Posts

চিন্তা

"অসুস্থ চিন্তার সমাজ: বাঙালি মুসলমানদের এক নতুন সূচনা"।

September 25, 2024

তাহসিন আরিফ হিমেল(INNOVA JOURNAL)

Original Author নিজে

74
View

অসুস্থ চিন্তার সমাজ

বাঙালি মুসলমানদের সমাজের চিন্তার অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে, প্রথমেই মাথায় আসে একটি প্রবাদ, “গাছের মূলে পানি দিলে ফল হবে।” অর্থাৎ, সমাজের চিন্তার মূল স্তরেই সমস্যা থাকলে, ফলাফলও হবে পুঞ্জিভূত অস্থিরতা। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের চিন্তাভাবনা, ধর্মীয় প্রথা, সামাজিক আচরণ—এসবই মিলে তৈরি করে একটি অসুস্থ চিন্তার কাঠামো, যেখানে প্রচলিত কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আধিক্য দেখা যায়।

প্রথা ও কুসংস্কারের অবক্ষয়

ছোট্ট একটি গ্রামে হোসেন নামের একজন যুবক থাকেন। হোসেন প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু তার সমাজের প্রথা ও কুসংস্কার তাকে একাধিকবার ঘিরে ধরেছে। গ্রামের মসজিদে হোসেনকে যখন দেখা যায়, তখন সে সবসময় অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে ব্যস্ত থাকে। ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে গভীর চিন্তা করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার চারপাশের মানুষদের চিন্তা-চেতনা তাকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়।

গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করে, একাধিক মাস আল্লাহর নাম নিয়ে কিছু করা উচিত। তারা মনে করে, যদি কেউ কিছুদিন নামাজ না পড়ে, তবে তার জীবনে বিপদ আসবে। হোসেন সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “কেন আমরা নিজেদের মধ্যে এতো অশান্তি ছড়াই? আল্লাহর কাছে একবার সঠিকভাবে ফিরে আসা তো আমাদের ওপর বাধ্যতামূলক।”

কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে রাজি নয়। তারা বলতে থাকে, “হোসেন ভাই, তুমি এসব কথার মাধ্যমে আমাদের ঈমানকে খাটো করছো। ঈমানের জন্য তো কিছু কঠিন নিয়ম পালন করতেই হবে।”

সামাজিক চাপের কাছে হার

হোসেন বুঝতে পারে, সমাজের এই অসুস্থ চিন্তাভাবনা তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। কিছুদিন পরে, গ্রামের লোকেরা একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে প্রচুর মিষ্টি তৈরি হয়। সেখানে এক যুবক হাজির হয় এবং বলে, “এটি সম্পূর্ণ হারাম। এভাবে ইসলামকে অপমান করা হচ্ছে।” সবার মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। হোসেন আবারও বোঝানোর চেষ্টা করে, “আমরা কেবল আনন্দের জন্য এই অনুষ্ঠান পালন করছি। ইসলাম তো আনন্দকে নিষেধ করে না।”

কিন্তু সমাজের চাপের কারণে, হোসেনের কথা কোনও গুরুত্ব পায় না। গ্রামের লোকেরা বলল, “এটা তো আমাদের প্রথা। আমরা আমাদের দাদা-দাদি থেকে শিখেছি।”

চিন্তার সংকট

একদিন, হোসেনের সাথে গ্রামের মুসলমানদের এক সভা হয়। সভায় বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা উপস্থিত ছিল। হোসেন সাহস করে বলতে শুরু করল, “আমরা আমাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতে পারলে, আমাদের সমাজ অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে। ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সঠিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে, কিন্তু তা যেন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সীমায় না যায়।”

তবে সেখানে উপস্থিত সবাই হোসেনকে উপেক্ষা করে। একজন বৃদ্ধ বললেন, “এভাবে কথা বলে তুমি আমাদের বোকা বানাচ্ছো। এটা তো আমাদের দীর্ঘ দিনের সংস্কৃতি।”

হোসেনের মনে এক ভীতি জন্ম নিল। “তাহলে কি আমি একাই এসব কথা বলব? আমাদের সমাজ কি সত্যিই পরিবর্তন হবে না?”

