হঠাৎ একদিন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে, শহরের নানা প্রান্তে ‘কষ্টে আছে-আইজুদ্দিন’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ দেখে শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা সেই শৈশবকালের কথা। আমাদের গ্রাম ছিল আর দশটা গ্রামের মতই সাধারণ। মাটির দেয়ালে তৈরি ঘর, উপরে খড়ের চালা। কারও কারও থাকত খাড়া টিনের ঘর। যে সময়ের কথা বলছি, ছেলে-মেয়ের বিয়ে, নিজের সামাজিক অবস্থা বোঝাতে খাড়া টিনের ঘর ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। দেশে নির্বাচনের মৌসুম এলে মাটির সেই দেয়ালে দেয়ালে চিকা-মারার মৌসুম শুরু হয়ে যেত। দেয়ালে টিনের পাত চেপে ধরে রং-মাখানো কাপড় দিয়ে ঘ্যাট ঘ্যাট করে মারলেই চিকা-মারা হয়ে যেত। শীতের সকালে রোদের আশায় মোয়া-মুড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পেতাম দেয়ালে দেয়ালে নতুন নতুন চিকা-মারা হয়েছে। তার কোনটাতে হয়ত লেখা আছে, "আনোয়ার ভাইকে জানোয়ার মার্কায় ভোট দিন"। হাল আমলে এসে শহরে-নগরে সেই সময়ের চিকা-মারাকে জনপ্রিয় করে তোলে আইজুদ্দিন, নাজির কিংবা সুবোধেরা। তারও বহু আগে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ কিংবা ‘আইয়ুব-মোনায়েম ভাই ভাই/ এক দড়িতে ফাঁসি চাই ’, এমন বহু প্রাণের কথার ছাপচিত্র আঁকা থাকত শহরের দেয়ালে দেয়ালে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এই দেয়াল লিখন ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণঅভ্যুত্থানে প্রভাব রেখে চলেছে। ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়/বুক পেতেছি গুলি কর’।সারাদেশের শহর নগর গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে এরকম অভূতপুর্ব স্লোগান, সচিত্র সব দেয়াল লিখন। স্লোগানের পরিমাণে ও বিষয়ের বৈচিত্র্যে এই পর্বের দেয়াল লিখন ছাপিয়ে গেছে অন্য যেকোন সময়কে। সারা দেশের দেয়ালগুলো যেন জীবন্ত মিছিল, যা দুঃসময়ের ছবিকে যথার্থ ভাবে চিত্রিত করেছে।
২।
আমরা এই পর্বে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দিকে নজর দিতে চাই। এই নিবন্ধের মূল উদ্যেশ্য থাইল্যান্ডের গ্রাফিতির হালহকিকত জানা। বিশেষ করে দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি পাওয়া এলেক্স ফেস ও তাঁর সৃষ্টি মার্ডি চরিত্রের তত্ত্ব তালাশ করা। এলেক্স ফেসের কাছে যাওয়ার আগে গ্রাফিতি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য জানলে মন্দ হয় না। অনলাইনে থাকা বিভিন্ন সোর্স জানায়, অস্ট্রেলিয়ার গুহায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের আঁকা (১০-৪০ হাজার বছর আগের) লেখচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই যুগ পার হয়ে ২৫০০ বছর পুর্বে রোমের দেয়ালে গ্রাফিতির সন্ধান মেলে যার অধিকাংশই ছিল যৌনাচার সম্পর্কিত বড়াইয়ের প্রতিভূ। এর বাইরেও প্রাচীন যুগে ওসবের বাইরেও অন্য রকম টেক্সটও ছিল, যেমন, ‘আমি এখানে ছিলাম’ (একটা জায়গায় এসে অন্য একজনকে না পেয়ে তাঁর উপস্থিতির চিহ্ন রাখার কৌশল) কিংবা ‘আলেজেমেনস স্রষ্টার ইবাদত করে’ জাতীয় ধর্মীয় উপদেশ। এরপরে গ্রাফিতি তার ভ্রমণ পথে মধ্যযুগেও অনেক নিদর্শন রেখে দিয়েছে। এবং অবশেষে এই আধুনিক যুগেও গ্রাফিতি কিভাবে তার সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, সেই দিকটার সুলুকসন্ধান করতে চাই আমরা। এর অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত আলোচিত গ্রাফিতির আইকন শিল্পী এলেক্স ফেস ও তাঁর আঁকা আলোচিত চরিত্র মার্ডিকে বেছে নেয়া হয়েছে।
