‘ছায়ানীড়’ এর সামনে গাড়ি থেকে নামলাম। ছোটো ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি। অবশ্য এই ছায়ানীড় একসময় আমাদের সব ভাইবোনেরই সুখের নীড় ছিল। ছিল এই কঠিন পৃথিবীতে আমাদের এক টুকরো স্বর্গ। চার-ভাইবোনের খুনসুটি, মায়ের শাসন, বাবার আদরের ছায়াতলে কেটে গেছে শৈশব, কৈশোর আর বড়োবেলা। এই বাড়ির আঙিনা থেকে আমি ও মারিয়াম কনে সেজে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি, পরের ঘরের মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। বহমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই ছায়ানীড় এখন অন্য প্রজন্মের নীড়। আমি আর মারিয়াম এখানে মেহমান!
গেইটে বাগান বিলাসের ঝাড়, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঈষৎ হলদে রঙের তেতালা বাড়িটা। সামনে এক টুকরো বাগান, নানা রঙের ফুলের ডালি সাজিয়ে এখনও তেমনই আছে। আমাদের ছায়ানীড় বাইরে থেকে দেখতে প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেলেও ভেতরের মানুষগুলো বদলে গেছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল হৃদয়ের গভীর থেকে।
এর আগে বাপের বাড়ি আসলে মন খুব ফুরফুরে থাকতো আমার। সব ভাইবোন আর বাচ্চাকাচ্চারা একসাথে হবো এই আনন্দবোধ চাঙা করে রাখতো মনটাকে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ছায়ানীড়ে এসে আজ এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভীষণ মন খারাপ লাগছে। বিচ্ছেদ আর ভাঙনের সুর মনকে বিমর্ষ করে দিচ্ছে। কিছুই যে আর আগের মতো নেই এই বোধ আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। কিন্তু বাইরে কঠিন মূর্তি ধরে রেখেছি। রাখতেই হবে। আজকে বেড়াতে না, একটা বিষয়ে ফায়সালা করতে এসেছি। অবশ্য এটা পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। আজ সকালেই এর সূত্রপাত ঘটে।
সকালবেলাটা ভীষণ ব্যস্ততায় কাটে আমার। রোবটের গতিতে কাজগুলো শেষ না করে দম ফেলব এতটুকু সময়ই পাই না। এরইমধ্যে মোবাইলের একঘেয়ে রিংটোন বেজে চলেছিল। চকিতে দেখে নিলাম কে কল করেছে। মা! এত সকালে! কিন্তু তখন তো কথা বলার সময় নেই। ঝট করে মোবাইল সাইলেন্ট করে নিজের কাজে ডুবে যাই আমি। মায়ের কথা আর মনে থাকে না।
প্রতিদিনই ভাবি ফযরের নামাযের সময় ঘুম থেকে জাগব। নামায শেষ করে কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করব। তারপর ধীরেসুস্থে রান্নাঘরে গিয়ে সকালের নাশতার আয়োজন করব। কিন্তু আমার এই পরিকল্পনা কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, আজ পর্যন্ত কোনোদিনই বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুটো বেজে যায় প্রতিরাতেই। সকাল সাতটায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা ছাড়তে হয়। আধখোলা চোখে তড়িঘড়ি করে বাচ্চাদের জন্য নাশতা বানাই, টিফিন রেডি করি। বাচ্চাদের ডেকে তুলি, ওরা নিজেরাই রেডি হয়ে নেয়, সে সময় আমি ওদের মুখে নাশতা তুলে দিই। এরমধ্যে স্কুল বাস বাসার নিচে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বিকট শব্দে হর্ন বাজাতে থাকে। ঠিক আটটায় বাচ্চাদের সাথে পড়িমরি করে নিজেও নিচে নেমে আসি। গেইটে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাই।