পরিবর্তনের আশা

এক রাতে, হোসেন নিজের চিন্তা নিয়ে ভাবছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে গ্রামে একটি সেমিনারের আয়োজন করবে, যেখানে মুসলিম সমাজের চিন্তার অবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে। সে জানাল, গ্রামের সমস্ত যুবকদের সেমিনারে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।

সেমিনার দিন, গ্রামের যুবকরা এসে জড়ো হল। তারা জানল, হোসেন তাদের উদ্দেশে একটি বক্তব্য দিতে চান। হোসেন শুরু করল, “আমরা মুসলমান, কিন্তু আমাদের চিন্তার মধ্যে অসুস্থতা রয়েছে। আমরা যদি নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনতে পারি, তবে আমাদের সমাজ আরও উন্নত হবে।”

বক্তব্যটি শোনার পরে যুবকরা আলোচনায় যুক্ত হলো। তারা ধর্ম, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণ নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। অনেকে হোসেনকে সমর্থন দিল, বলল, “হ্যাঁ, আমাদের চিন্তার অবক্ষয় দূর করতে হবে।”

চ্যালেঞ্জ ও বাধা

তবে, গ্রামের প্রবীণরা এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারা হোসেনকে সতর্ক করলেন, “এটি একটি বিপজ্জনক পথ। আমাদের সংস্কৃতি বিপন্ন হতে পারে।”

হোসেন কিন্তু ভেঙে পড়ল না। সে জানত, সমাজে পরিবর্তনের জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। সে অব্যাহতভাবে যুবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। সে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিছু পরিবর্তন আনার জন্য সচেষ্ট হলো।

সফলতা ও অসুখী সমাজ

কিছুদিন পর, গ্রামে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। যুবকেরা এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। তবে প্রবীণরা এই পরিবর্তনে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা বলল, “এগুলো আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী।”

এ অবস্থায় হোসেন বুঝতে পারল, সমাজের চিন্তার এই অসুস্থতা একটি রোগের মতো। একদিকে যেখানে পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে অন্যদিকে রয়েছে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। এভাবে চলতে থাকলে সমাজের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকবে।

নতুন যুগের সূচনা

একদিন হোসেনের মেয়ে, সুরাইয়া, কলেজ থেকে ফিরে এসে বলল, “বাবা, আমাদের মধ্যে একটি নতুন চিন্তার প্রয়োজন। আমরা নতুন প্রজন্ম। আমরা যদি নিজেদের মধ্যে চিন্তার এই অসুস্থতা দূর করতে না পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।”

হোসেন সুরাইয়ার কথা শুনে মনে মনে খুশি হলেন। তিনি জানতেন, নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবর্তনের একটি সুযোগ রয়েছে। তিনি সুরাইয়াকে বললেন, “তুমি ঠিক বলেছো। আমাদের চিন্তার সংস্কার প্রয়োজন। তবে এটি সময়সাপেক্ষ।”

ভবিষ্যতের আশা

সুরাইয়া হোসেনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে গ্রামে এক নতুন আন্দোলন শুরু করল। তারা ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং আধুনিকতার সমন্বয়ে একটি কার্যক্রম গঠন করল। যুবকেরা আগ্রহী হয়ে উঠল। হোসেনের চিন্তা আর সুরাইয়ার উদ্যোগে গ্রামে একটি পরিবর্তনের সূচনা হলো।

গ্রামের তরুণ-তরুণীরা একটি নতুন আগ্রহ নিয়ে আলোচনা শুরু করল। ধর্মীয় কার্যক্রমে নতুনত্ব আনা হলো, যেখানে পুরনো এবং নতুনের সংমিশ্রণ ঘটানো হলো। তারা বুঝতে পারল, সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু তা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের সীমার বাইরে।

উপসংহার

এইভাবে, হোসেন ও সুরাইয়ার নেতৃত্বে গ্রামের মুসলমানদের সমাজে একটি নতুন চিন্তার সূচনা হলো। অসুস্থ চিন্তা থেকে মুক্তির পথ তৈরি হলো। পরিবর্তনটা আস্তে আস্তে হলেও, এটি ছিল একটি চিরস্থায়ী এবং সঠিক পরিবর্তনের প্রমাণ।

এখন গ্রামের যুবকেরা জানে, চিন্তার অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদের নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। এভাবেই, তারা আশা নিয়ে নতুন যুগের দিকে এগিয়ে যাবে, যেখানে বিশ্বাস, সংস্কৃতি, এবং আধুনিকতার সমন্বয়ে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে।

Comments

    Please login to post comment. Login