৩।
দৃশ্যত আমাদের চোখের সংখ্যা দুইটি হলেও মনের আরেকটি চোখ আছে। আসলে সেই চোখটি হল মানুষের বিবেক। এবং ধরে নেয়া হয় এই মনের চোখ বা বিবেকই হল আসল চোখ, যাকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদালতও বলা হয়ে থাকে। নিশ্চিত না হলেও ধরে নেয়া যেতে পারে, মার্ডির অনন্যতা হল তাঁর সেই তৃতীয় চোখ। আর আমার কাণ্ড দেখুন, বলদের আগেই হাল জুড়ে দিয়েছি। আর ঠিক এই কারণে এখন আমরা সরাসরি সেই এলেক্স ফেস ও তাঁর মার্ডির শিকড়ের গল্পের দিকে চোখ ফেরাবো।
পাচারাপন তাঙ্গারুয়েন (Patcharapon Tangruen) এর জন্ম থাইল্যান্ডে, ৮০র দশকের শুরুতে। যখন তাঁর বয়স ৩ বছর, তখনই তাঁর আকাআকির পারদর্শিতা পরিবারের নজরে আসে। এরপর সময় হলে পরিবার থেকে তাঁকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। আর্ট স্কুলের পড়াশুনা দিনের পর দিন তাঁকে বিমর্শ করে ফেলে। একটা সময় তাঁর মনে হয়, যে আর্ট সে বিধাতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছে, সেখান থেকে সে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। এলেক্স ২য় বর্শে পড়ার সময় একরাতে এক বন্ধু কৌশলে তাঁকে বাইরে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাঁরা আঁকতে শুরু করে। এলেক্স প্রথমে একটা দেয়ালে নিজের নাম লিখে এবং এতে নিজের স্ট্রেস কমে যাচ্ছে বুঝতে পারে। এরপর স্কুলের স্ট্রেস থেকে মুক্তি পেতে তিনি প্রায়শই পেইন্ট এর ক্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং নিজেকে বেশ নির্ভার লাগতে শুরু করে। এরপর একটা সময়ে তিনি শুধু থাইল্যান্ড নয়, বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান। পাচারাপন তাঙ্গারুয়েন আর কেউ নন, এলেক্স ফেসের প্রকৃত নাম। এলেক্সের আইকনিক সৃষ্টি মার্ডি। মার্ডি যেন তুলতুলে জামা পরা একটি প্রাণী, যার একটি অতিরিক্ত একটি চোখ আছে। মার্ডির সেই অতিরিক্ত চোখ ঘুমে পরিপুর্ন কিন্তু সন্দেহ বাতিক। যদিও এলেক্স এখন একজন ব্যস্ত আর্টিস্ট, সময় পেলেই তিনি রঙের ক্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। দেয়ালে দেয়ালে সমাজ ও সময়কে তুলে ধরার জন্য। ইচ্ছে মত শহরের একটা জায়গায় বসে পড়েন এবং ছবি আঁকতে শুরু করেন। এখন থাইল্যান্ডের দেয়ালে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

৪।
২০০৯ সালের ঘটনা। ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয় আশিয়ান সম্মেলন। সেই সম্মেলনের বিরুদ্ধে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে কৃষক ও দরিদ্র মানুষেরা। এর আগের বছর ধনী ও মধ্যবিত্তরাও বিক্ষোভ করে, যা ছিল বিরোধী দলের কর্মসুচির অংশ। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। দেশ অনেক মতে ও পথে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এলেক্সের মেয়ে তখন ছোট, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। একা শুধু এলেক্স নয়, সেই দুশ্চিন্তা ছিল প্রায় প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে। সেই জনগণের শঙ্কা এলেক্সকে আলোড়িত করে। একটা সময় এলেক্স শহরের দেয়ালে দেয়াল তাঁর মেয়ের মুখ আঁকতে শুরু করেন। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা সেই গ্রাফিতির মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে এলেক্সের মেয়ের ভবিষ্যৎ শঙ্কা। বলতে গেলে থাইল্যান্ডের সকল শিশুদের ভবিষ্যৎ শঙ্কার চিত্র। এভাবেই ৩ চোখের মার্ডির জন্ম হয়। মার্ডির ৩য় চোখ জনগণের সহানুভূতি পেতে থাকে। মার্ডির লাল চোখ সমাজের দ্বিধা দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সে তাঁর সেই ৩য় চোখ দিয়ে ভিন্ন কিছু দেখে, যা সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না।
