Posts

গল্প

"বিবেকের ডাকে ফিরে আসা"

September 24, 2024

তাহসিন আরিফ হিমেল(INNOVA JOURNAL)

68
View

নগরজীবনের ব্যস্ততার মাঝে বাস করত রাশেদ। সে ছিল এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, যার ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। কাজ, সম্পদ, এবং সাফল্যের দৌড়ে রাশেদ কখনো থামত না। তার কাছে জীবন মানে ছিল প্রতিযোগিতা—আরও বড় হওয়া, আরও সম্মান, আরও ক্ষমতা অর্জন করা। দিনের পর দিন সে কাজের পেছনে ছুটত, আর নিজের চারপাশের ছোটখাটো সুখগুলো উপেক্ষা করত। বন্ধু-বান্ধব, পরিবার—সবকিছুকে সে একপাশে ঠেলে রেখে শুধু সাফল্যের চিন্তা করত।

কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই রাশেদের জীবন বদলে গেল। এক রাতে ঘুমের মাঝে সে একটি স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে সে নিজেকে দেখল একটি বিশাল সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে, আর চারদিকে শুধু পানির ঢেউ। হঠাৎ, একটি কণ্ঠস্বর তার কাছে এসে বলল, "তুমি এত কিছু অর্জন করেছ, কিন্তু নিজেকে কি চিনেছ?" সেই অদ্ভুত প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে রাশেদ ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তার মনের ভিতর সেই কথাটি গেঁথে গেল—"নিজেকে কি চিনেছ?"

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর সে খুঁজে পেল না। সারা জীবন ধরে এত কাজ করেছে, এত অর্জন করেছে, কিন্তু নিজেকে চিনতে কি সে কোনো সময় দিয়েছে? তার মনের গভীরে একটি শূন্যতা কাজ করতে লাগল, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। রাশেদ বুঝতে পারল যে, তার জীবনের সাফল্য আসলে বাহ্যিক, কিন্তু ভেতরের শান্তি কোথায়?

এভাবেই দিন কাটছিল। একদিন হঠাৎ তার ছোটবেলার বন্ধু কামাল তাকে ফোন করল। কামাল গ্রামে থাকত, আর সাদামাটা জীবনযাপন করত। তার কোনো বড় সাফল্য ছিল না, কিন্তু তার জীবন ছিল সুখে পরিপূর্ণ। কামাল রাশেদকে বলল, "বন্ধু, এতদিন হয়ে গেল, একবার গ্রামে এসে দেখা কর না। আমরা ছোটবেলার অনেক স্মৃতি নিয়ে বসে গল্প করব।"

কিছুটা দ্বিধায় পড়লেও রাশেদ শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল, সে একবার গ্রামে যাবে। বহুদিন পরে, গ্রামে পা রাখা মাত্রই তার মনে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। গ্রামের সেই খোলা বাতাস, সাদামাটা জীবন, আর মানুষের নির্ভেজাল হাসি যেন তার ব্যস্ত জীবনের সব ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে দিল। রাশেদ প্রথমবার অনুভব করল, কতটা শান্তি আছে এই সহজ-সরল জীবনে।

কামালের সাথে বসে বসে রাশেদ ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে করতে লাগল। সেই দিনগুলো যখন তারা মাটির মাঠে খেলে বেড়াত, যখন সাফল্যের কোনো চাপ ছিল না, যখন জীবনের মানে ছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য আর বন্ধুত্বের মধুরতা। রাশেদ ভাবতে লাগল, সে কবে থেকে এতটা পাল্টে গেল? কেন সে এতটা ব্যস্ত হয়ে গেল যে জীবনের এই ছোট্ট সুখগুলো উপেক্ষা করতে লাগল?

গ্রামে কাটানো কয়েকদিনের মধ্যেই রাশেদ বুঝতে পারল, জীবনের আসল সাফল্য শুধু অর্থ বা ক্ষমতায় নয়। কামালকে দেখে তার উপলব্ধি হলো, সুখের জন্য প্রয়োজন নিজেকে চেনা, নিজের চারপাশের মানুষদের ভালোবাসা দেওয়া, আর প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবন যাপন করা।

একদিন বিকেলে রাশেদ গ্রামের নদীর ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। তখন কামাল তার পাশে এসে বসে বলল, "তোর শহরের জীবনে তো সবকিছু আছে, কিন্তু তুই কি কখনো এই শান্তি পেয়েছিস?" রাশেদ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তার চোখের কোণে পানি চলে এলো। সে বুঝল, শহরের সাফল্য তাকে বাহ্যিকভাবে বড় করেছে, কিন্তু তার অন্তর থেকে সে আসলে ছোট হয়ে গেছে।

সে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিল, নিজের জীবনের গতিপথ পাল্টাবে। শহরে ফিরে যাওয়ার পর রাশেদ তার জীবনের প্রাধান্যগুলো পরিবর্তন করতে শুরু করল। কাজ আর প্রতিযোগিতার বাইরে সে নিজেকে সময় দিতে শুরু করল। পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে লাগল। ধীরে ধীরে রাশেদ তার জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে পেল। একসময় যে দৌড়ের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, এখন সেই দৌড় থামিয়ে সে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

রাশেদ জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছিল, কিন্তু সময়মতো ফিরে এসে নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজে পেয়েছিল। তার জীবনের এই পরিবর্তন শুধু তাকে নয়, তার আশেপাশের মানুষকেও উপকৃত করল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, কেমন করে একজন ব্যস্ত ব্যবসায়ী সাফল্যের বাইরেও জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পেল।


---

মূল বার্তা: জীবনের সাফল্য শুধুমাত্র বাহ্যিক অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিজের অন্তরকে চেনার মধ্যে নিহিত। কর্মজীবনের প্রতিযোগিতার মাঝে অনেকেই নিজেদের হারিয়ে ফেলে, কিন্তু সঠিক সময়ে ফিরে আসলে জীবনের আসল মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

Comments

    Please login to post comment. Login