give me a child until 7 and I will show you the man
---
তুহিনের জন্ম হয়েছিল একটি ছোট, দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে, যেখানে গাছপালা আর পুকুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। গ্রামের বাড়িগুলো ছিল একটার পর একটা, একে অপরের খুব কাছে। জীবনের কঠিন সংগ্রাম ছিল সেখানে। বাড়ির ভিতর সব সময় অসন্তোষ ছিল, কারণ সেখানে যাদের ছিল তাদের পক্ষে সব কিছুই কঠিন হয়ে উঠেছিল। তুহিনের পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তার বাবা, সঞ্জয়, একসময় ছোটখাটো দোকানদার ছিলেন, কিন্তু ব্যবসা চলতে না পেরে এখন এক ধরনের অবসন্নতায় ডুবে ছিলেন। তার মা, সুচিতা, ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এক নারী, যিনি বাড়ির কাজকর্ম করতে করতে নিজেদের জন্য কিছু আয় করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাদের আয় কখনই বাড়ির খরচের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না।
তুহিনের বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন তার মা তার কাছে বসে বললেন, "তুহিন, তোর জন্য পৃথিবীটা একটা খুব বড় জায়গা, কিন্তু তুই যদি জানিস না, কোন দিকে এগোবে, তাহলে জীবন তোর পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠবে।" তুহিন তখনও মা-বাবার জীবনের কঠিন বাস্তবতা পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না। সে ছিল একটা ছোট্ট ছেলে, যার জন্য স্কুলে যাওয়ার পথটুকুই বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সে মনে করত, এসব বিষয় সে পরে বুঝবে। কিন্তু তার মা জানতেন, তার ছেলেকে একজন শক্তিশালী মানুষ হয়ে উঠতে হলে, তাকে সাত বছর বয়সের মধ্যেই সেই শিক্ষাগুলি দিতে হবে, যা তার জীবনের ভিত্তি গড়ে তুলবে।
মায়ের কথাগুলি তুহিনের কাছে তখন প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল। তার মনে হত, "আমি তো কেবল একটা ছোট্ট ছেলে, আমি কীভাবে বড় কিছু করব? আমি তো কিছুই বুঝি না!" তবে মা বলতেন, "তুই সব কিছু না জানলেও হবে, তবে মনে রাখতে হবে, যা তুই জানিস, তা থেকেই শুরু করতে হবে।" মা তাকে শেখালেন, মানুষ কখনোই ছোট নয়, যখন তার মনের ভিতরে বড় হওয়ার শক্তি থাকে। তুহিনের জন্য তখনও এটা একটা অসম্ভব চিন্তা ছিল, কারণ তার চারপাশে যাদের দেখত, তাদের জীবনে কিছুই সহজ ছিল না। তাদের সবার জীবন সংগ্রামে পূর্ণ ছিল।
তুহিন তখন স্কুলে যেতে শুরু করেছিল। স্কুল ছিল গ্রামে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রায় সব শিশুরই পরিচিতি ছিল। তবে কিছু কিছু ছাত্র এমন ছিল যারা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, আবার কিছু ছিল যারা শুধু মাঠে খেলাধুলা করত এবং বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। তুহিন, যদিও তার মায়ের কথা শুনে একটু একটু করে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে শুরু করেছিল, কিন্তু সে জানত না, এর পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তার মনে হত, পড়াশোনার মাধ্যমে যদি কেবল অন্যদের থেকে ভাল নম্বর পাওয়া যায়, তাহলে তা হবে অনেক। কিন্তু তার মা জানতেন, তাকে শুধু নম্বর নয়, জীবনের সঠিক পথ বেছে নেওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।
তুহিনের মা তাকে প্রায়ই বলতেন, “জীবনের প্রথম সাত বছর হলো এমন একটা সময়, যেখানে তোর মনের ভিতর যা কিছু প্রবেশ করে, তা একদিন তোর জীবনের মূল পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই যা কিছু শিখবি, সেটার মূল্য বুঝে শিখবি। কখনোও ভুলে যাস না, শিক্ষা শুধু বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তোর মন, তোর হৃদয়, তোর আত্মবিশ্বাসের মধ্যে এই শিক্ষা লুকিয়ে থাকবে।”
তুহিন তার মায়ের কথাগুলি পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও, সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তার মায়ের প্রতিটি কথায় মনোযোগ দিতে। সে জানত, তার মা তাকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে চান। তুহিন যখন স্কুলে ফিরে আসত, তখন সে তার মায়ের কথা মনে করত, "শুধু ভালো নম্বর নয়, জীবনকে সত্যি অর্থে ভালোভাবে জানাও, তবেই তো জীবনটা সার্থক হবে।"
সাত বছর বয়সের পর, তুহিনের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল যা তাকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। স্কুলে সে কিছু সহপাঠীর সাথে তুলনা করতে লাগল, এবং উপলব্ধি করল, যারা পড়াশোনায় ভালো ছিল তারা কিছু একটা পেলে। কিন্তু তখনই সে ভাবতে শুরু করল, “কেবল ভালো নম্বর পাওয়া না, জীবনে নিজেকে গড়ে তোলাও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে শক্তি আমি নিজের মধ্যে গড়ে তুলব, সেটাই আমাকে জীবনে সাফল্য এনে দেবে।”
তুহিনের জীবন তখন এক নতুন দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার মায়ের দেওয়া শিক্ষাগুলিই তাকে তার আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করেছিল। মা বলেছিলেন, "তুমি জীবনকে জানো না, তুমি পৃথিবীকে জানো না, কিন্তু নিজের পরিচয় তুমি তৈরি করতে পারো। যদি তুমি জানতে, আত্মবিশ্বাস কি, তবে তুমি সমস্ত দুঃখ কষ্টকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে।"
তারপর তুহিন নানা পথেই এগোতে শুরু করল। কখনো মাঠে খেলে, কখনো বই পড়ে, কখনো বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতায়, সে সব সময় শিখতে থাকল। তার জীবন খুব সহজ ছিল না, কিন্তু সে জানত, তার মায়ের দেওয়া শিক্ষা তাকে কখনোই হারাতে দেবে না। তার জীবনে যে শক্তি ছিল, তা শুধু তার মায়ের দেওয়া আশার কথা নয়, সেই কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শিক্ষা ছিল।
তুহিন আজ বড় হয়ে গেছে, তার জীবনে সংগ্রাম ছিল, কিন্তু সেই সংগ্রামের মধ্যে সে এক নতুন পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে। তার মা তাকে শিখিয়েছিলেন, “তুমি যখন জানবে তোমার মনের শক্তি, তুমি তখন জানবে পৃথিবী তোমার হাতে। তুমি যদি বিশ্বাস করো, তো তুমি কিছুতেই হারবে না।” তুহিন জানে, জীবনে তাকে যা কিছু শিখানো হয়েছিল, তা একদিন তাকে তার স্বপ্নের দিকে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
এভাবেই তুহিনের জীবন গড়ে উঠল, আর তা তার মায়ের দেওয়া শিক্ষারই ফলশ্রুতি ছিল। সাত বছরের শিক্ষা, যা তাকে এক জীবনের ভিত্তি দিয়েছে, সে আজ সেই শিক্ষার আলোকে নতুন এক পৃথিবী নির্মাণ করছে, তার নিজের জন্য এবং পৃথিবীকে আরো ভালো করার জন্য।
-