Posts

গল্প

নারী ও সংগ্রাম: স্বপ্নের পথে এক নারীর যাত্রা"

November 5, 2024

তায়জুল ইসলাম (INNOVA JOURNAL)

Original Author হিমেল

315
View

গল্প: একজন নারীর যাত্রা

বাংলাদেশের একটি ছোট গ্রামে, যেখানে আকাশে নীলের ছোঁয়া, চারপাশে সবুজ মাঠ এবং নদীর সোঁদা মাটি, সেখানেই বাস করে এক তরুণী, যার নাম রিতু। রিতুর জন্ম একটি সাধারণ কৃষক পরিবারে। তার বাবা একজন কৃষক, আর মা গৃহকর্মী। ছোটবেলা থেকেই রিতুর কাছে গ্রামীণ জীবনযাত্রার বাস্তবতা ছিল স্পষ্ট।

শৈশব থেকেই রিতুর মনে একটি স্বপ্ন ছিল—শিক্ষিত হওয়ার। সে জানত, শিক্ষাই তার জীবনের সিঁড়ি। কিন্তু গ্রাম্য সমাজের প্রচলিত নিয়ম এবং সামাজিক বাধা তাকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল। গ্রামের বেশিরভাগ নারী এবং কিশোরী তেমন শিক্ষিত নয়, এবং রিতুর পরিবারও তেমনই ছিল। রিতুর মাকে দেখে সে উপলব্ধি করল যে, মা সারাদিন কাজ করেও শিক্ষার অভাবে কতটা সংকীর্ণ জীবন যাপন করছেন।

গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, কিন্তু সেখানে ছেলেদের জন্য আলাদা এবং মেয়েদের জন্য আলাদা শ্রেণী। রিতুর বাবা প্রথমে মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, “মেয়েদের লেখাপড়া কি দরকার? তাদের কাজ তো ঘরে।”

তবে রিতুর মনে দৃঢ় সংকল্প ছিল। সে তার বাবার কাছে তার স্বপ্নের কথা বলল। “বাবা, আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি একজন শিক্ষিকা হতে চাই। যদি আমি শিক্ষিত হতে পারি, তাহলে আমি আমাদের গ্রামের মেয়েদের জন্য কিছু করতে পারব।”

বাবা কিছুটা চিন্তিত হয়েছিলেন, তবে রিতুর আত্মবিশ্বাস দেখে তিনি কিছুটা নরম হলেন। তিনি তাকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য সম্মত হলেন, কিন্তু শর্ত দিয়ে—“শিক্ষা শেষ করে তুই যেন ঘরে ফিরে আসে।”

রিতু বিদ্যালয়ে ভর্তি হল। প্রথম দিন তার কাঁধে নতুন একটি বই ছিল, আর সে সেই বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই সে নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচিত হলো। তাদের মধ্যে সেও একজন। কিন্তু প্রথম থেকেই রিতু লক্ষ্য করল, তার সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে লেখা-পড়ায় আগ্রহী নয়, কারণ তাদের পরিবারও তেমন গুরুত্ব দেয় না।

কিন্তু রিতুর দিনগুলো কাটতে লাগলো। সে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করল এবং বইয়ের প্রতিটি পাতায় নতুন কিছু শিখতে লাগলো। সারা দিন বিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসার পরও সে পড়া করতে থাকত। তার মা তাকে সহায়তা করতেন, যদিও তিনি নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

বিকেলে, যখন গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতো, রিতু তার পড়ার টেবিলে বসে থাকতো। তার পড়াশোনার প্রতি উন্মাদনা ছিল অসাধারণ। তিনি জানতেন, শিক্ষা তাকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে।

একদিন, বিদ্যালয়ে শিক্ষক এসে বললেন, “আমাদের বিদ্যালয়ে একটি প্রতিযোগিতা হতে যাচ্ছে। সেখানে শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচন করা হবে। আমি চাই, তোমরা সবাই এতে অংশগ্রহণ করো।” রিতু সিদ্ধান্ত নিল, সে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে।

প্রতিযোগিতার দিন এল। রিতু মঞ্চে উঠলো। সে তার বক্তৃতায় গ্রামের নারীদের অধিকার, শিক্ষার গুরুত্ব এবং তাদের স্বাধীনতার কথা বললো। তার কথা শুনে দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হলো। সবাই তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেল। রিতু সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলো।

এই বিজয় তার আত্মবিশ্বাসকে আরো বৃদ্ধি করল। তিনি বুঝতে পারলেন, যে পরিবর্তনের জন্য সে লড়াই করছে, তা সত্যিই সম্ভব।

বিদ্যালয়ের পর, রিতুর শৈশবের বন্ধুরা বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়, কিন্তু রিতু হার মানেনি। সে আরো অধ্যবসায়ী হয়ে ওঠে এবং উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তবে এই সময়ে তার জীবনেও চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করল।

গ্রামের একজন যুবক, অমিত, তাকে ভালোবাসতে শুরু করল। সে জানাল, সে রিতুকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু রিতুর মনে তখন পড়াশোনার দায়িত্ব। সে অমিতকে জানিয়ে দিল, “বিয়ে করার জন্য আমি এখন প্রস্তুত নই। আমি প্রথমে আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে চাই।”

অমিত এ নিয়ে কিছুটা দুঃখিত হয়েছিল, তবে রিতুর সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করল। রিতু তার পড়াশোনা চালিয়ে গেল এবং অবশেষে উচ্চবিদ্যালয় পাশ করল।

এরপর রিতুর কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় এলো। কলেজে ঢুকে সে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচিত হলো এবং সেখানে তার নিজের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পেল। কলেজে পড়াকালীন সে নারীদের অধিকারের বিষয়ে অনেক সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করলো।

একদিন, একটি সেমিনারে এক অতিথি বক্তা এলেন, যিনি নারীদের জন্য কাজ করেন। তিনি বললেন, “শিক্ষা হল আপনার শক্তি। এটি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে। আপনাদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাদের নিজেদের জাগরूक হতে হবে।” রিতু সেই কথাগুলো শুনে নতুন করে অনুপ্রাণিত হলো।

রিতু কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। সেখানে সে নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলো। সে নারীদের জন্য কাজ করতে লাগলো এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে প্রচার চালাতে লাগলো।

একদিন, রিতু নিজেই একটি সংস্থা খুলে নারীদের জন্য শিক্ষা এবং সেবা প্রদান করতে শুরু করলো। গ্রামের অন্যান্য নারীরা তার পাশে এসে দাঁড়াল। তারা নিজেরা শিখতে শুরু করল এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে লাগলো।

রিতুর জীবনের লক্ষ্য ছিল, গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা। তার উদ্যোগ গ্রামে একটি পরিবর্তন নিয়ে এলো। নারীরা এখন নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে শিখেছে, এবং তারা তাদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে শুরু করল।

রিতুর যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। সে জানে, শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। তার সংগ্রাম এবং সফলতা কেবল তার জীবনের গল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য একটি প্রেরণা।

এভাবেই রিতু বেড়ে উঠছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এক অনন্য পরিচয়ে। তার গল্পটি কেবল তার নয়, বরং সমস্ত নারীর, যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। রিতুর জীবনের শিক্ষা হল, “স্বপ্ন দেখো, তবে সেই স্বপ্নের জন্য লড়াই করো।”

এভাবেই রিতুর গল্প সমাপ্ত হলো, যেখানে তিনি নিজের পথ দেখাচ্ছেন এবং নতুন প্রজন্মের নারীদের অনুপ্রাণিত করছেন।

Comments

    Please login to post comment. Login