বাচ্চাদের নিয়ে বাস চলে যেতেই ধীরে ধীরে বাসায় আসি। চোখ থেকে ঘুম তখনও বিদায় নেয় না। এক চুলায় চায়ের পানি অন্য চুলায় দুটো ডিম সেদ্ধ করতে দিই। এরই ফাঁকে বাথরুমে ঢুকে প্রাকৃতিক কাজ সেরে, চোখ-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুমকে একেবারে ঝেটিয়ে বিদায় করি। এরপর ডিম, টোস্ট আর চা খেতে খেতে সজীবের জন্য নাশতা রেডি করি।
গরম গরম ফুলকো রুটি ছাড়া সজীবের চলে না। টেবিলে গরম রুটির সাথে সবজি-তরকারি দিতে দিতে সজীবও অফিসের জন্য পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে যায়। ন’টার দিকে সজীব বেরিয়ে যায়। তারপর আমি একদম একা। ফযরের নামায এই সময় পড়ি। ঠিক সময়ে পড়তে না পারার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হই। কিন্তু একেবারে না পড়ার চাইতে দেরিতে হলেও পড়ে নেওয়াটা উত্তম এটা ভেবেই নামায আদায় করি। এরপরেই মায়ের সাথে কথা বলাটা নিত্য রুটিন হয়ে গেছে আমার। আজও তাই বলতাম। কিন্তু আজকে মা নিজেই কল করেছে! তাও সকাল সাড়ে সাতটায়! নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। কিন্তু সকালের ব্যস্ততায় মায়ের সেই গুরুত্বপূর্ণ কথার চিন্তা মাথায় ঢোকাতে পারিনি।
সজীব বেরিয়ে যেতেই মনে পড়ল সে কথা। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি অনেকগুলো মিসড কল। কোনো অসুবিধে হয়নি তো! নানা দুশ্চিন্তার দোলাচলে দোদুল্যমান মনকে কোনোমতে লাগাম টেনে ধরে কলব্যাক করলাম। প্রায় সাথে সাথে রিসিভ করে ওপাশ থেকে কান্নাজুড়ে দিলেন আমার ষাটোর্ধ মা শরীফা বেগম,
‘‘ওরে মুনা… এতক্ষণে কল করার সময় হইল তোর! আমি কি এতোই মূল্যহীন হয়ে গেলাম সবার কাছে! এই আমি তোদের পেটে ধরছি, কত কষ্ট করে বড়ো করছি আর এখন তোদের কাছেই আমার কোনো মূল্য নাই।’’
আমার মায়ের বেশ নাটকীয় ও কথা টেনে লম্বা করার গুণ আছে। সামান্য একটা ঘটনাকে তেল-মরিচ-মসলা মিশিয়ে দারুণ উপাদেয় করে তুলতে মায়ের জুড়ি মেলা ভার। অন্যসময় এসব আমি খুবই উপভোগ করি। আমি নিজেও অনেকটা মায়ের স্বভাব পেয়েছি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তায় মাথার ভেতর দপদপ করছে, সরাসরি ঘটনা কী তা না জানলে হচ্ছে না। তাই মাকে তাগাদা দিলাম,
‘‘কী হইছে সেটা বলো তো। এতো প্যাচাল পাইড় না।’’
‘‘এখন তো আমার কথা তোর প্যাচালই মনে হবে। ছেলে তো অনেক আগেই পর হইছে, এখন মেয়েও! আল্লাহ আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী!’’
আমি রাগ ও বিরক্তির চরম সীমায় পৌছে গেলাম,
‘‘মা, তুমি কি বলবা কী হইছে? নাকি আমি রেখে দিব?’’
