মহাকালকে বলা যায় অসংখ্য মুহুর্তের সমষ্টি। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহুর্ত যেন মহাকাল নামক নদীর বহমান স্রোত। সেই সময়ের স্রোতে ভাসে সৃষ্টির শুরু থেকে কোটি মানুষের জীবনের গল্প কিংবা গল্পের জীবন। তারই ধারাবাহিকতায় ধরণীতে নতুন শিশুর আগমনে জন্ম হয় নতুন আরেকটি গল্পের। যে গল্প শুরু হয় শিশুর জন্মেরও আগে, মাতৃগর্ভের জঠরে, কিংবা তারও আগে থেকে। যে গল্পের অনুষঙ্গ হয় মায়ের হাজারো কষ্টের মাঝেও প্রসারিত হাসিমুখ। সেই গল্প থাকে সেই শিশুকে নিয়ে মায়ের খুনসুটির ভিতরে। শিশুটি বেড়ে ওঠে প্রতিদিনের হরেক রঙের গল্পের ভিতরে। প্রতিদিনের সেই ছোট ছোট গল্পই মানুষকে নিয়ে যায় তার শেষ গল্পের দোরগোড়ায়। এভাবে আদিকাল থেকে ইথারে সওয়ার হয়ে ভেসে বেড়ায় হাজারো গল্পের উপাদান। কখনওবা দিব্য চোখে দেখা মেলে তারই কিছু খণ্ডিত অংশ। কারও কারও মাঝে তাগিদ তৈরি হয় সেই গল্প লেখার। যে গল্পটা হয়ত অযত্নে চাপা পড়ে থাকে যুগ যুগান্তর ধরে। হয়ত সময়ের প্রয়োজনে সেই গল্পটা বলা জরুরী হয়ে পড়ে। হোক সেই ছাইচাপা গল্পটা দুঃখের, অবহেলার, কিংবা অর্থহীনের।
গ্রামে জন্ম নেয়া এই আমি যখন ছিলাম খুব ছোট, তখনকার শীত কালের সকালে মায়েরা আমাদের গায়ে একটা চাদর (আমরা যাকে বলতাম গজি) পেচিয়ে, একটা বাটিতে (দোন) মুড়ি ও মোয়া মাখিয়ে রোদের মাঝে চাটাইয়ে কিংবা চটের বস্তার উপর বসিয়ে দিতেন। সেটা ছিল রোদমাখা সোনালী সকালের গল্প। সেখানে বসে আমরা কি যেন ইলিবিলি কিলিকিলি নিয়ে গল্প করতাম। এর মাঝে সেখানে চলে আসত রহিম বুড়াও, যে ছিল আমাদের গ্রাম সম্পর্কের দাদা। তার মাথায় ছিল দুইটা জিনিস। এক, মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল; দুই, মাথা ভর্তি গল্পের ভাণ্ডার। ২০ টা চুল তুলতে পারলে একটা নতুন গল্প। এই ছিল তার টোপ কিংবা আজকের দিনের ভাষায় বলতে হয় টেন্ডারের শর্ত। হুমড়ি খেয়ে পাকা চুল তুলে রহিম বুড়াকে বুঝিয়ে দিতাম, পারিশ্রমিক হিসেবে শুনতে পেতাম একটি নতুন গল্প।
বলা যায় সেই থেকে শুরু। এরপর গল্প শোনার কিংবা পড়ার নেশায় কখনোই ভাটা পড়েনি। হাইস্কুলে ঐচ্ছিক দ্রুত পঠন (র্যাপিড রিডার) বই পাওয়া মাত্র ওইদিনই পড়া শেষ। থাকতাম মফস্বলে, অন্য সবকিছুর মত ছিল বইয়েরও আকাল। সিডরের পর সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেমন খাবারের অভাবে হয়ে উঠেছিল আরও হিংস্র, বইয়ের জন্য আমার খুদাটাও ছিল ওরকমই। এখনও মনে আছে, একবার ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একটা বই পেয়েছিলাম। ওটা ছিল একটা বড়দের উপন্যাস।সম্ভবত ওটার নাম ছিল বর্সা রাতের শেষে। লেখক আব্দুল হাকিম। পরে জেনেছি উনি ছিলেন মাসুদ রানা সিরিজের অনেকগুলোর গোস্ট রাইটার। ফুফু বাড়ির খড়ের পলে হেলান দিয়ে এক বসায় শেষ করেছিলাম বর্সা রাতের শেষে বইটা। সেই বইটা আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। এরপর এসএসসির পরে সাতকাহন, ভার্সিটি লাইফে শীর্সেন্দুর পার্থিবে ও সঞ্জীবের লোটাকম্বলে বুদ হয়েছিলাম। উদাহরণ হিসেবে লোটাকম্বলের কথা বলি। আমার রুমমেট বলেছিল, পড়ে দেখ এতে লেখক তোর মনের সকল কথা লিখে রেখেছে। পড়লাম আর অবাক হলাম। এও কি সম্ভব! পরে জানতে পারি, লোটাকম্বল যে পড়েছে তার কাছেই মনে হয়, এটা তার গল্প। এইভাবে বই পড়া চালু ছিল, চালু আছে এখনও। কখনও পড়ার গতি ছিল হাইওয়েতে চলা দ্রুতগামী বাসের মত, কখনওবা সেটা নেমে আসে দীর্ঘদিন সংস্কারহীন রেল-ট্রাকে চলা মালবাহী ট্রেনের মত। এই হল আমার পাঠক স্বত্বার কিয়দংশ।
