মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক ধূসর বৃক্ষের উপমা মানব জীবনের এক অসীম প্রতীক্ষা ও বেদনার চিত্রকে গভীরভাবে তুলে ধরে। এই ধূসর বৃক্ষ যেন সময়ের প্রতীক, যার প্রতিটি শাখা, প্রতিটি পাতা জীবনধারণের জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও, সেই বৃক্ষ অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, শিকড় গেঁথে রেখেছে মরুভূমির শুষ্ক বুকে, যেন তার একমাত্র কাজ হলো অপেক্ষা করা—অনিশ্চিত সেই বৃষ্টির জন্য, যা হয়তো কখনো আসবে না।
এই বৃক্ষের তৃষ্ণা শুধু শারীরিক নয়, এটি মানসিক ও আধ্যাত্মিকও। প্রতিটি শূন্য দিন, প্রতিটি দীর্ঘ রাত তাকে আরও তৃষ্ণার্ত করে তোলে, কিন্তু এই তৃষ্ণার মাঝে লুকিয়ে থাকে জীবনের মূল সত্য। বৃক্ষ জানে যে, হয়তো তার তৃষ্ণা কখনোই মিটবে না, তবুও সে অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষা শুধু সময়ের জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতি এক গভীর বিশ্বাসের প্রতিফলন, যেখানে মানুষও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আশা নিয়ে বেঁচে থাকে, যতই অনিশ্চয়তা তাকে ঘিরে থাকুক না কেন।
মানুষের জীবনও অনেকটা এমনই। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কারণে অপেক্ষা করি—প্রিয়জনের জন্য, সফলতার জন্য, বা জীবনের অন্য কোনো স্বপ্নের জন্য। কিন্তু সেই অপেক্ষার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। আমরা জানি না কবে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসবে, তবুও আমাদের শিকড়গুলো জীবনের মাটিতে গেঁথে থাকে, এবং আমরা সেই শুষ্ক মাটির মাঝেও বেঁচে থাকার আশা করি।
মরুভূমির বৃক্ষের মতো, আমাদের জীবনও অনেক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। আমাদের ভালোবাসার মানুষ দূরে চলে যায়, অথবা আমরা আমাদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি না। কিন্তু তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও, আমরা অপেক্ষা করতে শিখি। এই অপেক্ষার মাঝেই আমরা জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে পাই—সেই প্রতীক্ষা আমাদের মানসিক শক্তি ও ধৈর্যকে গড়ে তোলে।
তৃষ্ণার মাঝে এই আশার আলোই আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। যেমন বৃক্ষের প্রতিটি শাখা বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, তেমনি আমাদেরও মন প্রতিনিয়ত সেই ভালোবাসা, শান্তি, বা সফলতার জন্য প্রতীক্ষা করে। আমরা জানি না কবে সেই বৃষ্টি আসবে, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই।
এখানে বৃষ্টির অপেক্ষা শুধুই প্রকৃতির একটি ঘটনার প্রতীক নয়, বরং এটি জীবনের পরিবর্তনেরও প্রতীক। যেমন মরুভূমিতে একদিন বৃষ্টি এসে সবকিছু বদলে দিতে পারে, তেমনি আমাদের জীবনেও একদিন কিছু ঘটতে পারে, যা আমাদের সমস্ত তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই দিনটি আসার আগ পর্যন্ত, আমাদের কাজ হলো অপেক্ষা করা, ধৈর্য ধরে বেঁচে থাকা।
বৃক্ষের মতোই, আমরা তৃষ্ণার্ত হতে পারি, কিন্তু আমাদের ধৈর্য ও অপেক্ষার মধ্যেই জীবনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তৃষ্ণার্ত থাকা মানে কখনো কখনো জীবনের প্রতি আরও গভীরভাবে আকৃষ্ট হওয়া, কারণ সেই তৃষ্ণাই আমাদের বেঁচে থাকার মূল চালিকা শক্তি।
যেন ধূসর বৃক্ষ, মরুভূমির বুকচেরা শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকে, তৃষ্ণার্ত—কিন্তু তার প্রতিটি শিকড়ে বাঁচার জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, প্রতিটি পাতায় একদিন বৃষ্টি আসার আশার আভাস।