‘মাস ছয় আগের কথা, আমার রুমমেট মেস ছেড়ে দিয়েছিল। নতুন রুমমেট আসেনি তখনও। একদিন সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলাম, হঠাৎ ওপর থেকে আমার পাশেই টুপ করে কিছু একটা পড়ল। ভেবেছিলাম টিকটিকি হয়তো। তাকিয়ে দেখি ওটা অন্যকিছু। টিকটিকি না, খুব ছোটো এক ইঞ্চির মতো লালচে একটা বস্তু। জিনিসটা কী! আমি ভালোভাবে দেখতে গিয়েই ধাক্কা খেলাম। ওটা ছোটো থেকে বড়ো হচ্ছে, এক ইঞ্চি থেকে দু ইঞ্চি, পাঁচ ইঞ্চি, সাত ইঞ্চি... ক্রমেই ওটা ফুলে উঠছিল। জিনিসটার পেটের ভেতর থেকে ছোটো ছোটো চারটা হাত-পা বেরিয়ে এল হঠাৎ করেই। ঠিক মানুষের মতোই, মুখ-চোখ-কান-নাক-ঠোঁট সব আমার চোখের সামনেই তৈরি হচ্ছিল যেন। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়া শুরু করল। সবশেষে ওটা একটা নবজাতকের রুপ ধারণ করল, আম্বিলিক্যাল কর্ডও ছিল ওটার। সারা গায়ে রক্ত লেগেছিল যেন ঠিক তখনই ভুমিষ্ট হয়েছে। হঠাৎই ওটা তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল আর আমিও বিকট আর্তনাদ করে জ্ঞান হারালাম।
পরে শুনেছিলাম আমার চিৎকার শুনেই অন্যান্য রুমের সবাই ছুটে এসেছিল। ভেতর থেকে বন্ধ ছিল বলে মেসের সুপারভাইজারকে ডেকে রুমের দরজা ভাঙতে হয়েছিল। ভেতরে ঢুকে আমাকে ওরা অজ্ঞান অবস্থায় পায়, পরে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
সামান্য বিরতি নিয়ে নিশি আবারও বলা শুরু করল। ডাঃ রউফ মনোযোগ সহকারে শুনছেন।
'ঘটনাটার পর আমি চার-পাঁচদিন বাড়িতেই ছিলাম। হালকা শারীরিক দুর্বলতা ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না। তাই আবারো মেসে ফিরে যাই। গিয়ে দেখি নতুন রুমমেট এসেছে। টুম্পা নাম ওর। বেশ মিশুক আর বাচাল। সারাদিন হৈ-চৈ করে কাটানো ওর স্বভাব। আমি তো দেখতে ভালো না। তাই আমার সাথে কেউই খুব একটা মেশে না। কিন্তু টুম্পার সাথে কীভাবে যেন আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। দিনগুলো ভালোই কাটছিল। ও মেসে আসার পর তেমন কিছুই আর ঘটেনি। আমিও ঘটনাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
এরপর একরাতে টুম্পা জানায় রাতে মেসে ফিরবে না, বান্ধবীর বিয়ে ছিল নাকি। সাতটা বা সাড়ে সাতটা হবে তখন, হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। খুব তীক্ষ্ম সে আওয়াজ। সহ্যই করতে পারছিলাম না। আমাদের মেসটা আবাসিক এলাকায়। ধরে নিয়েছিলাম আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাটের বাচ্চা হবে। কিন্তু কেউই বাচ্চাটার কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল না। সময় যত গড়াচ্ছে কান্নাও সমান তালে বাড়ছিল। বিরক্ত হয়ে পাশের রুমে গিয়ে ঝুমাকে বললাম, ‘দেখেছ বাচ্চাটা কীভাবে কাঁদছে অথচ কেউ থামাচ্ছেই না। অসুস্থ হয়ে যাবে তো।’ ঝুমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘কী বলছেন আপু? কার কান্না? আর কোন বাচ্চার কথা বলছেন?’
