একটা টঙের উপর বসে আছি। গ্রামে এখনও টং বা মাচাং কালচার চালু আছে। বাড়ির সাথে গাছের নিচে অথবা অন্য কোন উপযুক্ত জায়াগায় বাঁশের টং করে রাখে। দূর দূরান্ত থেকে আসা পথিক বসে। যে কেউ এসে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারে। অবসরে বেশ আড্ডা বসে। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে ফকির ফাঁকরারাও বসে জিরিয়ে নেয়। বাড়িতে সাগাই এলে তারাও বসে।
উত্তর বঙ্গের একটা গ্রামে। বিয়ের দাওয়াতে গেছি। খাওয়া দাওয়া শেষে টং এর উপর বসে আছি। গ্রামের ছোট একটা ছেলে টং এ ওঠার চেষ্টা করে। বেশ ছোট, উঠতে গিয়ে প্যান্টে আটকে প্রায় ঝুলে গেছে। ঝুলে যেতে যেতে আবার সোজা হয়, নেমে পড়ে, আবার টং এ উঠে পড়ে।
পিচ্চিটার পরনে জিনসের প্যান্ট। যেভাবে ঝুলে গেলো, ভাবলাম ছিঁড়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ছিঁড়ল কিনা।
-না, এটা সেই রকম প্যান্ট না যে ছিঁড়ে যাবে। বেশ স্বপ্রতিভ। বরং আমার প্রশ্নে তার কণ্ঠে হাস্যরসের সুর।
-এটা বিশেষ রকম প্যান্ট? ছিঁড়ে না? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
-মুরুব্বির মাথায় বুদ্ধি আছে। মুরুব্বি বুঝতে পারছে। আমার কথার উত্তরে এই কথা বলে হাসতে থাকে।
২।
রংপুর শহরের একটা অভিজাত শপিং কমপ্লেক্স। টপ ফ্লোরে ফুড কোর্ট। আমরা কয়েকজন চা খাবো বলে বসি। আমাদের সকলের বাচ্চারা একটা কম্পিটিশনে ব্যস্ত, আমরা আড্ডায়। দুইজন ব্যাংকার, দুইজন উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও এই অধম মিলে এই আমরা। হরেক বিষয়ে আলাপ চলছে। সব আলাপ এখানে পুনর্লিখন সম্ভব নয়, কারিগরি কারণে।
আলাপের এক পর্যায়ে নাগরিক রাখালের কথা উঠে। দুই দশক আগের কথা। গল্প খোদ রাজধানী শহরের। ভার্সিটির হলগুলো রাত বেশি হলে সরগরম হয়ে ওঠে। হঠাৎ এক একদিন রাত ২ টা আড়াইটায় দল বেঁধে বের হই। উদ্দেশ্য চাংখারপুলে সোহাগের চাপ কিংবা কালো ভুনা, সাথে পরোটা। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের বাহন হত আমাদের দুই পা।
আসা যাওয়ার পথেই নাগরিক রাখালদের সাথে দেখা হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা গরু গাবতলিতে ট্রাক থেকে নামিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়াই এদের কাজ। আমরা ওদেরকে নাগরিক রাখাল বলে ডাকি।
নাগরিক রাখালের গল্পের আগে ছোট আরেকটা কথা বলে নেই। ঢাকায় কলেজে পড়তে গিয়ে অনেক সহপাঠীকে পেয়েছি যারা লাইভ ধানগাছ, পাটগাছ দেখেনি। শুনে আমি নিজে তব্দা খেয়ে যেতাম। তাদের জন্য আমার খুব মায়া হত। গল্প আর ওদিকে টেনে বাড়াচ্ছি না। চাপ বা কালভুনায় ফিরি।
ঢাকা শহরে কি মহিষের মাংস পাওয়া যায়? খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু চাংখারপুলে যাওয়া আসার পথে আমরা দেখতাম দলে দলে মহিষ চলে যাচ্ছে। নাগরিক রাখালদের হাতে মহিষের দড়ি।
-ভাই, সব গরু দেখতে কালো কেন? ওদেরকে জিজ্ঞেস করে বসি।
আমরা কি আসলে গরু মহিষের পার্থক্য বুঝিনা, নাকি মশকরা করছি?
ওরা হয়ত ভেবেছে, আমরা নিজেরা আমার সেই সহপাঠীদের মত, যারা গরু মহিষের পার্থক্য জানি না।
আমাদের প্রশ্নে ওরা কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারেনা। আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে থেকে মহিষের পাল নিয়ে এগিয়ে যায়। ভার্সিটি এলাকায় ছাত্রদের আলাদা দাপট থাকে, হয়ত সেটা জেনে চুপ করে থাকে।
৩।
গল্প যখন এই পর্যায়ে এসে গেছে, দোকানদার পানির বোতল ও চা নিয়ে হাজির। বলে রাখি, আমরা গাইয়ের দুধের সাথে পাটালি গুড়ের চায়ের অর্ডার দিয়েছিলাম। চায়ের উপরে কফির মত ধূমায়িত ফেনা, তার কিছু অংশ সাদা, কিছু অংশ লালাভ।
-ভাই, ফেনার কিছু অংশ সাদা, কিছু অংশ লাল কেন? সকল গরু দেখতে কালো কেন, সেই গল্প তখন মাত্র মাঝ মাঠে ছেড়েছি। গল্পের চৌম্বকীয় আবেশে আমরা তখনও আবেশিত। তাই মজা করার জন্য প্রশ্নটা করে বসি।
কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টা। বেশ মাইন্ড করে বসলেন। এরকম মাইন্ড করতে দেখি এক ধরণের দোকানদের, ২ হাজার টাকার জিনিস কাস্টমার যখন ৩০০ টাকা বলে বসে।
-ভাই, আমাদের কথায় কি রাগ করেছেন? আমি যেচে তাকে জিজ্ঞেস করি।
-রাগ করবো কেন? আপনারা কাস্টমার যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন।
শিউর হলাম, যখন আরও দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
-ভাই, দুধ গরম হচ্ছে, এখন আর চা দেয়া সম্ভব নয়।
আমাদের সাফ সাফ জানিয়ে দিলো। অথচ পাশেই অন্যদের চা দিতে দেখল, আমাদের সাথের একজন।
৪।
চা খুব ভালো ছিল। সবাই চায়ের প্রশংসা করছি। কাপে চায়ের পরিমাণও অনেক। শেষ করতে বেশ সময় লাগছে।
-চায়ের গভীরতার চেয়ে দোকানদারের গভীরতা কম।
আমাদের মধ্যে একজন মন্তব্য করলো।
দোকানদার অবশ্য শোনেনি। শুনলে যে কি বলে বসতো, খোদা মালুম!
47
View