে মেট্রিক শেষ করে ১৯২১ সালে পা রাখলেন ঢাকা কলেজে। ১৯২৯ সালে তিনি আইনের ডিগ্রি নিয়ে শুরু করেন সাংবাদিকতার জীবন। সাংবাদিকতায় গেলেও আইন ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে ১৯৩৮ সালের শুরুর দিকে ময়মনসিংহয়ে করেন ওকালতি। এখানেই থেমে থাকেননি এই মনসুর আহমদ পরবর্তী সময়ে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম, হয়ে উঠলেন সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তৎতালীন পত্রিকা সওগাত ও ছোলতান থেকে শুরু করে মোহাম্মদী, দি মুসলমান, খাদেম, দৈনিক কৃষক, দৈনিক নবযুগ ও দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় হয়েছেন সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক। গণমানুষের হয়ে নিজের কলমকে জারি রেখেছেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে।
স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন আবুল মনসুর। একেবারে স্কুল জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তিনি নানাবিধ আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছেন। বলতে গেলে সেই খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রজীবনেই। পালাক্রমে তা বিস্তার হয় কৃষক-প্রজা আন্দোলন থেকে পাকিস্তান আন্দোলন। এর পূর্ণতা আসে আমাদের স্বাধীনতায়। কালের পরিক্রমায় ১৯৪৬ সালেই তাঁর জীবনের বাঁক বদলে গেলো। হলেন প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগের সদস্য। ভাগ্যের চাকা ঘুরে ১৯৫০ হলেন প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর ১৯৫৬-তে শিক্ষার রূপ বদলের কারিগর শিক্ষামন্ত্রী এবং একই বছরে দায়িত্ব পেলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর। এসবের পরে এসে মুকুট পরলেন প্রধানমন্ত্রীর। দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির প্রশ্নে কখনোই নিজেকে বিকিয়ে দেননি। স্বাধীন চিন্তা ও মতামত প্রদানে থেকেছেন অটল। বহুমুখী কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে যাওয়া আবুল মনসুর তাঁর জীবনকে মুখর করে রাখলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, পার্লামেন্টারিয়ান অঙ্গনের বিচিত্র পদচারণায়। ফলে তাঁর লেখা ও কাজে, এমনকি রাজনীতির মাঠেও ব্যক্তি-প্রেমের চেয়ে দেশপ্রেমই হয়ে উঠলো প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। চিন্তা ও লেখায় সাহিত্যের সব শাখাতে আবাদে করেছেন উর্বর ও সমৃদ্ধ। যেমনটা কিশোর সাহিত্য ঠিক সমান তালে পাল্লা দিয়েছেন উপন্যাস, ধর্ম, রাজনীতি ও রম্য রচনার দুনিয়ায়। গ্রামীণ ও লোকজ শব্দকে গদ্য সাহিত্যের নিপুণ গাঁথুনিতে নির্মাণ করেছেন নতুন এক গদ্যধারার। এজন্যই তাঁর একজীবনে অন্য আরো দশটা কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়। সাহিত্যে ও সাংবাদিকতার প্রেরণায় যুগ থেকে যুগান্তরে দিয়ে গেলেন মুগ্ধতার পাঠ। হয়ে উঠলেন সময়ের আলাদা কণ্ঠস্বর ও কালের কীর্তিমান।
আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্যের জার্নিটা শুরু করেন সওগাতে তাঁর ‘ধর্মরাজ্য’ লেখার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে বিখ্যাত 'আয়না’ গল্পের যাত্রা দিয়ে আগালেন ‘হুজুর কেবলা’, ‘নায়েবে নবী’ ‘লীড়ারে কওম’ ‘বিদ্রোহী সংঘ’, ‘মুত্তাহেদীন’, ‘সায়েন্টিফিক বিজনেস’, ‘গ্রো মোর ফুড’, ‘জনসেবা ইউনিভার্সিটি’, ‘অনারেবল মিনিষ্টার’ ‘ছহি বড় গুজারতনামা’, ‘চেষ্ট অব হার্ট’র মতো বইয়ের শিরোনামে সমকালীন সমাজ ও সাহিত্যে আলোড়ন তুলে। এরপর ১৯৫০ সালের দিকে তাঁর ব্যঙ্গ রচনা ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘গ্যালিভারের সফরনামা’ লিখে হলেন কিংবদন্তি। উপন্যাসের পর্বে এসে লিখলেন ‘জীবন ক্ষুধা' ‘সত্যমিথ্যা’, ‘ছোটদের কাসাসুল আম্বিয়া’, ‘সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে রাজনীতি’। পঞ্চাশ সালের পরে পাকিস্তানে এসে কলমকে শানিত করলেন আরো আরো যুগান্তকারী রচনায়। ‘আবে হায়াত’, থেকে ‘পাক বাংলার কালচার’, ‘পরিবার পরিকল্পনা’ ‘আল কোরআনের নসিহত’। লিখলেন একজীবনে দেখা সময়ের হালচাল ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ ও ফেলে আসা স্মৃতির গল্প ‘আত্মকথা’র শিরোনামে।
বাঙালির কীর্তিমান এই লেখক ও দেখক আজীবন অদর্শ ও নীতির সংগ্রামে ছিলেন আপোষহীন। ভাষা ও সাহিত্যে বাঙ্গালীর মাতৃভাষাকে তুলে আনার সংগ্রাম, রাজনীতি ও নির্যাতিত মুসলমানের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং সবশেষে পাকিস্তান পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানীদের মানে বর্তমান বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের সংগ্রাম। সাংবদিকতার জীবনে লড়লেন মত ও স্বাধীনতার সংগ্রামে। এমন সংগ্রাম বহুল জীবনই ছিলো তাঁর পথচলার মূল উপজীব্য। বর্ণাঢ্য জীবন শেষে কালের সাক্ষী হয়ে ইন্তেকাল করেন ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ। একজীবনে তিনি নির্মাণ করে গেলেন সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গতিপথ। দেখে গেলেন চিন্তার মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। একজন আবুল মনসুর হয়ে উঠলেন বাঙালির আশা ও প্রেরণার ঠিকানা।