মা এবার মূল ঘটনায় এলেন। আমার মা, শরীফা বেগমের দুই ছেলে দুই মেয়ে। তিনি থাকেন ছোটো ছেলে খোরশেদের বাসায়। বড়ো ছেলে জামশেদের বাসা এমনিতেই ভরপুর। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে। আলাদা রুম লাগে প্রত্যেকের। মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমার মায়ের দুই মেয়ের মধ্যে আমি মায়মুনা বড়ো। ছোটোজন মারিয়াম। সে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের সাথে নিজের দুই ছোটো বাচ্চাসহ থাকে। সারাদিন শ্বশুর বাড়ির লোকদের মাঝে মারিয়ামকে তটস্থ থাকতে হয়। নানারকম দায়িত্ব পালন করতে করতে প্রায়ই ওর নাভিশ্বাস উঠতে দেখা যায়। তখন সে কদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে। দুই একমাস পরপরই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
এতদিন আমাদের মা ছিলেন খোরশেদ মানে ছোটো ভাইয়ার বাসায়। বেশ আরামেই ছিলেন তিনি। কিন্তু এখন হঠাৎ ছোটোভাবি সাফ সাফ জানিয়ে দিল, মা যেন বড়ো ভাইয়া বা আমাদের কারো বাসায় থাকেন। সে আর আমার মাকে তার বাসায় রাখতে পারবেন না।
এ কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই আমার রাগ হলো খুব। এভাবে মাকে বাসা থেকে বের হওয়ার কথা বলতে পারল ছোটোভাবি! মায়ের কাছে সব শুনে ভাবির মোবাইলে ফোন করলাম। কিন্তু সে ফোন ধরেনি। এদিকে মা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। এত অপমান তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। এর একটা বিহিত না হলে তিনি ওই বাসা থেকে বেরিয়ে দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাবেন। আমি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম,
‘‘কোথাও যেতে হবে না। আমি আছি না? ভাবি না রাখলে আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। তুমি আগে শান্ত হও।’’ বলেছি বটে কিন্তু আমার করণীয় আসলেই কী তা নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। ছোটো ভাইয়াকে ফোন করলাম। সে সোজাসাপ্টা বলে দিল, শারমিন যা বলে তা-ই হবে। আমি বেশ আশ্চর্যান্বিত হলাম। ছোটো ভাইয়া এমন বউপাগল হলো কবে! এদিকে মা বারবার ফোন করে একই গান গেয়ে যাচ্ছেন। শেষমেশ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ছোটো ভাইয়ের বাসায় যাব। গিয়ে সরাসরি কথা বলব।
শারমিনকে অনেক দেখেশুনে ছোটো ভাইয়ার বউ করে এনেছিলাম আমরা। আমার স্কুলের জুনিয়র ছিল। আবার একই কলেজে পড়েছি। যখন ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছিল তখন শারমিনের একটা বায়োডাটা পেয়েছিলাম। তখন আমিই সবাইকে বলেছিলাম শারমিনই সবচেয়ে উপযুক্ত। বেশ ক’বছর মোটামুটি কাছ থেকে দেখেছি। সুশ্রী, সুশীলা, শিক্ষিতা। ওর মতো নম্র-ভদ্র মেয়ে সহজে দেখা যায় না। পরিবারও ভালো ওর। আমার কথাতে ভরসা হলেও মা-বাবা, ছোটো ভাইয়া সবাই অনেক যাচাই-বাছাই করেই শারমিনকে ঘরের বউ করে আনে। বিয়ের পর এতবছরেও শারমিনের কোনো দোষত্রুটি খুঁজে পাইনি আমরা। বরং বড়ো ভাইয়ের বউয়ের তুলনায় শারমিন সবার কাছে অসম্ভব প্রিয়। আমার বাচ্চারা তো ছোটোমামি বলতে অজ্ঞান। আর বড়ো ভাইয়ের ছেলে-মেয়েও ছোটোচাচির ভীষণ ভক্ত। আমাদের বাবা মারা যাওয়ার পর বড়োভাবি যখন মাকে নিজের কাছে রাখতে অস্বীকৃতি জানাল তখন শারমিন নিজ থেকেই বলেছিল, মা তার কাছে থাকবে। সেই শারমিনই এখন মাকে বাসা থেকে বের করে দিতে চায়! আমার কিছুতেই কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু মায়ের কান্নাও কি মিথ্যে? সত্যিই ছোটোভাবি মাকে আর রাখতে পারবে না বলেছে! মানুষ এতো সহজে বদলে যেতে পারে কীভাবে!