বেশ বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। মনে হলো, ঝুমা আমার সাথে ফাজলামো করছে। ঝুমা আর ওই বাচ্চাটার ফ্যামিলিকে কিছুক্ষণ গালমন্দ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। অফিসের কাজ ছিল কিছু, মনোযোগ সেদিকে দিলাম। একসময় কান্নার আওয়াজের কথা ভুলে গেলাম। এরপর রাতেও আর শুনিনি।
সকালে টুম্পার ডাকেই ঘুম ভাঙে। ও ফিরে এসেই আবার সেই হৈ হুল্লোড় শুরু করল। বিয়ের গল্প শোনাল। মাথাটা খুব ভার ভার লাগছিল আমার। টুম্পার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে আমি গোসলে যাই। ভেবেছিলাম গোসল করলে ফ্রেশ লাগবে। অথচ বাথরুমে ঢুকেই দেখলাম একবিঘত সমান লম্বা একটা বাচ্চা, নাড়ী পেচানো অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। চোখমুখ ফোটেনি, হাতপাও আছে নাকি নেই বোঝা যায় না। সাথে সাথে গা গুলিয়ে বমি আসে আমার। বমি করতে করতে দেখলাম ওই একরত্তি শরীরটা নিজেই বুকের ওপর ভর দিয়ে পানি যাওয়ার ড্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রেনের ঢাকনাটা ভেঙে গিয়েছিল অনেক আগেই। খোলাই ছিল সেটা। বাচ্চাটা সেদিকে গিয়ে টুপ করে পড়ে গেল।
কীভাবে যে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলাম মনে নেই। এরপর যথারীতি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো রোগ ধরা পড়েনি, এজন্য একদিন পরই বাসায় নিয়ে এসেছে।
আমার সাথে কী হয়েছিল জানতে চাইল সবাই। সেদিন যা দেখেছি তা কি সত্যি! এমন কি হয় আসলে! ভয়ে বা লজ্জাতেই হোক কাউকে কিছু বলতে পারিনি। মনের ওপর চাপ পড়বে ভেবে আমাকে আর জোরও করেনি কেউ। ঐ ঘটনার পর আমি আর মেসে ফিরিনি, বাসাতেই থাকি। তবে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেও আমি বের করতে পারিনি, আমার সাথে ঠিক কী হচ্ছে আর কেনইবা হচ্ছে। দু’দিন বেশ ভালো ছিলাম। এরপর আবার সেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। রাতে ঘুমের মধ্যেই শব্দটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে, একসময় এতো তীব্র হয় যে ঘুম ভেঙে যায়। মনে হচ্ছিল কান্নার শব্দটা আমার বারান্দা থেকে আসছে। মাকে ডেকেছি অনেকবার কিন্তু মা আসেনি। পরে আমি নিজেই উঠে বারান্দায় যাই। রাতের নিকষ কালো অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখতে পেয়েছিলাম, একটা ছোট্ট বাচ্চা আমার বারান্দার সামনে যে নারকেল গাছটা ছিলো ওটা বেয়ে তরতর করে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর অনবরত কাঁদছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ। হঠাৎ বাচ্চাটা আমার দিকে তাকাল, ওর চোখের শূন্য কোটর দেখে প্রচণ্ড ভয়ে আমি চিৎকার শুরু করি। এরপর কখন যে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি মায়ের কোলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। উঠে বসতেই মা আমাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আমার, কেন এমন বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর… এইতো আজ মাকে নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি।
সব শুনে ডাঃ রউফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর জিজ্ঞেস করেন,
‘ছয়মাস হচ্ছে আপনার সমস্যাটার তাই না?’
‘হুম্ম’
‘‘এর আগে আপনার সাথে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছিল? আইমিন আপনার কারো সাথে সম্পর্ক ছিল, ব্রেকাপ হয়ে গেছে এমন কিছু?’’
নিশি সজোরে মাথা নাড়ে,
‘না না, এমন কোনো ঘটনাই নেই। আমাকে তো দেখছেনই। চেহারা খারাপ বলে আমার কখনও কোনো রিলেশনশীপ ছিল না।’
ডাঃ রউফ মনে মনে বলেন, ‘ছিল না বললেই তো হচ্ছে না।’ মুখে বললেন,
‘আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আপনার মায়ের সাথে একা একটু কথা বলতে চাই।’
নিশি বেরিয়ে গেলে ডাঃ রউফ কোনো ভনিতা ছাড়াই শুরু করলেন,
‘দেখুন মেয়েকে সুস্থ করতে চাইলে আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার মেয়ের হিস্ট্রি শুনে আমার ধারণা ওর একটা সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কে সে কনসিভ করে। আর তার বয়ফ্রেন্ড সেটা মেনে নেয়নি। তাকে এবোরশনের জন্য বাধ্য করে। এতে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। যার কারণে এখন তার বারবার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।’
নিশির মা রাবেয়া সুলতানা মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে শুরু করেন। ডাঃ রউফ সাথে সাথেই বললেন,
‘দেখুন আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না। শক্ত থাকতে হবে। কিছু দরকারি টেস্ট দিচ্ছি। এই টেস্টগুলোর রিপোর্ট পেলে আমরা নিশিকে সত্যের মুখোমুখি করব। মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে আঘাত পাওয়ার কারণে ওর এবোরশনের ঘটনাটা মনে নেই। ওকে সুস্থ করে তুলতে হলে ওকে ওর তিক্তকর অভিজ্ঞতাগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিতে হবে। সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে ওকে।’
রাবেয়া সুলতানা নিশিকে নিয়ে ডাঃ রউফের চেম্বারে আসলেন তিনদিন পর। তাকে দেখে ডাঃ রউফ বেশ অবাক হলেন। তিনি ভেবেছিলেন রিপোর্ট পেয়ে মহিলা আরও ভেঙে পড়বেন। অথচ রাবেয়া সুলতানার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি আজ অনেকটাই নির্ভার। রিপোর্ট দেখেই অবশ্য কারণটা পরিস্কার হলো। নিশির এবোরশন করা দূরে থাক, কখনও শারীরিক সম্পর্কই হয়নি। মেয়েটা ভার্জিন! কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনি হতভম্ভ হয়েছিলেন। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হলেন।
অবশ্য নিশি একেবারেই ভাবলেশহীন। মুখটা ফ্যাকাশে আর চোখদুটো যেন গর্তে ঢুকে গেছে। এ কয়দিনের দুশ্চিন্তায় যেন শরীর আরো ভেঙে গেছে ওর।
রাবেয়া জিজ্ঞেস করলেন,
‘এখন?’
