পোস্টস

পোস্ট

জাতীয় সঙ্গীত বিতর্কে

৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মিলু

মূল লেখক কৌশিক মজুমদার শুভ

প্রত্যেকটা রচনার পিছনে কবির একটা নিজস্ব ভাবনা থাকে আর তা পড়ে পাঠকের মনেও একটা ভাবের উদয় হয়। গুরুত্বপূর্ণ নয় যে কবির মনোভাবের সাথে পাঠকের/শ্রোতার আত্মোপলব্ধির মিল থাকতেই হবে। বরঞ্চ এ ধরনের হুবহু মিল চাওয়াটা অবাস্তবই মনে হয়। ধরুন 'মিলন হবে কতো দিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে' গানটা মূলত গুরুপ্রধাণ বাউল সমাজের গুরুর দর্শন পাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত। কিন্তু বর্তমানে জনপ্রিয় ধারায় এটা মূলত নারী পুরুষের মিলনার্থেই প্রচলিত। 'আমার সোনার বাংলা' গানটি বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাঙালি জাতিকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হলেও এর প্রাকৃতিক বর্ননা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিবরণ বাংলাদেশ ভূখন্ডের চিরাচরিত ধারার সাথে মিলে যায়, ফলে এ গান বাংলাদেশী নাগরিকের জীবনাযাপনের ঐতিহ্যের সাথে কোনোভাবেই বিরূপ না।

একটা দেশের আন্দোলন বিপ্লবের ইতিহাসে নিত্যনতুন অধ্যায় সংযুক্ত হতে থাকে প্রতিনিয়ত, নতুন মনীষী, ব্যক্তিত্বরা আসেন- এ তালিকা নিয়ত পরিবর্তনীয়, এমনকি একটি তালিকায় তাদের স্থান দিতে গিয়েও হিমশিম খেতে হতে পারে। কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত তাই এমন বিষয় নিয়ে হওয়া উচিত যেগুলো খুব দ্রুত পরিবর্তিত/পরিবর্ধিত হয় না। ভূপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, ভৌগোলিক অবস্থান, চিরাচরিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এইক্ষেত্রে বাছাই করা সুবিধাজনক। আমার সোনার বাংলা গানটির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ননায় বাংলাদেশের চিরাচরিত রূপ, এদেশের সাংস্কৃতিক ধারায় বর্ননা কোনো মতেই ক্ষণস্থায়ী নয়- বরং 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' কথাটি যতদিন এই দেশের অস্তিত্ব নিয়ে আছে ততোদিন উচ্চারিত হতে কোনো আপত্তি হবার কথা নয়।

এই জাতীয় সংগীত নির্ধারণের একটা ইতিহাসও আছে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে জড়িত। মিস্টার আজমি সাহেবের হয়তো এজন্যে গানটির প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে থাকবে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফুটেজে শপথ গ্রহণের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগের সাথে এই গান গাইতে দেখা যায়।

এই গানের সুর বাউল গানের সুর থেকে উৎসারিত, গানটি রবীন্দ্রনাথের বাউল নামক গ্রন্থ থেকে নেয়া। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ এখানে লুকিয়ে যেতে চাননি যে গানগুলোর সুর বাউল ঘরানা থেকে অনুপ্রানিত হতে পারেন। বাউল ঘরানার সুর হওয়ায় বাংলাদেশের মাটির সুর বলা যায় একে। অনেকে ঢিমে তালের কথা বলেন, গান সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান আছে কিনা জানি না- এটা লয় হবে। একটা জাতীয় সঙ্গীতে ভাবগাম্ভীর্যের দরকার হয়, আর এজন্যে এই সুরটা যথাযথ বলে একজন শিল্পী হিসেবে আমি মনে করি।

একটি দেশের জাতীয় সংগীত সাধারণত ওই দেশের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সাথে বাজানোর উপযুক্ত হওয়াটি বান্ছনীয়। এই দিক থেকে গানটি হারমোনিয়াম, তবলা থেকে শুরু করে শুধুমাত্র একতারায়ও বাজানো যায় এবং শ্রতিমধুর শোনায়। যারা জাতীয় সংগীত হিসেবে বিভিন্ন রকগানকে উত্থাপন করেন তারা ভাবুন হারমোনিয়াম, তবলায় কেমন শোনাতে পারে এগুলো।

গানটির সাহিত্যগুণ বিবেচনা করলে সুনিপুণ উপমা, চিত্রকল্প ও অলংকার দেখা যায়। অনেকের কথা শুনেছি জাতীয় সংগীতের লেখক হলে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশী হতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা দেখি না, বিশেষ করে তিনি যখন মারা গেছে তখনো পাকিস্তানেরই জন্ম হয়নি। জীবনানন্দ দাশও তো ব্রিটিশ শাসনকালীন কবি, তাকে যেহেতু আমরা আপন করে নিতে পেরেছি রবীন্দ্রনাথকে মেনে নিতে সমস্যা দেখি না। এমনকি নজরুলের জন্মস্থানও খোদ ভারতে, আমরা তাকে বাংলাদেশে এনেছি ও যখন নাগরিকত্ব দিয়েছি, ততোদিনে তিনি বাকশক্তিরহিত ও সৃষ্টিশীলতাও হারিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বংশধরদের আদি নিবাস বাংলাদেশে, এমনকি জমিদারিসূত্রে জীবনের একটা বড় সময় তিনি বাংলাদেশের জল-মাটির সাথে কাটিয়েছেন, এখন যদি জাতীয় সঙ্গীতপ্রশ্নে তাকে মরণোত্তর নাগরিকত্ব দিতে হয় তাতেও সমস্যা দেখি না।

বি: দ্র: রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করে প্রবন্ধ অমুক তমুক লিখেছেন, এই ধরনের ভিত্তিহীন কথাবার্তা না বললে খুশি হবো। এমন কোনো নির্ভরযোগ্য এভিডেন্স নাই। রবীন্দ্রনাথের এমন কোনো রচনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, এমনকি যে সভার তার বক্তব্য দেয়ার গুজব একদল লোক স্বার্থ হাসিলের জন্য ছড়িয়েছে(ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের বইয়েই সম্ভবত এই রেফারেন্স প্রথম), সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিতই ছিলেন না। ২৮ শে মার্চ এই সভা ছিলো, ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে ইংল্যান্ড যেতে না পেরে, শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু তখনকার সময়কার কোনো লেখক সমালোচকের এ নিয়ে কোনো কথা নেই, কোথা থেকে ২০০০ সালে এসে এম, এ মতিনসাহেব এমন একটা ডিম পাড়লেন(কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই) তিনিই ভালো জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আমন্ত্রণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সংবর্ধনা ও ডিলিট উপাধি প্রদান করে। এমনকি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ, হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিসহ অনেক সংগঠন তাকে সংবর্ধনা দেয়।