দুপুর দুইটায় আকাশ আর আইরিনের স্কুল ছুটি হয়। আমি ঠিক করলাম বাচ্চাদের স্কুলে গিয়ে ওদেরকে সাথে নিয়ে একেবারে ছোটোভাবীর বাসাতেই উঠব। সজীবকেও ফোনে জানিয়ে দিলাম সে কথা। ছোট্ট একটা ব্যাগে বাচ্চাদের জামা-কাপড় নিলাম একসেট করে। এরপর নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিলাম দ্রুত। একফাঁকে মায়ের জন্য কিছু ছিটারুটি পিঠা বানিয়ে ফেললাম। মায়ের খুব পছন্দ। গতরাতে হাঁসের মাংস ভুনা করেছিলাম। আমার শাশুড়ি পাঠিয়েছেন গ্রাম থেকে। তার নিজের পালা পাতিহাঁস। আমি হাঁসের মাংস পছন্দ করি বলে একেবারে রেডি টু কুক অবস্থায় পাঠিয়েছেন। ফোনে বলেছেন, ‘‘তুমার খুশি মতো রাইন্ধো।’’ একটা বক্সে সেগুলোও নিলাম। মা খুব খুশি হবে। ফ্রিজে গাজরের হালুয়া ছিল। আমার হাতের গাজরের হালুয়া আবার ছোটোভাবির খুব পছন্দ।
যখনই বলি, ‘‘ভাবি তোমার জন্য কী নিব?’’ ভাবি বলে, ‘‘যদি পারো একটু তোমার স্পেশাল হালুয়াটা করে এনো। আর কিছু লাগবে না।’’ আজকে হালুয়া করাই আছে। তবুও হালুয়ার বাটিটা বের করে আবার রেখে দিলাম। নাহ! ছোটোভাবির জন্য প্রতিবার কিছু না কিছু নিলেও এবার নিতে ইচ্ছে করছে না। কেমন মেয়ে! আমার মাকে বাসা থেকে বের করে দিতে চায়!
স্কুল থেকে আকাশ ও আইরিনকে নিয়ে ছোটো ভাইয়ার বাসায় পৌছাতে পৌছাতে বিকেল চারটা বেজে গেছে। ছোটো ভাইয়ার বাসা মানে আমাদের ছায়ানীড়। দোতলায় এখন বড়ো ভাইয়া থাকে। তিনতলায় ছোটো ভাইয়া। নিচতলায় আগে বসার আর খাবার ঘর ছিল। বাবা বেঁচে থাকতে সবাই একসাথে নিচেই খাওয়া-দাওয়া করা হতো। খাবার ঘরের পাশেই একটা বিশাল রান্নাঘর আর তার পাশে একটা অল্প প্রশস্ত করিডোর পেরিয়ে মোটামুটি বড়সর শোবার ঘর। এখানেই বাবা-মা থাকতেন। এখন সব ঘরগুলোতেই তালা দেওয়া। কথা চলছে এগুলো ভেঙে দুটো আলাদা ফ্ল্যাট বানিয়ে একটা আমাকে আর আরেকটা মারিয়ামকে দেওয়া হবে। কবে হবে কে জানে! আমার অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
দোতলায় এসে থামলাম। বড়ো ভাই-ভাবীকে ডাকব নাকি? না থাক, ওদের জানিয়ে লাভ নেই। বড়ো ভাইয়া এমনিতেই দায়িত্বভার নিতে চান না। নিয়ম করে অফিস করেন, আর বাসায় এসে টিভি দেখেন। ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিজের চেষ্টায় একা হাতে মানুষ করেছেন বড়োভাবি। সেখানে শাশুড়ি কই আছে, কই থাকবে এসব নিয়ে বড়ো ভাবি এক মিনিটের জন্যও মাথা ঘামায়নি কোনোদিন, এখনও এর ব্যতিক্রম হবে এমন আশা করা যায় না। তাই আর ওদের দরজায় কড়া না নেড়ে সোজা ওপরতলায় চলে গেলাম।
দরজা খুলে দিল ছোটোভাবি। বরাবরের মতোই হাসিমুখ তার। এই হাসি দেখে প্রতিবার হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলেও এবার রীতিমতো গা জ্বালা করল আমার। আমার মাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে আবার আমাকে হাসিমুখে ঘরে বরণ করেও নিচ্ছে! কতো বড়ো শয়তান মেয়ে! সে বাচ্চাদের দেখে বলল,
‘‘সোজা স্কুল থেকে এলে বুঝি! বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ওদের জামাকাপড় এনেছ মুনা? নাকি শ্রাবণ, শশীর কাপড় দিব?’’
আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। ব্যাগ থেকে আকাশ-আইরিনকে কাপড় বের করে দিলাম। ওদের ফ্রেশ হতে বলে নিজে গেলাম মায়ের রুমে। মা বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে কোনো একটা বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,
‘‘অহ তুই! এতো তাড়াতাড়ি চলে আসছিস? আমি ভাবছিলাম রাতে জামাইকে নিয়ে আসবি। জামাইসহ আসলে বেশি ভালো হইতো।’’
আমি ম্লানসুরে বললাম,
‘‘ও অফিস শেষ করে রাতে আসবে। তুমি তো দেখি আয়েশ করে বই পড়তেছ!’’
মা লাজুক হাসলেন,
‘‘মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে কবিতার বই, ‘‘কাব্যে মহানবী (সাঃ)। পড়তে খুব ভালো লাগতেছে। ছোটো বউ এনে দিছে।’’
মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, ছোটোভাবিকে নিয়ে রাগ-হতাশা, এই গরমে বাচ্চাদের স্কুল, সেখান থেকে এখানে আসা সবমিলিয়ে আমি ভীষণ ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে আছি। এখানে এসে ছোটোভাবি আর মায়ের আচরণ দেখছি একেবারে স্বাভাবিক। নিজেকে আমার ভীষণ অপদস্ত আর পাগল মনে হচ্ছে। চিৎকার করে বললাম,
‘‘এসব কী নাটক মা! সকাল থেকে ফোন করে কান্নাকাটি করছিলে। তোমাকে নাকি ছোটোভাবি বের হয়ে যেতে বলেছে। এখন দেখছি এখানে সব নরমাল। এসবের মানে কী?’’
ছোটোভাবি ট্রে হাতে রুমে ঢুকল,
‘‘মুনা নাও বেলের শরবত খাও। কী গরম পড়ছে আজকে! ঠান্ডা ঠান্ডা বেলের শরবত ভালো লাগবে।’’
‘‘রাখো তোমার বেলের শরবত। আগে বলো মাকে কি তুমি বলেছ যে এই বাসায় আর থাকতে পারবে না?’’
‘‘আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি। তুমি বোসো তো।’’
ছোটোভাবি একপ্রকার জোর করেই আমাকে বিছানায় বসালো, মায়ের পাশে। নিজেও মুখোমুখি বসল। আমার হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কীভাবে যেন গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। শীতল মিষ্টি তরলটুকু গলায় কখন যে গিয়ে পৌঁছল নিজেও বুঝতে পারলাম না। ভাবি বলা শুরু করল,
‘‘তুমি তো জানো আর কয়েক মাস পরেই শ্রাবণের জেএসসি পরীক্ষা। এখন দিনরাত করে পড়তে হবে। কিন্তু আম্মার জন্য ও পড়তে পারে না। আম্মা কিছুক্ষণ পরপর ওর রুমে যায়, এটা সেটা নানা কথা বলে ডিস্টার্ব করে। তার ওপর আম্মার হাঁটুব্যথা। শ্রাবণ যে রাত জেগে একটু পড়াশোনা করবে সেই উপায়ও নেই। আম্মার হাঁটুব্যথা রাতেই বাড়ে। সারারাত ব্যথায় চেঁচায়, আর শ্রাবণকে একবার বলে, ‘‘দিদিভাই তেল গরম করে দিলে কি ভালো লাগবে? হাঁটুর অপারেশন করলে কি ব্যথা ভালো হবে দিদিভাই?’’ আরো আবোলতাবোল কতো কথা! মেয়েটাকে আমার পড়তেই দেয় না।’’
একনাগাড়ে বলে থামল ছোটোভাবি। আর আমি তখন হতভম্ব হয়ে বসে আছি। ভাবির কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ভালো মানুষ মা’র হাঁটুব্যথা কবে থেকে? আর শ্রাবণের জেএসসি পরীক্ষা মানে! গতবছরই তো শ্রাবণ জেএসসি দিল। এখন সে ক্লাস নাইনে। ভাবি কি পাগল হয়ে গেছে! মায়ের দিকে তাকালাম। হাতের বইটা বন্ধ করে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন গম্ভীর মুখে। তখনই আমার ঝট করে মনে পড়ল দুদিন আগের কথা। আমার শাশুড়ি গ্রাম থেকে ফোন করেছিলেন। তার হাঁটুব্যথার জন্য দু’মাস আগে একজন অর্থোপেডিক দেখিয়ে ছিলাম আমরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার ঔষুধ দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন দু’মাস পর আবার দেখাতে। তো আমার শাশুড়ি ফোন করে সেটাই বলছিলেন। দু’মাস হয়ে গেছে। তিনি শহরে আসবেন। আমরা যদি আগে থেকে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি তাহলে উনার শহরে বেশিদিন থাকতে হবে না। এসে ডাক্তার দেখিয়েই চলে যেতে পারবেন। আমি তখন বলেছিলাম,
‘‘দুইমাস কখন হইল আম্মা? এইদিন না আপনি ডাক্তার দেখায়ে গেলেন? এরইমধ্যে দুইমাস ক্যামনে হয়!’’
