আজ দিদি বেঁচে নাই। কিন্তু তাঁর কথা বেশ মনে আছে। আমি তখন খুব ছোট। আর দিদি তখন বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে হাঁটেন। হেটে হেটে এবাড়ি ওবাড়ি যান। একটা বেত হাতে নিয়ে বাচ্চাদের পড়ান, শাসন করেন। দিদির নিজেদের বেশ বড় একটা বাড়ি। আমরা অবশ্য দিদির বাড়িতে গিয়ে পড়তাম। ঢালাওভাবে পেতে রাখা মাদুরে বসে। ফেরার সময় গাছের ফলমূলও সাবাড় করতাম। বাড়িতে গিয়ে পড়লে পয়সা দিলে ভালো, কেউ না দিলে দিন কয়েক বলে ক্ষান্ত হয়ে যান তিনি। এক অর্থে সেই দিদি আমার মত অনেকেরই প্রথম প্রাইভেট টিচার। ততদিনে দিদির ছেলে ডাক্তারি পড়তে ভা*রতে গিয়ে বিয়ে শাদি করে সেখানে থিতু হয়েছেন। বাবা মায়ের খোঁজ তেমন একটা নেন না। কোন কোনদিন পড়াতে পড়াতে সম্ভবত সেই চিন্তা মাথায় আসলে আলভোলার মত আচরণ করতেন। ছেলে বেঁচে থেকেও ছিলেন না। দিদির ভিতরে কি চলত, তখন না বুঝলেও এখন অনুমান করতে পারি। ক্লাস ফোরে ওঠলে দিদির বদলে মেয়ে মানে আমাদের পিসির কাছে পড়তে শুরু করি। দিদি কিংবা পিসি দুজনই আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন।
বিভা রানী দাস আপা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় টিচার। তিনি আমাদের অংক শেখাতেন। ক্লাসে বেশ চটপটে উত্তর দিতে পারতাম। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষায় গিয়ে ঠিকই ৩য় হতাম। একদিন বিভা আপা ডেকে বললেন, তোকে ফার্স্ট হতে হবে। আপার কথাটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিলো। ফাইভের পরীক্ষায় ঠিক ফার্স্ট হয়ে যাই। যখন কলেজে ভার্সিটিতে পড়ি, পরিচিতদের কাছ থেকে বিভা আপা প্রায়শই খোঁজখবর নিতেন। বিভা আপা দেখতে যেমন সুন্দর, মানুষ হিসেবেও অনন্য।
প্রাইমারি ও হাইস্কুল জীবনে বলতে গেলে মেয়েদের সাথে কথাই বলতাম না। সেই সময়টা কিংবা আমরা নিজেরা ছিলাম লাজুক লতার মত। লাজ লজ্জা এত বেশি ছিল যে, অল্পতেই চুপসে যেতাম। অথচ সেই প্রাইমারিতেই ক্লাসমেট যূথী ও বীথির নামের দুই বোনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমি ওদের বাড়িতে যেতাম, ওরাও আসতো। ওরা দুইবোন বলতে গেলে আমার প্রথম মেয়ে-বন্ধু। বহু বছর পর বীথির সাথে দেখা হয় ব্যাচের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। এরপর কয়দিন আগে হঠাৎ দেখা, দুজনই মসলা কেনার জন্য একই মুদির দোকানে দাঁড়িয়েছি যখন।
গৌতম দার একটা কথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। একদিন সন্ধ্যার কথা। তখন তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। কলম দিয়ে হাতের তালুতে নিজের নাম লিখে জিজ্ঞেস করেন, ‘গ’ অক্ষরটা সোজা লিখলো নাকি উল্টা। এতবড় ছেলে নিজের নাম লিখতে গিয়ে ধন্ধে পড়লে কার না হাসি পায়! গৌতমদার ছোটভাই মানিক ছিল আমার সমবয়সী। ওদের বাড়ির সাথের পুকুরের উপরে একটা ডুমুরের গাছ ছিল। ছিল আরও অনেক গাছ। বেলায় অবেলায় বসে বসে আজাইড়া গল্প চলত। ফুটবল খেলতাম, গাদন খেলতাম, সন্ধ্যায় লুকোচুরি।ওরা বাদেও আমাদের প্রতিবেশী ছিল তাপসদা’রা। মানুষ হিসেবে তাপসদা ভীষণ ভালো।
সেই প্রাইমারি থেকে পরিচয়, এখনও শুভ্র, শুভাশিস, পার্থ, সত্যজিৎ, নিখিলেশ, কাজল ওরা আমার বন্ধু। এখনও আগের মতই আমরা পূজাতে যাই, নাড়ু খাই, ঈদের দিনে এক সাথে খাই দাই, আড্ডা দেই। ভার্সিটি লাইফেও এমন হরিহর আত্মার বন্ধু ছিল, জুয়েল মহাজন, রাজিব, মানস, বিশ্বজিৎ, এমন কতজনের কথা বলবো?
চাকরি করতে গিয়েও কম মানুষের সাথে পরিচয় হয়নি! প্রাইভেট চাকরিতে হয়েছে। বর্তমান চাকরিতে নিজেদের কলিগ, ঠিকাদার, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষদের সাথে মিশতে হয়। তাদের অনেকের নামের শেষে রায়, সাহা, দাশ, সাঁটিয়ার আছে। একই সাথে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাজ করছি তাদের সাথে। সামাজিক অনুষ্ঠানে উঠছি বসছি। সেই কবে বাগেরহাট থেকে চলে এসেছি, এখনও কথা হয় স্বপনদা’র সাথে। শরীয়তপুরের কত জনের সাথে হয়। নওগাঁর রবু শেঠ’দার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। এমনকি দেশের বাইরে কিছুদিন থাকার সুবাদে বন্ধুত্ব হয় সুয়াশ মেন্ডে, সুশান্ত পান্ত, অয়ন, গৌরবদের সাথে। ওরা ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের হলেও বন্ধুুত্ব হতে বাধা হয়ে দাড়ায়নি।
এর বাইরেও আমাদের অনেক বন্ধু আছে, পরিচিত জন আছে। যাদের অনেকের সাথে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি, কিংবা কাজের সুবাদে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে থাকে। আমার মতই অসংখ্য সাধারণ মানুষ আছে। আমার মতই এরকম হাজারও মানুষের সাথে তাদের উঠাবসা। কাজ কর্ম, চলাচল। সেখানে গায়ের রং, লম্বা খাটো, পয়সা বেশি কিংবা কম, বর্ন-গোত্র-ধর্ম দেখে সম্পর্ক গড়ে উঠে না, টিকে থাকে না। এই বন্ধন অটুট থাকুক। চিরদিন থাকুক, অমলিন থাকুক।