ডাঃ রউফ বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
‘ওর সব ঘটনা শুনে মনে হলো, যখন ও একা থাকে তখনই সমস্যাগুলো হয়। সমস্যাগুলোর বর্ণনা শুনে যে কারোরই প্রথম মনে আসবে, প্রেমে বিচ্ছেদ আর গর্ভপাতের সম্ভাবনা। এটা যখন মিলল না এখন আমি বাকি সম্ভাব্য ওয়েগুলো নিয়ে এগোবো। এরমধ্যে আপনি মেয়েকে একদমই একা রাখবেন না, সম্ভব হলে ওর সাথে বেশি বেশি গল্প করুন। ওকে ব্যস্ত রাখুন। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’
ডাঃ রউফ নিশি আর রাবেয়া সুলতানাকে বিদায় দিলেন। এরপরই কাজে নেমে পড়লেন। এই ধরণের কেইস তিনি আগেও পেয়েছেন। তার শতভাগ ধারণা ছিল নিশি হয়তো এবোরশন করিয়েছে যার কারণে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে, বারবার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু নিশির এমন কোনো হিস্ট্রি নেই। ডাঃ রউফের মধ্যে এক ধরণের জেদ কাজ করতে শুরু করল। কেন নিশির সাথে এমন হচ্ছে সেটা তিনি বের করবেনই। তিনি নিশির সব আত্মীয়দের সাথে কথা বললেন। মেসমেট, মেসের সুপারভাইজার কেউই বাদ যায়নি। এরমধ্যে নিশির আরও কিছু মেডিকেল টেস্ট করা হলো।
অবশেষে দিন পনেরো পর নিশির মাকে ফোন করে আসতে বললেন তিনি। রাবেয়া সুলতানা এলে তিনি হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করেন,
‘কেমন আছেন? নিশি কেমন আছে?’
‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।’
‘এরমধ্যে সমস্যাটা আর হয়েছিল।’
‘জি না। আপনার কথামতো আমি সারাক্ষণই ওর পাশেপাশে ছিলাম। আমার ছোটোমেয়েকে ডেকে এনেছিলাম বাসার রান্নাবান্না আর সব তদারকির জন্য।’
‘খুবই ভাল করেছেন। এবার তাহলে আপনাকে ওর সমস্যা খুলে বলি। যদিও আপনারা আর বাকি সাধারণ মানুষ মনে করবে এখানে জ্বিন-ভূতের সমস্যা আছে। কিন্তু আসল কথা এসব কিছুই না, সমস্যা নিশির শরীরে।’
‘মানে!’
‘আপনারা শুধু নিশির সমস্যাটাই বলেছেন আরও অনেককিছু বলেননি। আমাকেই সব তথ্য জোগাড় করে নিতে হলো। নিশির বয়স আটাশ। এখনও ওর বিয়ে হয়নি। কিন্তু ওরই ছোটবোন বিয়ে করে দুই সন্তানের জননী। এসব কিছুই তো আমাকে বলেননি।’
রাবেয়া সুলতানা গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘আমাদের পারিবারিক বিষয় আপনাকে কেন জানাব? আর এসবের সাথে নিশির সমস্যার কী সম্পর্ক?’