ওদিক থেকে আমার শাশুড়ি অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলেন,
‘‘দুইমাস হয়ে গ্যাছে তো। তুমি ব্যস্ত মানুষ তাই হয়তো দিন তারিখের হিসাব রাখতে পারো না।’’
আমি ঝটপট বলেছিলাম,
‘‘দুইমাস হলে হইছে আম্মা। আপনি এখন আসিয়েন না। আমার আকাশের জেএসসি সামনে। আপনার আবার হাঁটুর ব্যথায় রাতে ঘুম হয় না। আকাশের পড়ার ডিস্টার্ব হবে। ওর রাতজেগে পড়তে হয়। নিজে তো ঘুমাবেন না, ওকেও পড়তে দিবেন না। কতক্ষণ পরপর বলবেন, ‘দাদুভাই তেল গরম করে দিলে কি ভালো লাগবে? হাঁটুর অপারেশনটা করে ফেললে কি ব্যথা ভালো হবে দাদুভাই? আরো কত গল্প জুড়ে দিবেন তার ঠিক নাই। এখনই আসতে হবে না আপনার। ঠিক দুইমাস পরেই আসতে হবে এমন কোনো কথা নাই তো। ডাক্তার যে ঔষুধগুলা দিছে সেগুলাই চালায় যান। পরেরটা পরে দেখা যাবে।’’
আমার শাশুড়ি ক্ষীণস্বরে শুধু ‘আচ্ছা’ বলে রেখে দিলেন। সেই ঘটনা মনে পড়তেই আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম,
‘‘ও আচ্ছা! বুঝছি, আমার শাশুড়ি তোমাকে ফোন করে আমার নামে বদনাম করছে, না? একেবারে কোনো কিছুই বাদ রাখে নাই দেখি।’’
মা রাগীস্বরে বললেন,
‘‘বদনাম বলে কাকে জানো? মিথ্যা কথাকে। কিন্তু তোমার শাশুড়ি তো মিথ্যা বলে নাই। বলো মায়মুনা? মিথ্যা বলছে কিছু?’’
মা আমাদের ওপর রাগ করলে আমাদের পুরো নাম ধরে আর ‘তুমি’ করে সম্বোধন করেন। আমি চুপ করে রইলাম। মা নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন,
‘‘আর তোমার শাশুড়ি আমাকে নিজে থেকে কিছু বলেন নাই। আমিই ফোন করছিলাম। কারণ দুইমাস আগে উনি ডাক্তার দেখাইছিলেন সে কথা আমার মনে আছে। দুইমাস হয়ে গেছে, কখন আসতেছেন সেটা জানার জন্য আমি ফোন করছিলাম। তখন বলছেন যে উনি আসবেন না। অনেক চাপাচাপি করে জানতে পারলাম আমার গুণধর কন্যাই তাকে আসতে মানা করে দিছে। জানিস, তোকে মেয়ে বলতে লজ্জা লাগতেছে আমার।’’
আমি এবার ফুঁসে উঠলাম,
‘‘তো আমি ভুল কী করছি? আকাশের পরীক্ষার কথা আমি না ভাবলে কে ভাববে? উনি বাসায় থাকলে ওদের পড়ালেখার খুব ডিস্টার্ব হয়।’’
মা এবার শান্তস্বরে বললেন,
‘‘আকাশের পরীক্ষাটা তো অযুহাত। তুই তো চাস না তোর শাশুড়ি তোর বাসায় আসুক, থাকুক।’’
আমি চুপ করে রইলাম। স্বীকার করতে না চাইলেও কথাটা সত্যি। মা এভাবে ধরে ফেলবে বুঝতে পারিনি। আমি কিছু না বললেও মা বলে চললেন,
