Posts

নন ফিকশন

অনন্ত যাত্রার গল্প

October 21, 2024

তাহসিন আরিফ হিমেল(INNOVA JOURNAL)

Original Author হিমেল

43
View

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা কেউ না কেউ এমন এক অন্তর্নিহিত চিন্তার মধ্যে বাস করি, যেখানে মৃত্যু এক অমোঘ বাস্তবতা হিসেবে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। এই ধারণা আমাদের মনে যেন এক অদৃশ্য বাধা তৈরি করে—আমরা চিরকাল বাঁচার প্রত্যাশা নিয়ে চলি, অথচ প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ার এক সরল রৈখিক যাত্রা। যে যাত্রা শেষ হবে একদিন, অজানা কোন মোড়ে। রুহুলের মতোই আমাদের সবার মনের ভেতর এক অস্পষ্ট অস্বস্তি কাজ করে, যখন আমরা মৃত্যুর চিন্তা করি। কিন্তু এই অস্বস্তি থেকে মুক্তির উপায় কি? জীবন কি শুধুই এক চক্রের মাঝে ঘুরপাক খাওয়া? নাকি মৃত্যুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের প্রকৃত রূপ?

মৃত্যুর নিশ্চিততা এবং জীবনের অনিশ্চয়তা

রুহুলের গল্পটি এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। তার জীবনের এক পর্যায়ে এসে সে বুঝতে পারল, মৃত্যুর নিশ্চিততাই আসলে জীবনের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা। মানুষ বেঁচে থাকে নিজের বেঁচে থাকার চিন্তায়, কিন্তু সব সময় এই নিশ্চিত জ্ঞান তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে—একদিন সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এই শেষের ভয়ই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। রুহুলের মনে প্রতিদিনই এই ভয় তাড়া করে ফিরত। তার প্রতিটি পরিকল্পনা, প্রতিটি আশা যেন মৃত্যুর ছায়ার নিচে হারিয়ে যেত।

কিন্তু একদিন ধানমণ্ডির সেই পার্কে রুহুলের জীবনে আসে পরিবর্তন। বুড়ো মানুষটির সঙ্গে কথোপকথন যেন তার চোখের পর্দা সরিয়ে দিল। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, জীবনকে উপভোগ করতে হলে মৃত্যুর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। মৃত্যু মানেই শেষ নয়, বরং এক নতুন শুরু। বুড়ো মানুষটি রুহুলকে দেখালেন, কিভাবে জীবন এবং মৃত্যুর চিরন্তন সত্যকে গ্রহণ করে নিজের জীবনকে আরও অর্থপূর্ণ করে তোলা যায়।

জীবনের মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করা

এই উপলব্ধি রুহুলের চিন্তাকে নতুন করে গড়ে তুলল। আগে যেখানে প্রতিটি মুহূর্তকে মৃত্যুর ভয়ে কাটাতো, এখন সে দেখল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আসলে এক অমূল্য রত্নের মতো। আমরা যদি প্রতিটি মুহূর্তকে জীবনের শেষ মুহূর্ত হিসেবে ভাবতে পারি, তবে সেই মুহূর্তগুলো আরও গভীর এবং মূল্যবান হয়ে ওঠে।

এই উপলব্ধি আমাদের জীবনের মূল্যবোধকেও নতুন রূপ দেয়। আমাদের প্রতিদিনের কাজগুলো, সম্পর্কগুলো, এবং ভালোবাসার জায়গাগুলো আরও গুরুত্ব পায়। আমরা আমাদের কাজগুলোতে আরও যত্ন নিই, আমাদের ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তুলি, এবং প্রতিটি মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করে তোলার চেষ্টা করি। কারণ, প্রতিটি মুহূর্তই শেষ মুহূর্ত হতে পারে—এটাই জীবনের বড় সত্য।

জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব এবং চিরন্তন সত্য

রুহুলের উপলব্ধি থেকে আরও একটি বড় শিক্ষা আমরা পেতে পারি। জীবন-মৃত্যুর এই দ্বন্দ্ব আসলে আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। যদি মৃত্যু না থাকত, তবে আমাদের জীবন কি এতটা অর্থপূর্ণ হতো? মৃত্যু আমাদের শেখায় যে আমাদের সময় সীমিত, এবং এই সীমিত সময়ের মধ্যেই আমাদের সবকিছু করতে হবে। মৃত্যুর ধ্রুব সত্যকে মেনে নেওয়া মানে জীবনের প্রতিটি কাজকে আরও সচেতনভাবে করা, প্রতিটি সম্পর্ককে আরও যত্ন সহকারে লালন করা।

আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যদি সীমাহীন হতো, তবে হয়তো আমরা জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারতাম না। মৃত্যু আমাদের শেখায় কিভাবে আমরা জীবনের ছোট ছোট জিনিসগুলোকে মূল্য দিতে পারি। আমাদের কাছের মানুষ, আমাদের শখ, আমাদের সৃষ্টিশীল কাজ—সবকিছুই মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে আরও বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে।