‘বলছি। আপনাদের প্রতিবেশী, ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন, নিশির মেসের লোকজন, সবার সাথে কথা বলেছি আমি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যেটা মেসে নিশির রুমে পেয়েছি, ওর ব্যক্তিগত ডায়রি। লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে আরও তিন-চার বছর আগে। যতটুকু লিখেছে সবটাই ছিল আত্মগ্লানিতে ভরা। সে নিজেকে সবচেয়ে কুৎসিত আর কদর্য মনে করে। মনে করেন আপনারাও। তার ছোটোবোন যে খুবই সুন্দরী, তার বিয়ে, ফুটফুটে দুটো বাচ্চা তাকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। প্রচণ্ড হীনম্মন্যতার কারণে সে কারো সাথে মিশতো না, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলতো। বিয়ে হচ্ছে না কেন, বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মোটা হয়ে যাচ্ছে এসব কথায় তাকে আঘাত করা হতো। তার কোনো প্রেমিক ছিল না, কোনো বন্ধুও ছিল না। সবমিলে সে ছিল ভীষণ অসুখী আর একা একটা মানুষ।’
একটু থেমে ডাঃ রউফ আবার শুরু করেন,
‘দেখুন মিসেস সুলতানা, আপনাদের মেয়ে কিন্তু মোটেও অসুন্দর না। শুধু কালো বলে মেয়েকে আপনারাও সারাজীবন ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন। ছোটোবেলায় যখন তার খেলাধুলা আর বন্ধুত্ব করার বয়স ছিল সে সময় আপনারা তাকে ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন। বাইরের রোদ লাগলে সে আরও কালো হয়ে যাবে এই ভয়টা দেখিয়ে রোদে যেতে দিতেন না। ঘরে থেকে থেকে মুখে এই সেই মেখে তার রঙ একটুও খোলেনি বরং তার শরীরে ভিটামিন ডি এর প্রচুর ঘাটতি হয়ে গেছে। আমি নিশির হাঁটা খেয়াল করেছি। সামান্য খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। অথচ তার পায়ে মেজর কোনো সমস্যা নেই। নিশিকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, বেশ কয়েক বছর ধরে সে পায়ে হালকা অসাড়তা অনুভব করছে। রাত হলে পায়ে ব্যথা বাড়ে। আপনাদেরও অনেকবার বলেছে। আপনারা পাত্তা দেননি, উল্টো বলেছেন ওজন কমাতে। মেয়েটা এমনিতেই নিজেকে অসুন্দরী ভাবে, সেখানে হালকা স্বাস্থ্য থাকায় আপনার তাকে মোটা বলেন। তার মানসিক অবস্থাটা কোথায় গেছে বুঝতে পারছেন?’
রাবেয়া সুলতানা চোখ নামিয়ে রাখেন। ডাঃ রউফ বলতে থাকেন,
‘লাস্ট যে টেস্টগুলো দিয়েছি সেখানে ভিটামিন ডি ডেফিসিয়েন্সি এসেছে অর্থাৎ নিশির শরীরে ভিটামিন ডি খুবই কম। কিছু হরমোনাল প্রবলেমও আছে। এসবের কারণে ওর মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়েছে। ভিটামিন ডি এর অতিরিক্ত অভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, বিষন্নতা গ্রাস করে। হাড়ের সমস্যা তো আছেই। ওজনও বাড়ে। জেনে অবাক হবেন, আপনার মেয়ে যে গল্পগুলো বলেছে সবই তার নিজের বানানো। ইচ্ছা করে বানিয়েছে এমন না, তার মনে হচ্ছিল এসব ঘটনা ঘটছে। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি। সবই তার কল্পনাপ্রসূত, ভ্রম। প্রথমবার অসুস্থ হওয়ার পর দেখল, সে গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই এমন ঘটনা পরে আরও কয়েকবার ঘটল। আর এসব কিছুর পেছনে দায়ী কিন্তু আপনারাই।’
‘আমরা!’
‘হ্যাঁ। ভালো করে ভেবে দেখুন। জন্মের পর থেকে তাকে কতটা অবহেলা করে এসেছেন। এখন যদি তাকে সুস্থ করে তুলতে চান, মেইক হার ফিল স্পেশাল। যেভাবে পারেন। একটা ভালো মানুষ দেখে বিয়ে দিন, যে তাকে মানসিকভাবে শান্তিতে রাখবে। আমি আপাতত ভিটামিন ডি এর কিছু সাপলিমেন্ট দিচ্ছি। প্রতিদিন সকালে-বিকালে ওকে নিয়ে রোদে বসবেন। নিশির মন
অ্যাটেনশান চায়। তাকে অ্যাটেনশান দিন। এইসব বাচ্চার কান্নাটান্না সে আর শুনবে না। আর হ্যাঁ নিশিকে পারলে এটা বোঝান ওর অসুখের পেছনের গল্পটা ভূতের নয়, ভুলের। আর ভুলটা আপনাদেরই।’
রাবেয়া সুলতানা চুপচাপ মাথা নিচু করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন। ছলছল চোখ নিয়ে মনে মনে ভাবলেন, ডাবল চিজ বার্গার খেতে পছন্দ করে নিশি, কতদিন খায় না! আজ বাসায় যাওয়ার সময় কিনে নিতে হবে।
(রহস্যলীনা ৩ এ প্রকাশিত)