পোস্টস

সমালোচনা

জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন: আদর্শিক বিভক্তি ও বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ"

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তাহসিন আরিফ হিমেল(INNOVA JOURNAL)

মূল লেখক হিমেল

জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন: এক অসম্ভব বাস্তবতা

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে একটি সুপরিচিত রাজনৈতিক দল, যাদের মূল আদর্শ ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের স্বপ্ন কখনো পূর্ণতা পাবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, জামায়াত ইসলামী এককভাবে ক্ষমতায় আসা শুধু কঠিন নয়, বরং অসম্ভব। ইসলামি দলগুলো একত্রিত হতে পারছে না এবং তাদের আদর্শ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

জামায়াতের রাজনৈতিক অঙ্গন: সংঘাত ও বিভক্তি

ইসলামী দলগুলো একত্রিত হতে পারছে না, এর পেছনে প্রধান কারণ তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শিক সংঘাত। জামায়াত ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, মতপার্থক্য এবং ক্ষমতার লড়াই রয়েছে। ইসলামি দলগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত। কেউ শরিয়া আইন পূর্ণ বাস্তবায়নের পক্ষে, কেউ বা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ইসলামি মূল্যবোধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এর ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একক কোনো শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও দেখা গেছে, ইসলামি দলগুলো কখনো এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তারা বরাবরই বড় দলগুলোর ছত্রছায়ায় থেকে রাজনীতি করেছে, যেমন জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব বিএনপির সঙ্গে। এর ফলে, তারা মূলত একটি সমর্থক বা সহযোগী দলের ভূমিকায় থেকেছে, যা তাদের মূল আদর্শিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ করেছে।

বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা

বাংলাদেশের সংবিধান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে, যদিও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা দেশের জনগণের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে, যা ইসলামি শাসনের মতো আদর্শকে গ্রহণ করার পথে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে প্রগতিশীল অংশ, এই ধারণার প্রতি সন্দিহান।

এছাড়াও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো এমন যে, গণতন্ত্র এখানে গভীরভাবে প্রোথিত। জনগণ তাদের সরকার নির্বাচন করে, এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ধারণা তেমনভাবে কাজ করে না। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শন এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে তারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন অর্জনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

ইসলামি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং ব্যর্থতা

জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও তাদের একত্রিত হতে বাধা দিচ্ছে। প্রথমত, তাদের নেতৃত্বে সঙ্কট রয়েছে। অনেক সময় দলগুলো নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে, যার ফলে দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ এবং নেতৃত্বের দিক থেকে একে অপরকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা বিদ্যমান। এ কারণে তারা কখনোই শক্তিশালী জোট গঠন করতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, ইসলামি দলগুলো দেশের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের পুরোপুরি সংযুক্ত করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ এবং বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এত বড় ফারাক যে, সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করতে আগ্রহী নয়। বিশেষ করে যুবসমাজ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামি শাসনের প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণা বোধ করে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: জামায়াতের বিচ্ছিন্নতা

বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসলামি দলগুলো বিশ্বের মূলধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মডেল এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব বর্তমানে গোটা বিশ্বে বিদ্যমান। জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক অবস্থান, যা মূলত শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করে, বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি বিরোধী। তারা বিশ্বব্যাপী যে উদারনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত, তার বাইরে অবস্থান করে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের সমর্থন পাওয়া খুবই দুরূহ।

ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার ধারণা বিশ্বব্যাপী যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবালাইজেশন, প্রযুক্তি, উদারনৈতিক অর্থনীতি এবং গণতান্ত্রিক চেতনা আধুনিক বিশ্বের মূল চালিকাশক্তি। এর বিপরীতে শরিয়া ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করতে পারে, যা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে গ্রহণযোগ্য নয়। জামায়াতে ইসলামী বিশ্বরাজনীতির এই প্রবণতার সঙ্গে কোনোভাবে সংযুক্ত নয় এবং তারা বৈশ্বিক পরিসরে বিচ্ছিন্ন।

জামায়াতের অতীত এবং ভবিষ্যৎ

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া—তাদের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, তারা কখনো এককভাবে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। যদিও তারা শিক্ষিত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশের সমর্থন পেয়েছে, কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছে।

জামায়াতের ভবিষ্যৎও একইরকম অনিশ্চিত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী একটি প্রান্তিক দল হিসেবে রয়ে গেছে। তাদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি দেশের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত নয়। একই সঙ্গে, বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর মতো তাদেরও অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো এত গভীর যে, তারা একত্রিত হয়ে শক্তিশালী জোট গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামি রাজনীতি সবসময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। একদিকে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অন্যদিকে ইসলামি দলগুলোর আদর্শিক কাঠামো—এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ইসলামি দলগুলোর সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনোই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না বলে ধারণা করা যায়।

উপসংহার: জামায়াতের স্বপ্নের অবাস্তবতা

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে এককভাবে ক্ষমতায় বসতে পারবে না, এ বাস্তবতা অপ্রত্যাশিত নয়। তাদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্তমান বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রেক্ষাপটের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা এই ব্যর্থতার মূল কারণ। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব, নেতৃত্বের সঙ্কট, এবং বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তাদের রাজনৈতিক স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে দেবে না।

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ধারণ করলেও, তারা গণতান্ত্রিক চেতনায় গভীরভাবে আস্থাশীল। জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলো এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে একত্রিত হতে না পারার কারণে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক স্বপ্ন আজীবন একটি অসম্ভব বাস্তবতায় থেকে যাবে, যা সময়ের সঙ্গে আরও প্রমাণিত হবে।