শিল্পের ইতিহাসের অতীত অনেক পুরোনো হলেও যদি কেবল বিংশ শতাব্দী থেকেও আমরা দৃষ্টিপাত করি তাহলে সুস্পষ্টভাবে যা দেখা যাবে, তা হচ্ছে মানুষ নিজেদের যাবতীয় দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কিংবা বাস্তবতা থেকে দূরে থেকে প্রশান্তি লাভের জন্যে শৈল্পিক কর্মকাণ্ড’কে জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ বানিয়েছে বা শিল্পচর্চা করেছে। মানুষের সময়ে যখন থেকে “আধুনিকায়ন” বিষয়’টি প্রবেশ করেছে ঠিক তখন থেকেই মানবজীবনে শুরু হয়েছে নানাবিধ যান্ত্রিকতা। এসব যান্ত্রিকতা’তে পিষ্ট হতে হতে শিল্পের সান্নিধ্যলাভ মানুষকে দিয়েছে শান্তি। এই যে “নিজের জন্য” মতবাদে বিশ্বাস করে মানুষ কেবল নিজের জন্যেই এই শিল্পচর্চায় মগ্ন তা আজকের দিনে এসেও প্রাসঙ্গিক। যে লেখিকা ২০২৪ সালে এসেও সাহিত্যে নোবেল জিতলেন তাঁর লেখাতেও আত্মকেন্দ্রিকতার চিহ্ন সুস্পষ্ট। নিজেকে মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগিয়ে জগতের মঙ্গল সাধনের প্রচেষ্ঠার ধারণা, ঠিক একইভাবে গৌতম বুদ্ধের দর্শনেও আমরা দেখতে পাই। মানুষেরা নিজের হয়ে বা নিজের জন্যে কাজ করেও পৃথিবী’র জন্যে মঙ্গল বয়ে আনতে পারে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
শিল্পের সান্নিধ্যে থাকলে আর্থিক নিশ্চয়তা মিলবে— এটি পুরোপুরিভাবে সত্য নয়। আবার, শিল্পের সান্নিধ্যে দরিদ্রতা চিরকাল লেগেই থাকবে— এটিও পুরোপুরিভাবে সত্য নয়। শিল্পচর্চায় অর্থলাভ বরং একটি বাড়তি পাওনা হতে পারে। অর্থের জন্যেই কেবল কেউ শিল্পচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করে, এমন ধারণার মধ্যেই ভুল আছে। যে সমাজে ও যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, তা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবেই পুঁজিবাদকতৃক নিয়ন্ত্রিত। শিল্পের মধ্যে অর্থের অনুসন্ধানী মানুষের সবসময় মনে রাখা উচিত যে, শিল্প থেকে অর্থের ধারণা বাদ দেয়ার পর একজন শিল্পীর জীবনে যা অবশিষ্ট থাকে তার মধ্যেই আমাদের মুক্তি নিহিত। ঋত্বিক ঘটকের কথাটিই মনে হয় এখনো অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক, দুনিয়ায় টাকা থাকবে না, কিন্তু কাজ গুলো থেকে যাবে সব।
সক্রেটিস থেকে মানসুর হাল্লাজ পর্যন্ত মানুষের ভেতর জিজ্ঞাসা ও সৃষ্টির যে আকাঙ্ক্ষা চিরকাল বিদ্যমান তা সভ্যতার ভেতর চলতে চলতে জীবনানন্দের শোভনার পরিবর্তে লাবণ্যের সাথে সংসারে শেষ হয়। শিল্পীর জীবন বিয়োগাত্মক অথবা ধ্বংসাত্মক— যেকোনো একটি হতেই পারে। ভ্যান গঁ’র কান কাটা উন্মাদনার শীর্ষ পর্যায়ের বিষয় হলেও মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যাই ছিলো। এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা ভালো: মানুষেরা নিজের জীবনে যা করে অভ্যস্ত এবং তাদের নিজের জীবনে যা ঘটে, সেটিকেই তারা সবসময় স্বাভাবিক ধরে নেয়। বাকীদের সবকিছুকেই তাদের চিরকাল অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু, প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ জায়গা থেকে যে স্বকীয়তা বিদ্যমান, এটি আমরা সকলেই মানতে নারাজ।
অর্থের দিক বাদ দিয়ে কিংবা পরিবারের বোঝা হয়ে যারা শিল্পচর্চায় মগ্ন আছে, শিল্পচর্চার সান্নিধ্যে আছে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং সমালোচনার সুরে অবহেলিত করে রাখার মধ্যে কোনোপ্রকার গৌরব নেই। জীবনের ভিন্ন দিক সবসময় সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এটি জেনেও যারা প্রতিনিয়ত হার না মেনে নিজের সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে অথবা নিজের শৈল্পিক সত্তা’কে বাঁচিয়ে রেখেছে তারা আদতে পৃথিবী’র সৌন্দর্যে দুঃখ ভুলে থাকছে। নিজের কথা উদাহরণ হিসেবেও যদি ব্যবহার করি তাহলে বলতেই হয় যে—
১. ফিকশন ফ্যাক্টরি বা পোয়েটাইজারে আমার যাবতীয় লেখা কেউ পড়তে পারে।
২. থ্রেটস এপে আমার একাউন্ট থেকে বিভিন্ন বইয়ের খবর বা টুকরো লেখা কেউ পড়তে পারে।
৩. ইউটিউবে আমার চ্যানেলে বিভিন্ন প্রোজেক্ট, গান বা কবিতা আবৃত্তি কেউ দেখতে বা শুনতে পারে।
৪. আরো ভিন্নভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লেখালিখি, ড্রয়িং, রিভিউ সহ নানারকম কাজ তো আছেই। সামনে হয়তো আরো বিশাল কোনো কাজ শুরু করতেও প্রত্যাশী।
মূলত, মানুষেরা যা “চর্চা” করতে অভ্যস্ত, আমরা যদি তাদের আমাদের সাধ্য ও সুযোগ অনুযায়ী সাহায্য করি তাহলে প্রকৃত মেধার বিকাশ সম্ভব। সবকিছুকে সীমিত করে ফেলার মনোভাব একজন শিল্পীর জন্য সত্যিকার অর্থেই দুর্দশা নিয়ে আসতে পারে। নিজ নিজ জায়গা হতে আমাদের আশেপাশের শিল্পীগোষ্ঠীর অল্প খোঁজখবর নেয়া কিংবা কাজ নিয়ে কথা বলেও আমরা একজন শিল্পী’কে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।