Posts

গল্প

মৃতদের প্রতিধ্বনি

January 25, 2025

Subit Baran Mallick

40
View
মৃতদের প্রতিধ্বনি।

মৃতিঞ্জয়পুর। পশ্চিমবঙ্গের এক ছোট গ্রাম। চারদিকে সবুজের মাঝখানে নির্জন এই গ্রামের নামকরণে এক অদ্ভুত শীতলতা লুকিয়ে আছে। দিনের বেলা সব স্বাভাবিক, তবে সূর্য অস্ত যেতেই এই গ্রাম ঢেকে যায় গভীর এক নীরবতায়। মনে হয়, এখানে রাতের অন্ধকার কেবল অন্ধকার নয়, বরং মৃতদের আত্মার প্রতিধ্বনি।

গ্রামের মানুষদের কাছে এই জায়গার ইতিহাস জটিল ও ভীতিকর। অনেক বছর আগে, এই গ্রামে রাজত্ব করত জমিদার রুদ্রনারায়ণ। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ও অত্যাচারী। তার রাজপ্রাসাদের চারপাশে বিশাল প্রাচীর, ভেতরে অগণিত কুঠুরি। কথিত আছে, তার প্রাসাদের এক গোপন ঘরে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে বন্দি করে রাখা হত। কেউ কেউ বলত, সেখানে তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হত। একসময়, গ্রামবাসীদের মনে জমতে থাকা ভয় আর ক্ষোভ এক হয়ে যায়। তারা বিদ্রোহের আগুন জ্বালায়।

তবে সেই বিদ্রোহের আগুন যেন রুদ্রনারায়ণকে ছাইয়ে পরিণত করতে পারেনি। এক অদ্ভুত অভিশাপের মতো, তিনি মারা গেলেন রহস্যজনকভাবে। তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল প্রাসাদের গোপন কুঠুরিতে। মুখটা বিকৃত, যেন ভয়ঙ্কর কিছু দেখার পর মারা গেছেন। সেদিন থেকেই গ্রামে শুরু হয় অদ্ভুত ঘটনা।

প্রথমে মন্দিরের পাশের সমাধিস্থল থেকে রাতের বেলা কান্নার আওয়াজ আসতে শুরু করে। কেউ কেউ বলত, তারা মাটির নিচ থেকে ফিসফিস শব্দ শুনেছে। কেউ বলত, অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দেখে ভয়ে পালিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে এক পূর্ণিমার রাতে।

গ্রামের কৃষক কেশবের ছেলে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই রাতে কেশব শুনেছিল তার দরজায় কেউ বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলে দেখল, সামনে কেউ নেই। কিন্তু পায়ের কাছে পাওয়া গেল রক্তমাখা এক ছোট্ট পুতুল।

এরপর গ্রামে ভয়ের আবহ আরও ঘনীভূত হয়। সূর্য অস্ত গেলে কেউ আর ঘরের বাইরে বের হত না। সমাধিস্থলের কাছে যেত তো দূরের কথা। গ্রামের বৃদ্ধরা বলত, জমিদার রুদ্রনারায়ণের আত্মা মুক্তি পায়নি। তার সাথে যারা অন্যায়ভাবে মারা গিয়েছিল, তারাও এখন শান্তি পায়নি। তারা রাতের অন্ধকারে শিকার খুঁজতে বের হয়।

সৌমেন ছিল গ্রামের একজন তরুণ শিক্ষিত ছেলে। শহরে পড়াশোনা করে সে সম্প্রতি গ্রামে ফিরেছে। এসব ভূতপ্রেতের গল্প সে মোটেও বিশ্বাস করত না। তার মতে, এ সব ছিল গ্রামের মানুষের কুসংস্কার। একদিন সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই ভয়ের সত্যতা পরীক্ষা করবে।

এক পূর্ণিমার রাতে, সৌমেন হাতে টর্চলাইট নিয়ে সমাধিস্থলের দিকে রওনা দেয়। গ্রামের লোকেরা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সে কারও কথা শুনল না। সে মনে মনে ভাবছিল, "এতদিনের ভয়কে ভেঙে ফেলার সময় এসেছে।"

রাত তখন গভীর। চাঁদের আলোতে সমাধিস্থলটি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। বাতাসে একটা অদ্ভুত শীতলতা। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। সৌমেন টর্চের আলো ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ তার পায়ের নিচে একটা শুকনো পাতা চুরমুর করে ভেঙে যায়। তার মনে হল, কোথাও থেকে কেউ তাকে দেখছে।

সমাধিস্থলের পাশে একটা পুরনো কালীমন্দির। মন্দিরের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল ধোঁয়া আর এক ধরনের মৃদু সুর। সৌমেন সেখানে যেতেই তার টর্চ বন্ধ হয়ে যায়। বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। সে চারদিকে তাকাতে লাগল, আর তার মনে হল, ছায়ার আড়ালে কিছু মুভ করছে।

হঠাৎ করেই চারপাশের মাটি থেকে একজোড়া হাত উঠে এলো। তার পায়ের চারপাশে জড়িয়ে ধরল। সে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। তারপর, কুয়াশার মধ্যে থেকে একটা অদ্ভুত ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো। মূর্তিটার চোখে ছিল অদ্ভুত শূন্যতা। তার মুখে বিকৃত হাসি।

মূর্তিটি বলল, "তুমি এখানে কেন এসেছ? এখান থেকে চলে যাও। নইলে তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ।"

সৌমেন পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা চলছিল না। মাটি যেন তাকে গিলে নিচ্ছিল। আর সেই মূর্তিগুলো এগিয়ে আসতে লাগল। একসময় সবকিছু কালো হয়ে গেল।

পরদিন সকালে, গ্রামবাসীরা সমাধিস্থলের কাছে সৌমেনের জুতো আর টর্চলাইট খুঁজে পায়। কিন্তু সৌমেনকে আর কখনো দেখা যায়নি। গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করল, সৌমেন মৃতদের প্রতিধ্বনির শিকার হয়েছে।

এরপর থেকে গ্রামে রাতের ভয় আরও তীব্র হয়ে ওঠে। মাটির নিচ থেকে শোনা যেত কান্নার আওয়াজ। বাতাসে ভেসে আসত ফিসফিস কথা। শিশুদের কান্নার শব্দ শুনলে, মনে হত তারা যেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে কথা বলছে।

গ্রামের পুরোহিত বহু চেষ্টা করেও এই ভৌতিক ঘটনাগুলো থামাতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, "এই আত্মারা শান্তি পায়নি। জমিদারের গোপন কুঠুরির অন্ধকারে তাদের যন্ত্রণা এখনও জ্বলজ্বল করছে।"

আজও মৃতিঞ্জয়পুরে রাতে গেলে শোনা যায় সেই কান্নার প্রতিধ্বনি। আপনি কি সাহস করবেন সেখানে এক রাত কাটানোর?

Comments

    Please login to post comment. Login