সূর্য তখনও পুরোপুরি অস্ত যায়নি। গোধূলির ম্লান আলোতে ঢাকা শহরকে ভিন্নরূপে দেখা যায়। ইট, কাঠ, কংক্রিটের এই শহরে দিনের শেষে ব্যস্ততা কমলেও, মানুষের মনের অশান্তি যেন কোনদিন থামে না। রাত যতই গভীর হোক, তার মনোস্তাপ আরও গভীর হয়।
সেদিন ছিল অন্যরকম। সোহান বসে ছিল তার ঘরের কোণে, ছোট একটা চেয়ারে। বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল, কিন্তু তার মন তা ধরতে পারছিল না। গত ক’দিন ধরে সে কিছুতেই তার মনকে শান্ত করতে পারছিল না। সবকিছুই যেন ভেঙে পড়ছে তার চারপাশে। চাকরি নেই, আর্থিক অনিশ্চয়তা, পারিবারিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে সে নিজেকে একঘেয়ে, নিষ্ফল মনে করছিল। দিনগুলো যেন কেবল পালিয়ে যাচ্ছে, আর তার হাত-পা বাঁধা। তার জীবন যেন থেমে গেছে।
হঠাৎ, মায়ের ডাকে সে বাস্তবে ফিরে আসে।
"সোহান, তুই একটু দোকানে যাবি?" মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠলেন।
"হ্যাঁ, মা," বিরক্তিভরা স্বরে সে উত্তর দিল। সোহান উঠল, কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগ্রহ তার মনে ছিল না। তবুও মায়ের কথা ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না সে। পকেটে কিছু টাকা নিয়ে, ধীর পায়ে সে বেরিয়ে পড়ল।
বাইরে এসে সে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর দোকানের কথা মনেই থাকল না। সে হাঁটতে হাঁটতে শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছাল। জায়গাটা তার কাছে পরিচিত। ছোটবেলায় সে তার বন্ধুদের সাথে এখানে প্রায় আসত। এই জায়গায় এখন আর তেমন কেউ আসে না, সোহানের কাছে এটি একান্তে বসে থাকার একটা পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে।
একটা পুরনো বেঞ্চিতে বসে, সে পকেট থেকে ফোন বের করল। অগণিত নোটিফিকেশনের মাঝে সে শুধু স্ক্রল করে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই মন বসছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন চারদিকে বন্দি হয়ে গেছে। জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে না।
এই সময় হঠাৎই পাশে থেকে একটা অচেনা কণ্ঠ ভেসে এলো।
"তোমার জীবনটা বড্ড একঘেয়ে লাগছে, তাই না?"
সোহান চমকে উঠে পাশে তাকালো। সেখানে বসে ছিল একজন বয়স্ক মানুষ। তাকে সোহান কখনো দেখেনি। ধবধবে সাদা চুল, কিন্তু শরীরে শক্তির অভাব নেই, সেটা তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। চোখে ছিল গভীরতা, মুখে যেন কোনো চাপা হাসি লুকিয়ে আছে।
সোহান কিছুটা দ্বিধায় পড়ে বলল, "আপনি কে?"
বৃদ্ধ হেসে বললেন, "আমি কে তা জানার চেয়ে, তুমি এখন কী ভাবছো, তা জানা বেশি জরুরি।"
সোহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, "জীবনটা বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সবকিছু আটকে গেছে। কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না। কী করব, সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত।"
বৃদ্ধ লোকটি মৃদু হেসে বললেন, "তুমি কি জানো, এই পৃথিবীর সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চলেছে, কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা লক্ষ্যটা ভুলে যাই। আমরা ভাবি, গতি থেমে গেছে, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তা থামে না।"
সোহান প্রশ্ন করল, "কিন্তু আমি তো থেমে গেছি, আমার কোনো অগ্রগতি নেই।"
"থেমে যাওয়াটাও এক ধরনের অগ্রগতি। তুমি যদি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপলব্ধি করতে পারো, তবে থেমে যাওয়াটাও তোমার জন্য শিক্ষার অংশ হতে পারে," বৃদ্ধ বললেন। "তুমি হয়তো এখন বিভ্রান্ত, কিন্তু এটাই তোমাকে পরবর্তী পথের দিকে এগিয়ে নেবে।"
সোহান কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। সে বৃদ্ধের কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন।
"তোমার জীবনে যাত্রা তো মাত্র শুরু হয়েছে। লক্ষ্যটা স্থির করো, আর ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছাবে," এই বলে তিনি চলে গেলেন।
সোহান তার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার মধ্যে নতুন কিছু জেগে উঠছে। সেদিনের সেই কথাগুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগল। সে বাড়ি ফিরে এল, কিন্তু আগের সোহান আর নেই। তার মনে এখন আর কেবল হতাশা নেই, বরং কোথাও একটা নতুন আশার আলো দেখা দিচ্ছে।
পরবর্তী ক'দিন ধরে সোহান নিজের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সে কী চায়? কী তাকে সুখী করবে? দিনের পর দিন সে নিজের মধ্যে পরিবর্তন খুঁজে পেল। তার আগের সেই হতাশা, অসন্তোষ কেটে গিয়ে, তার ভেতরে একটা নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটল।
একদিন রাতে, সে সিদ্ধান্ত নিলো, যা-ই হোক, সে আর নিজের জীবনকে থামতে দেবে না। হয়তো সবকিছু তার হাতে নেই, কিন্তু যেটুকু আছে, সেটুকুর মধ্যেই সে নিজের পথ খুঁজে নেবে।
তার পুরনো কিছু পরিকল্পনা ছিল, যেগুলো সে নানাভাবে ফেলে রেখেছিল। লেখালেখি, বই পড়া, এমনকি নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে ছিল তার। সে সবগুলোই আবার শুরু করল।
তার লেখালেখির অভ্যাস আবার ফিরে এল। রাতে ঘরে বসে সে তার কল্পনার জগতের গল্প লিখতে লাগল। দিনগুলো ধীরে ধীরে কাটছিল, কিন্তু তার মনে একটা তৃপ্তি আসছিল। তার প্রতিদিনের কাজগুলো খুব ছোট হলেও, সে বুঝতে পারছিল, এগুলো তাকে ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য এনে দিচ্ছে।
বছরখানেক পর, সোহানের জীবনটা আর আগের মতো নেই। সে এখন একজন সফল লেখক। তার প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং তা পাঠক মহলে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সোহানের সেই পুরনো হতাশা আর নেই। সে এখন জানে, জীবনের যাত্রা কখনও সোজা নয়, কিন্তু লক্ষ্য স্থির থাকলে, ধীরগতিতেও সফল হওয়া যায়।
একদিন, সে আবার সেই পুরনো জায়গায় গেল, যেখানে প্রথম সেই বৃদ্ধ লোকটির সাথে তার দেখা হয়েছিল। সেখানে বসে সে মনে মনে হাসল। মনে পড়ল সেই কথাগুলো— "লক্ষ্য স্থির থাকলে, ধীরে হলেও গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।"
সোহান এখন তা উপলব্ধি করতে পারছে। তার যাত্রা ধীরে ধীরে চললেও, সে গন্তব্যে পৌঁছেছে।