‘‘দেখ, তোর মাকে তোর ভাবী বাসায় রাখতে চাচ্ছে না শুনে যেভাবে দৌড়ে চলে আসলি! ভাবিকে নিষ্ঠুর ভাবতেছিস আরো কত কী ভাবতেছিস কে জানে। কিন্তু তুই নিজের কথা ভাবছিস কখনো? আচ্ছা তোর মা-ই শুধু মা? অন্যদের মা কি মা না? আমি তোদের পেটে ধরেছি, জন্ম দিয়েছি, কষ্ট করে এতো বড়ো করেছি? সজীব, তোর জামাই, তোর বাচ্চাদের বাপ সেকি আসমান থেকে টুপ করে পড়ছে? নাকি বানের জলে ভেসে আসছে? তাকে কেউ কষ্ট করে বড়ো করে নাই, বাতাসে বাতাসে বড়ো হয়ে গেছে? আমার তো তাও আল্লাহর রহমতে চারটা ছেলে-মেয়ে। তোর শাশুড়ির তো ওই একটাই ছেলে সজীব। বিয়ের দশ বছর পর হইছে, আবার সজীবের ম্যাট্রিকের বছর বেয়াই সাহেব মারা গেলেন। বেয়াইন একাহাতে সজীবকে মানুষ করছেন। কতো ত্যাগ স্বীকার করছেন। এসব কোনোদিন চিন্তা করে দেখছিস?’’
মায়ের এসব কথার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। তবুও আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলাম,
‘‘আমি তো উনাকে আমার কাছে রাখতে চাই। উনিই গ্রাম ছেড়ে আসতে চান না। শহরে উনার ভালো লাগে না। তাছাড়া উনি চলে আসলে বাড়িঘর দেখবে কে?’’
মা বললেন,
‘‘তুইও জানিস, আমিও জানি, তোর শাশুড়িও জানে বাড়িঘর দেখার বিশ্বস্ত লোক আছে। তোর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েই তোর শাশুড়ি তোর বাসায় আসতে চান না। যখন আসেন, কাজে আসেন, আবার কাজ সেরেই চলে যান। তুই আমার চোখের দিকে তাকায়ে বলতে পারবি তুই কোনোদিন তোর শাশুড়িকে বলছিস তোদের সাথে এসে থাকতে?’’
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। কথা সত্য, আমি কখনও আমার শাশুড়িকে জোর দিয়ে বলিনি আমাদের সাথে এসে থাকতে। কী করব, আমার শাশুড়ির সাথে আমার এডজাস্ট হয় না। তিনি যখন বলেছিলেন, গ্রামেই উনার ভালো লাগে আমিও তাই কখনও জোর করিনি। কিন্তু সেসব তো আগের কথা। এখন আকাশের পরীক্ষা। এসময় তিনি আসলে আকাশের সত্যিই পড়ার ডিস্টার্ব হবে। আমার মনের কথা মা বুঝতে পারল কিনা কে জানে। বলল,
‘‘দুই-চারদিনে পড়ার কী এমন ক্ষতি হবে? সারাবছর তোর ছেলে কী পড়ে নাই? আর এইযে আজকে ওদের এখানে নিয়ে আসলি, পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? প্রায়ই তোরা এখানে সেখানে বেড়াতে যাস তখন ক্ষতি হয় না? আমিও তো তোর বাসায় গিয়ে থেকে আসি। তখনও কি তোর একই রকম মনে হয়? আমার জন্য তোর বাচ্চাদের পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে?’’
