আমরা গ্রামের ছেলে। বেড়ে উঠেছি যে উপজেলা শহরে, মেজাজে মননে গ্রামের সাথে শহরের সামান্যই তফাৎ ছিল। আর এখন? আমরা না গ্রামের, না শহরের। না ঘরকা, না ঘাটকা। অনেকটা দড়ি ছেড়া গরুর মত। স্থির কোন চিত্র নেই, আবার বৈচিত্রেরও শেষ নেই। আমরা বোধহয় শহুরে এমিবা, কোন কিছুরই স্টেশন নেই।
শীতের এই মৌসুমে ধান কাটা শেষ হলে সেই বিরান ভূমিতেই ইসলামী জলসার আসর বসে। আমাদের ছোটবেলায় এরকম জলসায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। তখন বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না, জলসা ঘিরে গুড়ের জিলাপি, পুরি, খাগড়াই, হাওয়াই মিঠা, বাতাসি থেকে শুরু করে হরেক রকম খাওয়ার দোকান বসতো। সাথে চুড়ি, দুল, ফিতা, আয়না, আলতার দোকান। ছেলেদের জন্য ছোটখাট খেলনা, বেলুন, ভেঁপু, বাঁশি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে এসেও প্রায় সকল উপাদানের উপস্থিতি টের পাই। মূল জলসার পাশে অনেক দোকান, অনেক পসরা, অনেক মানুষ।
কিন্তু এখন ওসবের প্রতি মানুষের মোহ প্রায় কেটে গেছে? এখন পাড়ায় মহল্লায় দোকান, বাজার। শহরের সাথে যোগাযোগ বেড়েছে, সহজও হয়েছে। এবাদেও মানুষের হাতে চকচকে এন্ড্রয়েড মোবাইল, আর মোবাইল তো শুধু একটা মোবাইল নয়। নেট কানেকশন থাকলে, আস্ত দুনিয়া হাতের মুঠোয় বলা যায়। এরপরেও ইসলামী জলসার প্রতি মানুষের ভালোবাসার জায়গাটা কমে নি কেন? এই জিজ্ঞাসা আমারও।
কয়দিন আগে একটা ইসলামী জলসায় দাওয়াত পাই। কয়েক বার ফোন পেয়েছি। এছাড়াও, দাওয়াত কার্ড একজন অফিসে পৌঁছে দিয়েছে। সেই জলসা আপন মাতুতালয়ে, না গিয়ে কোন গতি ছিল না। বলে রাখি, সেই গ্রাম উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে।
সেখানে পৌঁছানোর পর বেশ উৎসবের আঁচ পেলাম। গ্রামের, আশেপাশের গ্রামের প্রায় সকল মানুষ চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সাগাই (আত্মীয়-স্বজন) চলে এসেছে। কোন গ্রামে জলসা হলে আত্মীয় স্বজনকে ডাকা যেমন কর্তব্য, সেই সাগাইদেরও চলে আসাও বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একজনকে জিজ্ঞেস করলে সুন্দর উত্তর পাই। ঈদ বা অন্য কোন অনুষ্ঠান যখন আসে, সব জায়গায় পালিত হয়। কে কার বাড়িতে যেতে পারে? কিন্তু এই জলসা উপলক্ষে আত্মীয়রা চলে আসে। এই জিনিসটা আমার একদম জানা ছিলোনা। জেনে বেশ ভালো লাগে। আত্মীয়দের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার একটা উপলক্ষও বটে।
প্রায় প্রতিটি ঘরে ভালো রান্না হয়েছে। আমরাও এক বাড়িতে খেয়ে নিই। খেয়ে তো অবশ্যই, খাওয়ায়ে উনারা আরও বেশি উৎসাহিত। আমাদের গ্রামের এই চিত্রটা অনন্য। শহরের মানুষেরা গ্রামকে কিছুই দেয় না, বরং শহরের জীবন চলে গ্রামের তাবৎ উপাদান দিয়ে। সেই সুত্রে, শহরবাসী কৃতজ্ঞ থাকবে কি? শহরের মানুষ এলে উল্টা গ্রামের মানুষই খুশিতে গদগদ। খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে জলসার স্টেজের দিকে যাই।
আমন্ত্রিত বক্তা তিন জন। এর মাঝে প্রথম বক্তা তার বক্তব্য শেষ করেছেন। ২য় বক্তা শুরু করেছেন মাত্র। খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। সবই মোটিভেশন স্পিচ, ভালো কাজ করলে ইহকালে পরকালে অনেক উপহার অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে, বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে বিশেষ জোর দিয়ে আলাপ করেন ২য় বক্তা। খুব দরকারি কথা। তখন পর্যন্ত কোন উস্কানিমূলক কথা কানে আসেনি।
মাইকে মাঝে মাঝে লোকজনদের ডাকা হচ্ছে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ সরাসরি স্টেজের সামনে না বসে ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে। বন্ধু আত্মীয়র সাথে গল্প করছে। দরকারি আলাপও সেরে নিচ্ছে। মানুষদের দেখে মনে হয়েছে, এই জলসায় আসা মানে রথ দেখা ও কলা বেচার সাথে আরও অন্য কিছুর যোগ।
এই পর্যায়ে উনাকে থামিয়ে সঞ্চালক কিছুক্ষণের জন্য মাইক্রোফোন নিজ করতলে নিলেন। বাংলাদেশের সকল অনুষ্ঠানের মাঝে একটা বিশেষ পর্ব থাকে। আমন্ত্রিত অতিথিরা শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, শুভেচ্ছা জানান প্রধান অতিথি, কয়েকজন বিশেষ অতিথি এবং অবশ্য অবশ্যই সভাপতি।
আমাকেও জোর করে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিছু বলতেও অনুরোধ করেন। আমি খুব অপটু মানুষ, জ্ঞানের ভাণ্ডারও যথারীতি শূন্য। তবুও সাহস করে বলি, ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের জ্ঞানে বিজ্ঞানেও অগ্রসর হওয়া দরকার। যে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলছি, রাতের বেলাও যে আলোর প্রাচুর্য দেখছি, মানুষের হাতে হাতে যে মোবাইল ফোন, সবই অন্যরা আবিষ্কার করেছে। আমরা কিন্তু এর একটাও ব্যবহার না করে পারছিনা। তাহলে আমরা নিজেরা কেন সেই জ্ঞান অর্জন করবোনা, যাতে এরকম অনেক ইউনিক কিছু আবিষ্কার করতে পারি? আমরা যাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে চাই, জ্ঞানে বিজ্ঞানে আবিষ্কারে তাদেরকে পিছনে ফেলতে পারলে বিজয় লাভ হবে।
মাইক পেলে বাঙ্গালি ছাড়তে চায় না। সেটা আমার মনে আসাতে থেমে যাই। আর ওরকম জলসায় বেশি কিছু বলার যোগ্যতাও নেই। সেটাও আমার মাথায় থাকে।
বেশ রাত হয়েছে। অনেকটা পথ ফিরতে হবে। দোকান থেকে কিছু গুড়ের জিলাপি, খাগড়াই কিনেছি। ওসব নিয়ে ফেরার পথ ধরি।