বিভিন্ন কারণে ২০১৪ সালে আবারও থাইল্যান্ডের রাজনীতি অস্থির হয়ে পড়ে। আর্মি মার্শাল ল জারি করে। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। রাজনীতিবিদদের গারদে ঢুকানো হয়। ঠিক এই সময়ে আর্মি শাসনের বিরুদ্ধে দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকা হয়। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা। এলেক্স ফেস স্প্রে আর্টকে তাঁর শখ বানিয়ে ফেলেন। এলেক্সকে দেখে নতুনরা উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ে। এলেক্স ফেস মূল প্রতিপাদ্য সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা, ধীরে ধীর অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
দিন বদলাতে থাকে। থাইল্যান্ডে স্ট্রিট আর্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তি পর্যায়ে তাদের বাড়ির দেয়ালগুলো শিল্পীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর ফলে অসাধারণ ঘটনা ঘটছে। শহরের গুরুত্বপুর্ন দেয়াল, স্থান স্ট্রিট আর্টে ভরপুর হয়ে গেছে। যার কারণে অনেকগুলো স্পট বর্তমানে দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে ফটো তোলার জন্য। দেশ বিদেশ থেকে লোকজন সেই স্থানগুলো ভিজিট করছে। এমনকি সিনেমার শুটিং এও এই লোকেশনগুলো ব্যাপক অনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

৫।
পুর্বে সাধারণ মানুষ ও আর্টিস্টদের মধ্যে সংযোগ ছিল খুব সামান্যই। কিন্তু এই স্ট্রিট আর্ট সেই বাধাকে উপড়ে ফেলেছে। থাইল্যান্ডের রাস্তা ধরে খেয়াল করলে সেটার সত্যতা মিলে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক শহর বড় হয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তন আসছে। এর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত chaleomla Park এখানে আর্ট লাভাররা আসেন, তাদের মত করে আর্টের কাজ করেন। chaleomla এর পার্কটিতে এই আকাআঁকি শুরু হয়েছিলো ২০১৮ সালে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনেক নতুন নতুন আর্টিস্ট এতে যোগ দেয়। আনন্দের সাথে তাদের কাজ করে যায়। বর্তমানে এটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
থাইল্যান্ডে ২০০৯ ও ২০১৪ এর সংকটে মার্ডির জন্ম হয়। সেই সংকটে মার্ডি দিয়েছিলো প্রতিবাদের প্রেরণা। থাইল্যান্ড সেই সংকট কাটিয়ে উঠেছে। এখনকার দিনে মার্ডি চরিত্রের অনুপ্রেরণায় গ্রাফিতি একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি থাইল্যান্ডের জনজীবনে উৎসাহ ও বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে থাকছে প্রতিদিনের জীবনে। গ্রাফিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চব্বিশের গনঅভ্যুত্থানের সাথে থাইল্যান্ডের সংকটের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে এলেক্স ফেসের কাল্পনিক চরিত্র মার্ডি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে বাস্তবের আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, নাফিজেরা জীবন উৎসর্গ করে গ্রাফিতির চরিত্র হয়েছে, স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিয়েছে লাখো মানুষের অন্তরে। শুধু তাই নয়, হয়ত আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধরা প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে থাকা আগনিত মজলুম মানুষদের, যারা বেঁচে আছেন নানা রকম বৈষম্যের ভিতরে। (সমাপ্ত)