২।
বাংলা সাহিত্য এক সমৃদ্ধ সাহিত্যের ভাণ্ডার। এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেল পাওয়া এই বাংলা সাহিত্য। সেই সাহিত্যে লেখালেখি করা আমিও একজন লেখক, এই পরিচয় দিতে এখনও ভীষণ সংকোচ বোধ করি। লেখক এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। তবে আমার মাঝে একটি লেখক-ভ্রূণের অস্তিত্ব অনুভব করি, যেটার জঠর সম্ভবত সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে বলতে হয় ফেসবুক। মোবাইলে অভ্র লিখতে শেখার পর থেকে এক লাইন, দেড় লাইনের অনুভূতি বা স্ট্যাটাস, সেটা দেখে অন্যদের করা মন্তব্য এক সময় নতুন কপাটের সন্ধান দেয়। এখনও সেই কপাটের এই পাশে আছি। খুব ইচ্ছে একদিন সেই কপাট খুলে যাবে, গল্পের মৌ মৌ গন্ধে ভরে যাবে আমার লেখক সত্ত্বার ঘর।
বর্তমানে মানুষকে এক ধরনের অস্থির সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যক্তি, সমাজ জীবন যেন এক শ্বাপদসংকুলে পরিণত হয়েছে। এখনকার প্রজন্ম বই পড়ে সোশাল মিডিয়াতে আসেনি। আর সেকারণেই সোশাল মিডিয়া, ভিডিও কনটেন্টের দাপট নতুন প্রজন্মের সমাজে সাহিত্য এক অচ্ছুত বস্তু। এরকম একটা সময়ে সাহিত্য নিয়ে পড়ে থাকা, চর্চা করা পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর স্রোতের বিপরীতে চলারই শামিল। তবুও সমাজে কিছু বোকা লোক থাকে যারা ঠেলে পাহাড় সরানো যাবে না জেনেও সেই কাজ করে যায়। হয়ত এর মাঝেই কোন আশা তাঁকে সামনে চলার সঞ্জীবনী দিয়ে যায়। আমি হয়ত তাদের দলেই পড়ি।
৩।
কিন্তু সাহিত্যের প্রয়োজন কেন? এটা একটা বড় প্রশ্ন। আজ চোখ খুললেই দেখতে পাই বড় প্রশস্ত রাস্তা, কিন্তু সেই রাস্তায় চলতে শৃংখলার বড় অভাব। চোখ বন্ধ রেখেও দেখা যায়, সুউচ্চ শিক্ষালয়, বিশালায়তনের হাসপাতাল। তবুও শিক্ষার মান নিয়ে, চিকিৎসার সেবা নিয়ে তৃপ্ত নয় কোন পক্ষই। শুধু আইন দিয়ে, উর্দি কিংবা উর্দি ছাড়া প্রশাসক দিয়ে সম্পুর্ন সমাধান আসেনা। সমাধান আসতে পারে যদি প্রত্যেকের ভিতরে একটি সুকোমল অন্তর থাকে। আর সেই সুকোমল হৃদয়ের জন্ম দিতে পারে হয়ত একটি মাত্র গল্প, উপন্যাস কিংবা একটি কবিতা।
সেই আশায় আমার গল্প লেখা শুরু। কামনা করি, সেই প্রত্যাশা যেন লেখালেখির শেষ দিন পর্যন্ত অটুট থাকে। তাই আমার কলমের খোঁচায় থাকে প্রান্তিক মানুষ ও তাদের জীবনের গল্প। সে কারনে আমার লেখা মানেই মজুর, মুটে, ইতরের গল্প। আমার গল্পে যতটুকু প্রেম থাকে হয়ত তার চেয়েও বেশি থাকে অপ্রেম। থাকে দুঃখের গল্প, তেমনি থাকে ছোট ছোট সুখের কম্পনের গল্প। সেই সব গল্পের মোড়কে আমি মূলত সোঁদাগন্ধে ভরা মানুষের ছবি আঁকার চেষ্টা করি। সেই সব গল্পের ছবিতে থাকে নানামুখী চরিত্রের আনাগোনা। আমার লেখায় জায়গা করে নেয় ভুল পথে চলা পথিক, পুঁজিবাদী সমাজের আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ কিংবা জনতার ধর্সিত হওয়া জনতা। আমার গল্পের উপাদান হয়ে উঠে বাটি চালানের মত কুসংস্কার কিংবা জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অপরাধী হওয়া ভাংড়ি শরাফতের কেরামতি । সেই কেরামতির টোটকায় আমার গল্প যেন বাংলা সাহিত্যের গল্পঘরের অর্গল খুলে দেয়।