আমি কী বলব! মুখ তুলে মার দিকে তাকালাম। মা একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তার চোখে চোখ রাখার সাহস আমার নেই। চোখ নামিয়ে নিলাম।
একটু চুপ থেকে মা বলল,
‘‘আমার মনে হয় বেয়াইন সাহেব বুঝবেন। তুই যেমন ভয় পাচ্ছিস আকাশের পড়ার অসুবিধা হবে, আসলে তেমন কিছুই হবে না। আজকেই ফোন করে উনাকে আসতে বল। আর শোন, তোর শাশুড়িকে একেবারে তোদের কাছে নিয়ে আয়। তোদের বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি বুঝি, একাকীত্ব কারে বলে? এর যন্ত্রণা আমি বুঝি। কিন্তু আমার তো তোরা আছিস। আলহামদুলিল্লাহ! এতগুলা নাতি-নাতনী আমার। সবাই আমারে ঘিরে থাকে। জামশেদের ছেলে-মেয়ে এতো বড়ো হইছে, তারপরও দিনরাত আমার খোঁজ-খবর নেয়। বড়ো বউ সাথে রাখতে চায় নাই, কিন্তু ছেলেমেয়েদের ঠিকই শিক্ষা দিছে, দাদীর জন্য দরদ আছে ওদের। অথচ তুই তোর বাচ্চা দুইটারে দাদীর কাছ থেকেও দূরে রাখছিস। আল্লাহ রে ভয় কর মুনা। বেয়াইন একা কী যে কষ্ট আছেন মুখ ফুটে কাউরে বলেন না। কিন্তু আমি নিজে মা বলে, একসময় কারো স্ত্রী ছিলাম বলে, আর এখন দাদী-নানী হইছি বলে আমি বুঝতেছি কিছুটা। তুই উনারে তোর কাছে আইনা রাখ। সারাজীবন কষ্ট পাইছেন আমার বেয়াইন, তুই অন্তত এই বয়সে উনারে সুখ দে। আল্লাহর কাছে তো পাবিই। সজীবেরও ভালো লাগবে। সে তোর আরো বেশি খেয়াল রাখবে। তোরে আরো বেশি ভালোবাসবে। আর তোর ছেলেমেয়েরাও তোরে দেখে তোর কাছ থেকেই শিখতেছে সব। সেইটাও মনে রাখিস।’’
মা থামল এবার। অনেক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না আর। আমি উঠে গেলাম। এই বাসায় আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। থাকার কোনো মানেও হয় না। আকাশ-আইরিনকে ওদের বাবা এসে নিয়ে যাবে। আমি একাই বের হবো ভাবছি। কিছুক্ষণ আমার একা থাকা দরকার। নিজের সাথে বোঝাপড়া করা দরকার
বের হওয়ার সময় ছোটো ভাবি আমার হাত ধরে বলল,
‘‘মুনা প্লিজ আজকের ঘটনার জন্য আমাদের ওপর রাগ করো না। আমি আর আম্মা শুধু তোমাকে একটা জিনিসই বোঝাতে চেয়েছি, আমরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসলেও, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকলেও আমরা সবাই মেয়ে। আমাদের অনুভূতিগুলো কিন্তু একই। তুমি তোমার শাশুড়ির জায়গায় নিজেকে ভেবে দেখ। তোমার আইরিনের বিয়ে হয়ে গেছে, নিজের সংসারে ব্যস্ত সে। আর আকাশ নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে তোমার ঠাঁই হচ্ছে না। সজীবও আর পাশে নেই। বৃদ্ধবয়সে তুমি একদম একা। কেমন লাগবে তোমার?’’
এসব কী বলছে ভাবি! ভাবতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। শরীরটা ভীষণ ভারী আর মাথাটা কেমন হালকা লাগছে, টলোমলো পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। নিজেকে খুব রিক্ত, নিঃস্ব ও পরাজিত মনে হচ্ছে। এই ছায়ানীড়ে ছোটো থেকে বড়ো হতে হতে মা আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছেন। কিন্তু সেই শিক্ষাটা যেন আজকেই পরিপূর্ণ হলো। মা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে আমি কেমন। নীতি-নৈতিকতার মুখোশধারী একটা ভণ্ড মহিলা আমি!
এই বাসায় আজ যা ঘটেছে তা আমার জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে। মা আর ছোটোভাবি যেন আমার মুখের সামনে আয়না তুলে ধরেছে। তাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছি। নিজেকে খুবই উদারমনা আর ‘পজিটিভ থিংকার’ ভাবতাম। অথচ আজ যেন নতুন করেই নিজেকে চিনতে পারলাম। অনেক ভুল করেছি কিন্তু আর না। কাল আমি নিজে গিয়ে আম্মাকে আমার কাছে নিয়ে আসব, চিরদিনের জন্য।
গল্পঃ আয়না
লেখাঃ সালসাবিলা নকি
রচনাকালঃ ১৭ জুন ২০২২