পোস্টস

নন ফিকশন

মানবজীবনের সাত অধ্যায়: শেক্সপিয়ারের চোখে জীবন" –

৫ নভেম্বর ২০২৪

তাহসিন আরিফ হিমেল(INNOVA JOURNAL)

মূল লেখক তাহসিন আরিফ হিমেল

শেক্সপিয়ারের "সেভেন এইজেস অফ ম্যান": মানবজীবনের গভীর উপলব্ধি

শেক্সপিয়ারের "সেভেন এইজেস অফ ম্যান" (The Seven Ages of Man) কবিতাটি একটি চিরন্তন বিশ্লেষণ, যা মানবজীবনের সাতটি স্তরকে চিত্রিত করে। এই কবিতাটি থেকে আমরা আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, সেখানকার দায়িত্ব, সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি লাভ করি। শেক্সপিয়ার আমাদেরকে একটি নাট্যমঞ্চের রূপে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখান, যেখানে আমরা প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করি।

প্রথম স্তর: শিশুর অসহায়তা

জীবনের প্রথম স্তর হলো নবজাতক অবস্থান। শেক্সপিয়ার এই স্তরে শিশুর কান্নাকে চিত্রিত করেছেন, যা শিশু মনের প্রকৃত অসহায়তার প্রকাশ। শিশুরা প্রথমদিকে একেবারেই নির্ভরশীল; তাদের জীবনের শুরুতে তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং পুষ্টির জন্য পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। এই সময় শিশুরা শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও বড়দের সহানুভূতির প্রয়োজন অনুভব করে।

শিশু অবস্থায় মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। এই স্তরটি আমাদের শেখায় কিভাবে আমরা আমাদের প্রাথমিক চাহিদাগুলি পূরণ করতে পারি এবং জীবনের সূচনাতে আমাদের কিভাবে যত্ন নেওয়া হয়। শিশু অবস্থায় মানুষের অসহায়তা এবং স্নেহের প্রয়োজন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজের প্রাথমিক স্তম্ভগুলো আমাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় স্তর: বিদ্যালয়গামী বালক

দ্বিতীয় স্তরে শিশু বিদ্যালয়ে যায়, যেখানে সে নতুন পরিবেশ এবং সামাজিক সম্পর্কের মুখোমুখি হয়। এই সময়টি একটি সংবেদনশীল সময়, যেখানে শিশুরা শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব বুঝতে শেখে। যদিও বিদ্যালয়ে যাওয়ার এই বাধ্যবাধকতা তাদের জন্য একটি বোঝা মনে হতে পারে, এটি তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এই স্তরটি জীবনের শুরুতে নিয়ম-কানুন এবং শেখার প্রয়োজনীয়তার সাথে পরিচিত হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি প্রতীক। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় তারা তাদের প্রথম বন্ধুদের তৈরি করে, যা তাদের সামাজিক সম্পর্কের বিকাশে সহায়ক। এই সম্পর্কগুলি ভবিষ্যতে তাদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক ভিত্তি তৈরি করে, যা জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তৃতীয় স্তর: প্রেমিকের আবেগ

তৃতীয় স্তরে, যুবক প্রেমে পড়ে এবং তার হৃদয়ে প্রথম প্রেমের উন্মেষ ঘটে। শেক্সপিয়ার এই স্তরকে "ফার্নেসের মতো" উত্তপ্ত ও আকুল হিসেবে চিত্রিত করেছেন। প্রেমের সময়, যুবক নতুন আবেগ অনুভব করে এবং জীবনের সৌন্দর্যকে নতুন দৃষ্টিতে দেখে।

প্রেমের এই অভিজ্ঞতা শুধু শারীরিক বা মানসিক নয়, বরং এটি জীবনের প্রতি নতুন এক ধরনের আকর্ষণের জন্ম দেয়। প্রেমিকের জীবন সৃজনশীলতা ও আবেগের চূড়ান্ত উদ্ভব ঘটায়, যা তাকে মানবিক এবং সহানুভূতিশীল করে তোলে। প্রেমের মধ্য দিয়ে যুবক শেখে, কিভাবে তাকে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয় এবং কিভাবে একটি সম্পর্ককে মূল্যবান করে তুলতে হয়।