মৃত্যুর ভয়ে নয়, জীবনের আকাঙ্ক্ষায় বাঁচা

রুহুলের জীবনের যাত্রা থেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পেতে পারি—আমাদের মৃত্যুর ভয়ে নয়, বরং জীবনের প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচতে হবে। মৃত্যু আমাদের জীবনকে যেভাবে পরিচালিত করে, সেই নিয়ন্ত্রণ আমরা যদি জীবনের হাতে তুলে দিতে পারি, তবে আমাদের জীবন আরও অর্থবহ হবে। আমরা যদি প্রতিটি দিনকে এক নতুন যাত্রার মতো দেখি, তবে মৃত্যুর ভয় আর আমাদের তাড়া করবে না। বরং জীবনকে আরও ভালভাবে যাপন করার জন্য আমরা প্রতিটি দিনকে গ্রহণ করব।

রুহুল তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিল সেই বুড়ো মানুষটির কাছ থেকে, যিনি তাকে দেখিয়েছিলেন কিভাবে মৃত্যুকে গ্রহণ করা যায় এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসা যায়।

ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানের মূল্য

আমরা সাধারণত আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে উপেক্ষা করি। সবকিছুই যেন আগামীকাল আরও ভালো হবে, অথবা আমরা যা চাই, তা ভবিষ্যতে কোনো একদিন পেয়ে যাবো—এই চিন্তা আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভবিষ্যত কখনো আসবে না। আমরা যখন আজকে ভাবি, তখন সেই "আজ" ই আমাদের জীবনের একমাত্র সত্য। ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীলতা আমাদের বর্তমানের সময়কে নষ্ট করে দেয়।

রুহুলের জীবনের এই শিক্ষা আমাদের শেখায় যে, বর্তমানই হলো জীবনের আসল সম্পদ। আমরা যদি বর্তমানকে উপভোগ করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতের কোনো অর্থ থাকবে না। বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তকে সর্বোচ্চভাবে যাপন করতে পারলেই আমরা সত্যিকার অর্থে জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারি।

জীবনের উদ্দেশ্য এবং মৃত্যুর পরম সত্য

রুহুলের যাত্রা শেষে সে বুঝতে পারল যে, জীবনের প্রকৃত অর্থ হলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থপূর্ণ করা। জীবনের উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি মুহূর্তকে নতুনভাবে গ্রহণ করা এবং মৃত্যুর সঙ্গেও সমঝোতা করা। মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, বরং জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

মৃত্যুর পর আমরা কিছু রেখে যেতে পারি—আমাদের কাজ, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের স্মৃতি। এই জিনিসগুলোই আমাদেরকে মৃত্যুর পরেও বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের কাজগুলো যদি মানুষের হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়, তবে আমরা মৃত্যুর পরেও তাদের মনে বেঁচে থাকি।

রুহুলের উপলব্ধি আমাদেরকে জীবনের এক নতুন অর্থ শেখায়। মৃত্যু শুধু এক সমাপ্তি নয়, বরং জীবনের এক নতুন দিগন্তের শুরু। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি কাজকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

জীবনের নশ্বরতা এবং অমরত্বের সন্ধান

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হলো নশ্বরতা। আমরা সবাই একদিন চলে যাবো, কিন্তু আমাদের কাজগুলো থেকে যাবে। আমাদের কর্ম, আমাদের চিন্তা, আমাদের ভালোবাসা—এই সবকিছুই আমাদের মৃত্যুর পরেও পৃথিবীতে থেকে যাবে।

রুহুলের মতো আমরা যদি প্রতিটি কাজকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারি, তবে আমরা আমাদের নিজেদের এক ধরনের অমরত্ব খুঁজে নিতে পারি। আমাদের কাজ, আমাদের সৃষ্টিশীলতা, এবং আমাদের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমাদেরকে অমর করে তোলে।

জীবনের শেষ কথা

জীবন এবং মৃত্যুর এই চিরন্তন দ্বন্দ্ব আমাদের শেখায় যে, আমরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে পারি যদি আমরা মৃত্যুকে মেনে নিতে শিখি। মৃত্যু আমাদের ভয় দেখায় না, বরং আমাদের জীবনকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।

রুহুলের মতো আমাদেরও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন করে গ্রহণ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে, এবং আমাদেরকে এমনভাবে বাঁচতে হবে যেন প্রতিটি দিনই আমাদের জীবনের শেষ দিন। তবেই আমরা জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবো, এবং মৃত্যুর পরও আমাদের স্মৃতি এবং কর্ম দিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো।

জীবনের শেষ কথা—মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু আমাদের জীবনকে কীভাবে যাপন করবো তা সম্পূর্ণ আমাদের হাতে।

Comments

    Please login to post comment. Login