Posts

সমালোচনা

সম্পাদনা বিড়ম্বনা— জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

October 6, 2024

Muntaka Azmain Muhi

Original Author মুনতাকা আজমাইন মুহী

পাঠ্যক্রম অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ লেখক বা কবির মরণোত্তর সাহিত্যকর্ম প্রকাশনায় যা আমরা পড়ি বা যা আমাদের পড়ানো হয় সেগুলোতে সম্পাদকের অবহেলা, ভুল আর খামখেয়ালিপনা বিবেচনা করে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদে একটি “সম্পাদকীয়” কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে।

বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে বেশী সম্পাদনা বিড়ম্বনার তালিকা করলে সর্বপ্রথম স্থানে থাকবেন জীবনানন্দ দাশ। একজন জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় তিনি যা কিছুর মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তার বাইরে মরণোত্তর সাহিত্যকর্ম প্রকাশের বেলায় তিনি আরো কঠিন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। জীবনানন্দের মৃত্যুর ৭০ বছর পরে এসেও আমরা এমন এক রোডম্যাপ তৈরী করতে পারিনি যেখানে একটি যথাযথ সম্পাদনায় “জীবনানন্দ দাশ সমগ্র” নামক বই পৃথিবী’তে আলোর মুখ দেখবে। কারণ, অতীতে জীবনানন্দের বেশীরভাগ প্রকাশিত বইতে আছে যথাযথ সম্পাদনার ঘাটতি সহ বানান প্রমোদ এবং আনুষঙ্গিক ভুল। যা ঠিক না করা অবধি কোনোভাবেই জীবনানন্দ দাশ সমগ্র প্রকাশ করা উচিত হবে না। এরমধ্যে সুসংবাদ এটি যে, বর্তমানে সুসম্পাদিতভাবে জীবনানন্দের অপ্রকাশিত লেখা প্রকাশ পাচ্ছে এবং সামনে আরো পাবে। কিন্তু, তা ঠিক কোথাও সংকলিত হচ্ছে না। শুধু আলাদাভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকটা দেরীতে হলেও এখনো এই কাজ চলমান বলে স্বস্তি মিললেও অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়ে আছে নিশ্চিত এক অনিশ্চয়তা। জীবনানন্দের প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত সব লেখা মিলিয়ে ভবিষ্যৎকালে সব লেখা জীবনানন্দ দাশ সমগ্র’তে আদৌ ঠিকঠাকভাবে সংকলিত হচ্ছে কিনা সেটিই এখন একমাত্র দেখার বিষয়। এতো বেশী বইয়ে, এতো বেশী প্রকাশনায় জীবনানন্দের লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে তাঁর সব লেখাকে সংকলিত করা যত দিন অতিক্রম হচ্ছে তত জটিলতার দিকে আগাচ্ছে। তাও আমাদের আশাবাদী হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই যে একদিন জীবনানন্দের সব সাহিত্যকর্ম খণ্ড আকারে গ্রন্থভুক্ত হবে। কোনো প্রকাশনীর আন্তরিক প্রচেষ্টা কিংবা দলীয় গবেষকদের সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া ছাড়া এর সুরাহা করা হয়তো আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কলকাতায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সম্পাদক হিসেবে চণ্ডিকা প্রসাদ ঘোষালের আবির্ভাব যতটুকু সার্বজনীনতা আর গ্রহণযোগ্যতা এনেছে, ঐ একই সময়ে বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশকিছু সাহিত্যকর্ম নিয়ে এসেছে আপাদমস্তক আবর্জনা। চণ্ডিকা প্রসাদ ঘোষালের সম্পাদনায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা আলাদা দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে: ১) দিনলিপির বিভূতিভূষণ। ২) ভ্রমণলিপির বিভূতিভূষণ।— সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত এসব বইয়ে মুদ্রনপ্রমোদ থেকে শুরু করে কোনো ঘাটতিই যেন নেই। পাশাপাশি, বাংলাদেশ থেকে সদ্য প্রকাশিত বিভূতিভূষণের সাহিত্যকর্মে সম্পাদকের ভূমিকা তো শূন্যের কোটায়, তাছাড়া যেন প্রকাশকই সব। একজন লেখক— তিনি হোক জীবিত কিংবা মৃত, তাঁর ভাগ্য প্রকাশক নির্ধারণ করবেন, নিয়তির এমন পরিহাস হয়তো পৃথিবীতে আর নেই। বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের সেসব বইয়ের প্রকাশনার এমন উদ্ভট প্রচার যেন নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ। তারমধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে: এন্টিক / ভিন্টেজ নামকরণ, অটোগ্রাফ বিড়ম্বনা, আগে প্রকাশ না হওয়ার মতো চটকদার আলাপ— সবমিলিয়ে যা ইচ্ছে তা অবস্থা। এসব বই প্রকাশে অগাধ আলোচনা আর প্রচারণা আছে ঠিক, কিন্তু সম্পাদনার যথাযথ এক শিল্প বলে যে কিছু আছে তার ছিটেফোঁটা নেই। এই প্রসঙ্গের শেষ কথা হচ্ছে, স্রেফ ভালো প্রকাশনায় বই বের করা ছাড়া যত আজগুবি প্রচার প্রসার বিদ্যমান তা তারা করলেও, সৎ সাহসিকতায় পুনঃ প্রকাশ বা সমগ্র থেকে প্রকাশের মতো বিষয় তারা এড়িয়েই গেছেন। মূলত, এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করারও ছিলো না তাদের, কারণ, ভালো সম্পাদনার ঘাটতিতে একজন বিভূতিভূষণ গবেষকের আত্মপ্রকাশ যে নেই ঠিক সে কারণে।

এমন সম্পাদনা বিড়ম্বনা যে কেবল বাংলা সাহিত্যেই হয় তা ভাবার অবকাশ নেই, বিদেশী সাহিত্যেও এমন ঘটনার দেখা মিলে। টি. এস. এলিয়ট, সিলভিয়া প্লাথ, এমিলি ডিকিনসন সহ অনেকের লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রেই সম্পাদনা বিড়ম্বনা চোখে পড়ার মতো। সেসব নিয়ে আলোচনা অন্য কোনো দিন।

Comments

    Please login to post comment. Login