চতুর্থ স্তর: সৈনিকের সাহস

চতুর্থ স্তরে যুবক আত্মবিশ্বাসী এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা তাকে সৈনিকের রূপে রূপান্তরিত করে। এখানে তিনি সম্মান ও সাহসিকতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত থাকে এবং নিজের মর্যাদার জন্য মৃত্যুর মুখোমুখিও দাঁড়াতে পারে। এই সময়টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়।

সৈনিক হিসেবে, যুবক অন্যদের সুরক্ষার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে এবং তার আদর্শের জন্য লড়াই করে। এই স্তরটি জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে তিনি কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত থাকে।

পঞ্চম স্তর: বিচারকের বিবেচনা

পঞ্চম স্তরে মানুষ মধ্যবয়সে পৌঁছে এবং সমাজের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে, বিচারক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। তিনি জীবনের নানা দিক নিয়ে চিন্তা করেন এবং নিজের পরিবার, বন্ধু এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করেন।

এই স্তরটি পরিণত মনের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে তিনি জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে অন্যদের সাহায্য করতে সচেষ্ট থাকেন। বিচারকের মতো, এই সময়ে মানুষ তার চারপাশের মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে এবং একটি স্বাস্থ্যকর সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

ষষ্ঠ স্তর: বৃদ্ধাবস্থা

ষষ্ঠ স্তরে, মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং তার শারীরিক শক্তি ও সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। শেক্সপিয়ার এখানে বৃদ্ধের দুর্বলতা এবং শারীরিক পরিবর্তনকে চিত্রিত করেছেন। এই সময় মানুষ তার শারীরিক শক্তি হারায়, তবে তার অভিজ্ঞতা তাকে জীবনের গভীর উপলব্ধি দেয়।

বৃদ্ধাবস্থায় এসে মানুষ জীবনের অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা অনুভব করে। তিনি প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জীবনের সব অর্জন ও সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। এটি আমাদের শেখায় যে, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আমাদের সবকিছু মেনে নিতে হয় এবং আসন্ন পরিণতির জন্য প্রস্তুত হতে হয়।

সপ্তম স্তর: দ্বিতীয় শৈশব

সপ্তম স্তরে মানুষ আবার শিশুর মতো হয়ে যায়, যা শেক্সপিয়ারের ভাষায় "দ্বিতীয় শৈশব"। এখানে মানুষ তার সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে এবং একেবারে নির্ভরশীল হয়ে যায়। জীবনের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মানুষ শূন্যতার দিকে অগ্রসর হয় এবং জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে একটি নতুন ধরনের উপলব্ধিতে পৌঁছায়।

এই স্তরটি আমাদের জীবনের একটি চক্র সম্পূর্ণ করার প্রতীক। মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়, মানুষ তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে। এটি আমাদের শেখায় যে, জীবন একটি চক্র, যেখানে শুরু ও শেষের মধ্যে একটি অদৃশ্য সেতু রয়েছে।

সমাপ্তি

শেক্সপিয়ারের "সেভেন এইজেস অফ ম্যান" কবিতাটি জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি স্তরেই আমরা একটি নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করি, যা আমাদেরকে জীবনের মহত্ত্ব উপলব্ধি করাতে সাহায্য করে। কবিতাটি আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি স্তরের অনুভূতি, দায়িত্ব এবং সম্পর্ক আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আমাদেরকে এই মহৎ যাত্রায় সঙ্গী হতে হবে। শেক্সপিয়ার এই কবিতার মাধ্যমে আমাদের জীবনের অমোঘ সত্যগুলো তুলে ধরেছেন, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এটি একটি চিরন্তন কাজ, যা মানবজীবনের অমলিন গল্পের প্রতীক।