Posts

ফিকশন

ঘরে ইঁদুরের যাতনা, বাইরে ফুলকুমারির সুবাস*

January 22, 2025

সাজিদ রহমান

143
View

ইঁদুর নিয়ে আলাপ সৌদি রাজ প্রসাদে চলে যাবে, অতটা ভাবিনি। সেই গল্প বলবো, সাথে থাকছে ঘরে ইঁদুরের যন্ত্রণা ও পিনাকীর ফুলকুমারির আলাপ।

গত পৌনে দুই বছর ধরে থাকি সরকারি বাস ভবনে। আয়তনে বেশ বড়, ছোট বড় অনেক রুম। ভিতরের গাছ গাছালিতে পাখি বসে, মধুর চাক হয়েছিলো। সন্ধ্যা হলে মেডিকেল কলেজের দিক থেকে কিছু শেয়াল আসে, একটা কালো বিড়াল এদিক ঘুরে বেড়ায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত এই ডুপ্লেক্সটির মধ্যে এক ধরণের সুপ্রাচীন (ancient) ভাব আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন একটি নিরিবিলি পরিবেশে বসবাসের সুযোগ, কালেভদ্রে আসে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছিলাম, ধান আবাদের সাথে আগাছাও থাকে।

বেশ কয়েক মাস আগে নিচ তলায় ইঁদুরের আনাগোনা শুরু হয়। মোমেজা, যে আমাদের ঘর-দোর পরিষ্কার থাকতে সাহায্য করে, সেই প্রথম নোটিশ করে, এত এত ইঁদুরের গু পরিষ্কার করতে পারবেনা। আমরাও খেয়াল করলাম, ইঁদুরের হাগুর গন্ধ। এমনিতে আমাদের দিন রাত উপরেই কেটে যায়, কিন্তু মেহমান আসলে নিচে বসতে দিতে হয়, চা নাশতা খাওয়াতে হয়। দেখতে দেখতে ইঁদুর বাবাজিরা উপর তলায়ও চলাচল শুরু করে দিয়েছে। আবদার নয়, পূরাই দখল।

মাসুমা তাঁর বান্ধবীর সাথে আলাপ করে। বাজারে গ্লু ফাঁদ পাওয়া যায়। সেটা দিয়ে এক রাতে ৬/৭ টার দফদফানি দেখতে পেয়েছে সেই বান্ধবি। খুশি মনে বাজারে যাই। গ্লু ফাঁদ কিনে নিয়ে আসি। রাত হলে এদিক দিই, লাভ হয় না। পরের দিন অন্য জায়গায় দেই। এই এলাকায় থেকে এরা যথেষ্ট শিক্ষিত হয়েছে, বোঝা যায়। গ্লু ফাঁদে কোনভাবে ধরা দেয় না। এবার নিজেদের বুদ্ধিতে ফাঁদ কিনে নিয়ে আসি। সেই ফাঁদে কক্সবাজার থেকে কিনে আনা দামি শুটকি গেঁথে দেই। এরপর কয়েকটা ধরা পড়ে। ফাঁদ সহ পনিতে চুবিয়ে মারি। ওটা ছিল ১ম পর্ব।

কিছুদিন আগে আবার ওদের আনাগোনা শুরু হয়। একবার জেল খাটলে নাকি জেলের ভয় থাকে না। জেল খেটে বের হয়ে আসা একজনের কাছে শুনেছিলাম। এবারের ইঁদুরের অবস্থা জেল খাটা আসামির চেয়েও বেশি সাহসী। দামি শুটকি দিয়েও কাজ হয় না। দরজায়, টয়লেটে, কোনায় কানায়, ফুটোতে কাপড় দিয়ে আটকে দেয়া হল। কিন্তু অবস্থা হল বেহুলার বাসর ঘরের মত, কোন ফাঁক দিয়ে যে ঢুকে, বোঝা যায় না। স্বাভাবিক পথ বন্ধ হওয়ায় রাত হলে দরজায় নক করে। সেই নকের শব্দ শুনে সাফিয়া আতঙ্কিত হয়, আমরাও। সবাই মিলে এক রুমে থাকা শুরু করি। নিজেদেরকে ফিলিস্তিনি ফিলিস্তিনি লাগে, নিজ গৃহে পরবাসী।

এর মধ্যে একটাকে এক রুমে আটকে ফেলে পরিবার। আমি টেনিস থেকে ফিরলে খবর পাই। নিচের গেটের ছেলে সিদ্দিককে নিয়ে অভিযানে নামি। সাফিনও আমাদের সাথে থাকতে চায়, ওকে আপাতত বিরত রাখি। অবশেষে ওটাকে মারতে সমর্থ হই। সিদ্দিককে নগদ পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেই। কয়েক দিন পর অন্য রুমে আরেকটাকে আটকে দেয়। এই রুমটা বড়, সিদ্দিকসহ চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। সিদ্দিকের সাথে চুক্তি, মারতে পারলে ৫০ টাকা, ব্যর্থ হওয়াতে অল্প কিছু বখসিস দেই।

কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণ কি? বিভিন্ন জনের সাথে পরামর্শ করি। কৃষিবিদ সায়েম ভাইকে পরামর্শের জন্য ফোন দেই। উনিও গ্লু ফাঁদের কথা বলেন। কিছুদিন আগেই ভাবি গ্লু ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর দমন করেছেন। আমি জানতে চাই, ভাবি কোন দোকান থেকে কিনেছেন, সেই দোকানে যাবো। যে দোকানের চাল খেয়ে ওনাদের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, দরকার হলে সেই দোকান থেকে চাউল কিনবো। ঐ সময় তিনি আমাকে সৌদি রাজ প্রসাদে ইঁদুর মারার গল্প শোনান। গল্পটা আশির দশকের, ইঁদুর মেরেছিলেন এক বাংলাদেশি।সায়েম ভাইয়ের এক সিনিয়র ইঁদুর নিয়ে ইংল্যান্ডে পিএইচডি করেছেন, ইঁদুর বিশেষজ্ঞ। ঐ সময়ে সৌদি রাজ প্রসাদে প্রচুর ইঁদুরের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। সৌদি রাজ পরিবার ইঁদুর মারার উপযুক্ত লোক খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে সায়েম ভাইয়ের সেই সিনিয়রের খোঁজ পান। সৌদি রাজার শর্ত, ইঁদুর ধরে প্রমাণ রাখতে হবে। তখন সেই গ্লু ফাঁদের মাধ্যমে রাজপ্রসাদ ইঁদুর মুক্ত হয়। গল্প শুনে চমৎকৃত হই, আমাদের দেশের একজন কৃষিবিদ সৌদি রাজপ্রসাদের ইঁদুর নিধন করে দিয়েছেন।

ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘরে ইঁদুরের যন্ত্রণা নিয়ে কতটুকু আর উদযাপন করা যায়? কয়েক দিন পরের কথা। অফিসে বসে বসে কারে কারে যেন ইঁদুরের যন্ত্রণার কথা বলছি। সেই সময় রুমে ছিল ক্যাশিয়ার মিজান। সে বলল, তাঁর কাছে একটা বিষ আছে, ভাতের সাথে মাখিয়ে রাখলে ইঁদুর নির্বংশ হবে। আমি তখন গভীর জলে ডুবে যাওয়া মানুষের মত, খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চাই। ওকে বললাম, দিও, চেষ্টা করে দেখি।

পরের দিন পলিথিনের স্তরে স্তরে প্যাঁচানো প্যাকেট পেলাম। বাসায় গিয়ে খুলে দেখি, সেই প্যাকেট আমার বাসাতেও আছে। সায়েম ভাই বলেছিলেন, ঐ বিষ শুটকির সাথে মিশিয়ে দিতে। দিয়েছিলাম, কাজ হয়নি। মিজানের উপর ভরসা পাচ্ছিলাম না, তবুও রাতে ভাতের সাথে বিষ মাখিয়ে দিলাম। রাতে বেশ খুট খাট শব্দ পেলাম। সকালে এদিক ওদিক খুঁজি, কোন মৃত অর্ধমৃ ইঁদুর বাবাজিকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু পরের দিন রাত থেকে ইঁদুর আর নেই।

শেষ পর্যন্ত যে মিজান অর্থ নিয়ে কাজ করে, সেই সঠিক টেকনিক্যাল পরামর্শ দেয়। আপাতত ঘরের ইঁদুরের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছি।

২।

ইদানিং পিনাকি ভট্টচার্য একটা উপন্যাস লিখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা ফুলকুমারি নামের এই বই ইন্ডিয়া ও সাউথ এশিয়া বিভাগে বেস্ট সেলার হিসেবে ঝড় তুলেছে। পিনাকীর সেই ফুলকুমারি আর কেউ না, একটা ইঁদুর। ফুলকুমারি কোভিডের সময়ে পিনাকীর ঘরে ঢুকে পড়েছিল। এই পর্যন্ত শুনে আবুল মনসুর আহমেদের রিলিফ ওয়ার্ক গল্পের কথা মনে পড়ে। বন্যায় একটুকু ডাঙ্গা পেয়ে আশ্রয় নেয় সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, বেড়াল অনেকেই। কিন্তু মিলেমিশে থাকে, এমনি সময়ে যেটা অসম্ভব ব্যাপার। কোভিডের সময়টা বন্যার চেয়েও ভয়াবহ ছিল। ওইরকম সময় পিনাকির ঘরে ঢোকা ফুলকুমারি নামের সেই ইঁদুরের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। নিঃসঙ্গ জীবনে ফুলকুমারিকে নিজের, দেশের গল্প শোনান। যে গল্প হয়ে ওঠে দুনিয়া কাঁপানো গল্প।

৩।

অনেক ভেবে দেখেছি। আমার ও পিনাকির মধ্যে কি তফাৎ? আমার ঘরে ইঁদুর ঢুকলে সেটাকে তাড়াতে অস্থির হয়ে পড়ি। পিনাকিদা সেই ইঁদুরের সাথে গল্প বলে বিশ্বজয় করে ফেলে।

Comments

    Please login to post comment. Login